গল্প – অমানুষ
তৃষা চৌধুরী
অমানুষ : মাঝে মাঝেই রাতের বেলা ভয়ানক স্বপ্ন দেখে আঁতকে চিল্লিয়ে উঠি। একা
একা ঘুমোতেই পারিনা। যেদিন একা একা ঘুমাই সেদিনই এরকম কিছু হয়। আজকেও
তাই হয়েছে মাঝরাতে আমার চিৎকার শুনে আমার মায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। কি
হয়েছে আয়াত এভাবে হঠাৎ করে চিৎকার করে কেদে উঠলা কেন। কোনো দূঃস্বপ্ন
দেখছো? আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম মা ওই যে ওই লোকটা আমাকে মারতে
আসছে। ও আমাকে মেরে ফেলবে মা ওর হাত থেকে আমাকে বাচাও।
– মা বললো কোথায় এখানে তো কেউ নেই কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা। কেউ তোমাকে
মারতে আসছে না ওটা স্বপ্ন ছিলো এখন ঘুমাও আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।
এরপর থেকে মা আর কখনো আমাকে একা একা ঘুমোতে দেয়নি। দেখতে দেখতে
বেশ কয়েক বছর কেটে গেলো। কতকিছু পাল্টে গেলো আমিও বড় হয়ে গেলাম।
কিন্তু আমার স্বপ্ন দেখার ধরন টা এখনো পাল্টে নি। আমি এখনো প্রায় প্রতি রাতে সেই
স্বপ্নটাই দেখি যেটা গত ১৭ বছর যাবৎ দেখে আসছি। একটা লোক লম্বা লম্বা চুল ইয়া
বড় গোফ দেখতে অনেক টা ভয়ানক ।
লোকটা একটা মহিলাকে একটা আধভাঙ্গা ঘড়ের ভেতর চাকু দিয়ে জবাই করছে।
আমার কাধে স্কুল ব্যাগ। আমি উনাদের চেচামেচির শব্দ শুনে জানালা দিয়ে উকি দেই।
আর উকি দিতেই সব টা দেখে ফেলি। এসব দেখে আমি অনেক ভয় পেয়ে যাই। ভয়ে
কেদে ফেলি। লোকটা আমার কান্নার শব্দ শুনে আমাকে দেখে ফেলে চাকু টা নিয়ে
আমার দিকে এগিয়ে আসে এটা দেখে আমি আরও বেশি ভয় পেয়ে যাই আর ওখান
থেকে পালানোর চেষ্টা করি। এরপর পরই আমি ভয়ে চিল্লিয়ে উঠি আমার ঘুম ভেঙ্গে
যায়। এই একটা স্বপ্ন আমার জীবন টাকে নরক করে দিচ্ছে।
আমাদের ফেসবুক গুপে জয়েন হউন
– অহহ আপনাদের তো আমার পরিচয় টাই দেওয়া হয়নি। আমি আয়াত আমার বাবা
মায়ের একমাত্র রাজপুত্র। আমার বাবা ডাক্তার রায়হান রনি আর মা ডাক্তার রেহেনা
পারভিন। উনাদের স্বপ্ন ছিলো আমিও ডাক্তার হবো আর মানুষের সেবা করবো। আমি
লক্ষি ছেলের মতো বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরন করে ফেলেছি।
– আজ আমার জীবনের ফাস্ট টাইম কাউকে অপারেশন করতে হবে। এর আগে
কখনো কাউকে অপারেশন করিনি। আমি রুগীর মুখটা পর্যন্ত দেখি নি। হুট করেই
বাবা আমাকে ডেকে বললেন। আয়াত আজকে আমার জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে
তাই আমি চাই আমার অনুপস্থিতিতে অপারেশন টা তুমি করবে। বাবা কে না করলেও
বাবা মানবে না তাই আমি আর তাকে না করলাম না।
– অনেক আগ্রহ আর একরাশ চিন্তা নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করলাম।
অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে রুগীর মুখটা দেখে রীতিমত চমকে গেলাম। এটা আমি
কাকে দেখছি!
– হ্যা এই রুগীটাই আমার জন্মদাতা পিতা। আজ থেকে অনেক বছর আগে যখন আমি
খুব ছোট ছিলাম । তখন দেখতাম আমার এই বাবা কোনো কাজকর্ম করতো না। মা
মানুষের বাসায় কাজ করে যা রোজগার করতো তা দিয়েই কোনমতে সংসার চলতো।
কত রাত না খেয়ে থাকতাম তার হিসেব নেই। বাবা প্রতিদিন রাতে মদ খেয়ে মাতাল
হয়ে বাসায় ফিরতো।
মা কিছু বললেই মাকে ধরে মারধোর করতো । এক কথায় মায়ের উপর অমানবিক
অত্যাচার করতো। মা কিচ্ছু বলতো না সব চুপচাপ মুখ বুজে সহ্যকরে নিতো। আর
আমি তো বাবাকে প্রচুর ভয় পেতাম কখনো উনার সামনে যেতাম না। মাঝে মাঝে
বাবা আমাকেও মারতেন।
– একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি বাবা আর মায়ের মধ্যে খুব ঝগড়া হচ্ছিল
ঝগড়ার টপিক টা এরকম ছিলো বাবা কোনো এক মহিলাকে বিয়ে করেছেন উনাকে
বাড়িতে আনতে চান কিন্তু মা উনাকে বাড়িতে উঠতে দিবেন না। আমি জানালার পাশে
দাড়িয়ে চুপচাপ উনাদের ঝগড়া দেখতেছিলাম।
গল্প শুনতে ভিজিট করুন আমাদের চ্যানেলে ক্লিক
ঝগড়ার এক পর্যায়ে এসে বাবা টেবিলের উপর থেকে চাকুটা নিয়ে মায়ের গলায় বসিয়ে
দিলো। সাথে সাথে মায়ের গলা থেকে রক্ত পড়তে শুরু করলো একটু পরে মায়ের
লাশটা মাটিতে পরে গেলো। এসব দেখে আমি ভয়ে চিৎকার দিয়ে কেদে উঠি। আমার
কান্নার আওয়াজ শুনে। বাবা রেগে আমার মুখ শক্ত করে চেপে ধরে চাকুটা চোখের
সামনে এনে বললেন চুপচাপ থাকবি এসব কথা যেনো কেউ জানতে না পারে আর
এখান থেকে চলে যা নয়তো তোর অবস্থাও তোর মায়ের মতো হবে।
– এসব শুনে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেলো জোরে কান্না করতেও পারছিলাম না যদি
বাবা আমাকেও মেরে দেয় সে ভয়ে। আমি এক দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি
দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তায় কিছুর সাথে হোচট খেয়ে পড়ে যাই তারপর কি হয় কিচ্ছু
মনে নেই।
– আমি যখন চোখ খুললাম পায়ে ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় নিজেকে খাটের উপর
আবিষ্কার করলাম। কিন্তু আমি এখানে কি করে আসলাম । কার বাসা এটা
কোথায় আছি আমি?
– একটু পরে খেয়াল করলাম মাথার পাশে একজন ভদ্র মহিলা বসে আছে। উনি
আমাকে জিজ্ঞেস করলেন বাবা এখন তোমার কেমন লাগছে। আমি উনার কথার
জবাব দিলাম হ্যা আগের থেকে অনেকটাই ভালো লাগছে।- ভদ্রমহিলাটি বললেন
তোমার নাম কি? তোমার বাবা মা কোথায়? রাস্তায় ওভাবে পড়ে ছিলা কেন?
– আমি উনার প্রশ্নের জবাব দিলাম আমার নাম আয়াত। আসলে এই পৃথিবীতে আমার
আপন বলতে কেউ নেই। আর আমি জানিও না রাস্তায় কি করে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
বাবার ভয়ে আমি বাবার কথা উনাকে কিছু বললাম না। আর না বলাটাই ভালো এরকম
অমানুষকে নিজের বাবা হিসেবে পরিচয় দেওয়ার থেকে নিজেকে অনাথ বলাই
ভালো।
– আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা আপনারা কারা আর আমাকে এখানে কি করে
নিয়ে আসলেন। উনি বললেন আমি ডাক্তার রেহানা পারভীন আর ওইযে ওখানে যাকে
দেখতে পাচ্ছো সে হলো ডাক্তার রায়হান রনি উনি আমার হাজবেন্ড। আমরা হসপিটাল
থেকে বাসায় ফেরার পথে তোমাকে অচেতন অবস্থায় রাস্তায় পড়ে
থাকতে দেখে আমাদের বাসায় নিয়ে আসি।
-আচ্ছা আয়াত একটা কথা বলো তো এখন তুমি যাবে কোথায়?
– আমি বললাম জানিনা কোথায় যাবো এখান থেকে গিয়ে কোথাও কাজ খুজে নেবো।
– উনি বললেন আমাদের কোনো সন্তান নেই যদি তুমি চাও তাহলে আমাদের বাসায়
থেকে যেতে পারো আমার ছেলে হয়ে। কোনো কষ্ট দেবো না তোমাকে। তুমি এখানে
থাকলে অনেক ভালো থাকবে আমি আবার তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো।
– আমি উনার কথা শুনে মনে মনে ভাবলাম রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর থেকে
এখানে থেকে যাওয়াটাই ভালো হবে আমি উনাদের কথায় রাজি হয়ে গেলাম। পা
রাখলাম এক নতুন জীবনের অধ্যায়ে। তারা আমাকে কোনকিছুর অভাব দেয়নি যখন
যা চেয়েছি সব দিয়েছে উনারা খুব ভালোবাসে আমাকে আর আমিও খুব ভালোবাসি
উনাদের। এখন আমার পৃথিবী তারা আমার বাবা মা। উনাদের জন্যই আজ আমি
এতদূর আসতে পেরেছি অনাথ আয়াত থেকে ডাক্তার আয়াত হতে পেরেছি।
এসব ভাবতে ভাবতে চোখের পাপড়ি গুলো ভিজে গেলো। পাশ থেকে আদনান
আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললো কিরে আয়ান কোথায় হারালি অপারেশন টা শুরু কর।
আদনানের ধাক্কা খেয়ে আমার ভাবনার ঘোর কাটলো। আমি আদনানকে বললাম তুই
থাক আমি এক্ষুনি আসছি। আমি ওখান থেকে সোজা বাবার কেভিনে ঢুকে পড়লাম।
বাবা আমাকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন। কি হলো আয়াত
তুমি এখানে কেন অপারেশন শেষ হইছে? আরে আয়াত তোমার চোখে পানি কেন
কি হয়েছে সব ঠিকঠাক আছে তো নাকি?
Read More : দ্বিতীয় বাসর
-আমি বাবার কথা শুনে বললাম বাবা আমি এই অপারেশন টা করতে পারবো না। বাবা
আমার কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেন কি হয়েছে কোনো সমস্যা?
– আমি বাবাকে বললাম বাবা এটা আমার জীবনের প্রথম অপারেশন আর আমি আমার
জীবনের প্রথম অপারেশন কোনো অমানুষকে করে আমার ডাক্তারী জীবনে
অভিশাপ ডেকে আনতে চাইনা। তার থেকে ভালো তুমিই অপারেশন টা করে দাও।
– বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে সবটা খুলে বলো না বললে বুঝবো
কিভাবে? আমি বাবাকে সবটা খুলে বললাম। বাবা বললেন কিন্তু তুমি তখন কেনো
বলোনি তোমার বাবা জীবিত আছেন। আচ্ছা যাইহোক অপারেশন টা তোমাকেই
করতে হবে কারণ উনি তোমার জন্মদাতা পিতা। আর শুনো আয়াত তুমি উনাকে
অমানুষ বলতাছো হ্যা উনি অমানুষ ঠিক আছে এখন যদি তুমি এভাবে জেদ করে
উনার অপারেশন টা না করো তাহলে তোমার আর উনার মধ্যে পার্থক্য কি বলো
একটা উক্তি আছে কুকুরে কামড় দিলে কুকুরকে তুমি কামড়াতে পারবে না।
যদি তুমিও উল্টো কুকুরকে কামড়াতে যাও তাহলে তোমার আর কুকুরের মধ্যে কোনো
পার্থক্য থাকবে না। আর আমি আমার আয়াত কে এরকম কোনো শিক্ষা দেইনি যে
কুকুরের সাথে কুকুর হবে। আমার আয়াতকে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান আল্লাহ দিছে।
এখন তুমি এই মানুষ টাকে নিজের জন্মদাতা পিতা হিসেবে নয় একজন রুগী হিসেবে
চিকিৎসা করবে।
– আমি বাবাকে খুব ভালোবাসি সম্মান করি তাই বাবার কথা অমান্য না করে
অপারেশন টা আমিই করে দিলাম। অপারেশন করে আমি আর বাবা সোজা বাসায়
চলে আসলাম । বাসায় যাওয়ার পর মাকে আমি আমার জীবনের অতীত আর
আজকের কাহিনী সবটা খুলে বললাম। মা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন
এরে আয়াত তুই এখন আমাদের কে ছেড়ে চলে যাবি না তো? তাহলে এধাক্কা কিন্তু
আমরা সইতে পারবো না। তোকে খুব ভালোবাসি আমরা। তোকে ছাড়া বেচে থাকা
অসম্ভব হয়ে যাবে।
.
– আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম পাগল নাকি আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাবো কেন
তোমরাই তো আমার সব। তোমরা আমার পৃথিবী। আর পৃথিবীই যদি না থাকে আমি
থাকবো কিভাবে বলো। কক্ষনও তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না। মা আর বাবা
আমার কথা শুনে হেসে দিলেন চোখে পানি টলমল করছে । আমি মুগ্ধ হয়ে তাদের
হাসি দেখতে লাগলাম। আমি যেনো সারাজীবন এভাবেই আমার বাবা মায়ের মুখে
হাসি ফুটিয়ে রাখতে পারি।
– এরপর আমি আর একসপ্তাহ হসপিটালে যাইনি। কারণ আমি চাইনা আমি আবার সেই
অমানুষ টার মুখ দেখি। তার মতো অমানুষের মুখ দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।
একদিন বাবা এসে বললেন সেই অমানুষ টা নাকি রিলিজ হয়ে চলে গেছে। উনার
দুইছেলে উনাকে নিতে আসছিলো। হয়তোবা ওই দুই সন্তান সেই মহিলারই হবে।
যে মহিলার কারণে আমার মাকে দুনিয়া ছাড়তে হয়েছিলো।
– অথচ অমানুষ টা জানেওনা তার ফেলে দেওয়া আয়াত ই তাকে অপারেশন করেছে।
আর জানবে কি করে সে হয়তো জানেও না আয়াত বেচে আছে কি না মারা গেছে।
আমার জন্মদাতা পিতার মতো অনেক পিতা এরকম আছেন যারা শুধু মনে করেন
সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর পরেই তাদের দায়িত্ব শেষ । এরপর আর কোনো
দায়িত্ব তাদের নেই। সন্তান মারা গেছে কি না বেচে আছে এটা দেখার ও কোনো
প্রয়োজন নেই। তারা হয়তো এটা জানেনা সবাই তাদের মতো বেঈমান না। এই দুনিয়ায়
ফেরেশতার মতো কিছু ভালো মানুষ ও আছে। যাদের জন্যই এই পৃথিবী টা আজও
টিকে আছে!
(এখনো এই পৃথিবীতে এমন কিছু কিছু সম্পর্ক আছে যে সম্পর্ক গুলা রক্তের
সম্পর্কের কাছে হেরে যায়)