ইস্ক মোবারাক পার্ট ১৫
লাবিবা ওয়াহিদ
ইশরা চোখদুটো কে রসোগোল্লার মতো করে সামনে তাকিয়ে আছে। তার সামনে গোলাপের পাঁপড়ি দিয়ে বড় করে লাভ শেপের ডিজাইন করা আছে আর তার মাঝে একগুচ্ছো গোলাপ নিয়ে হাটু গেড়ে বসে আছে নিলয়। চারপাশে টুকটাক পেন্ডেলের ডেকোরেশন। দূরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে ফাযি। কখনো ভাবেনি তার ভালোবাসার মানুষটা এভাবে নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে প্রপোজ করবে! সব আশা-স্বপ্ন নিলয় মুহূর্তেই শেষ করে দিলো।
ইশরা অবাকতা সাইডে রেখে খুবই রাগাম্বিত হয়ে নিলয়কে বলে,”সক্কাল সক্কাল কি তামাশা পাইসেন? ভার্সিটি কি প্রেম করতে আসেন যে এখানে প্রেমের সার্কাস খুলে রাখসেন। এক পাগলের ভাত নাই নতুন পাগলের আমদানি যত্তোসব।”
বলেই ইশরা চলে যেতে নিলো ওমনি নিলয় ইশরার হাত ধরে আটকালো!
– সমস্যা কি তোমার? এগুলো কোন ধরণের কথা? নিজের উত্তর দিয়ে তারপর এখান থেকে যাবা এর আগে যেতে পারবা না!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
ইশরা রেগে হাত ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “আপনার কথা মানতে আমি একদমই বাধ্য নই ভার্সিটি তে আসছেন পড়ালেখার জন্য সেটা করেন আজাইরা মাস্তানি করে কোনো লাভ নেই।”
– তুমি আমাকে মানতে বাধ্য কজ আমি তোমার বাগদত্তা হবো খুব শীঘ্রই সেটা তুমি মানো অথবা না মানো ওকে?
ইশরা চোখ দুটোকে বড় বড় করে বলে,”এইযে হ্যালো! মাথা ঠিক আছে আপনার কাকে কি বলছেন আপনি? নিজের কনফিডেন্সে থাকুন ওভার কনফিডেন্স এ জড়াইয়েন না জানেন তো কনফিডেন্স ভালো ওভার কনফিডেন্সে প্রচুর বাঁশ খেতে হয়! সো আমার কাছ থেকে দূরে থাকুন। এএএএহ ফাইজলামি পাইসে আমাকে নাকি সে….”
– বাগদত্তা করবোই করবো ইটস মাই চ্যালেঞ্জ?
– ওহ রিয়েলি? তাহলে আমিও বলে রাখি আমি বিবাহিত আমার হাসবেন্ড আছে! যদি জানে আপনি আমার পিছে লাগসেন তাহলে আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে না।
ইশরা ম্যারিড শুনে নিলয়ের চোখ কপালে উঠলো। নিলয় যেনো কথা বলতে ভুলে যায়। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”আমি শিউর তুমি ফান করছো তাইনা?”
– আমায় পাগলা কুত্তায় কামড়ায়নাই যে আপনার সাথে ফান করবো।
বলেই ইশরা চলে গেলো আর নিলয় সেখানেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে।
– ওই মিস্টার চাশমিশ!
– উফফ কি হইসে এভাবে চেঁচাও কেন?
– চেঁচাই মানেহ? রাস্তাঘাটে পোলাপান আমারে প্রপোজ করে আর আপনি নাকে তেল দিয়া ঘুরেন!
– করুক গা তাতে আমার কি?
– ওরে খচ্চর পোলা রে তুই আমার জামাই না অন্যকিছু! তোর বউরে মাইনষে প্রপোজ করবো আর তুই কোনো রকম খবর নেস না তোরে আলুর দম বানামু।
বলেই ইশরা সাদাফকে গিয়ে ইচ্ছা মতো কিলগুসি দেয়া শুরু করলো।
৫ বছর পর,
সময়ের পরিবর্তনে অনেক কিছুই বদলে গেছে। কেউ কেউ একে অপরকে চিনেছে, কেউ কেউ পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, কেউ কেউ সেই আগের মতোই আছে, আবার কেউ কেউ নিজের জীবনের অর্ধেকাংশই হারিয়েছে নিজের অপরাধের কারণে।
– অনি অনিই কোথায় তুমি আনিকা কান্না করছে তো!
অনি রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে আনিকাকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টায় রইলো।
– তুমি এখনো যাওনি?
– নাহ আনিকা একা ছিলো তাই ছিলাম সে যাইহোক আমি যাচ্ছি।
বলেই অনির স্বামী তিয়াস চলে গেলো। অনি চুপচাপ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে চোখের জল ফেললো তারপর নিজের মেয়ের দিকে তাকালো। মেয়েটা গুটিশুটি হয়ে আরামের ঘুম দিচ্ছে। আজ থেকে ৫ বছর আগে সেই পথেই তম্ময় তাকে ছেড়ে চলে যায়। অনির তখন নিজের পাশে কেউই ছিলো না। সে বুঝেছে তার ভুল এবং পদে পদে তার ফল ভোগ করেছে। কিছুমাস বাদে জানতে পারে সে আবার প্র্যাগনেন্ট! সেদিনই অনি বুঝলো মায়ের সুখের উল্লাস।কিন্তু তার বাচ্চাকে নিয়ে সে কই যাবে সেটাই ভেবে পায়না অনি।
অনি মরুক বাচুক কিন্তু তার বাচ্চা টাকে যে তার বাচাতেই হবে। অনি সেদিন আল্লাহর কাছে সর্বপ্রথম প্রার্থনা করেছিলো, “হে আমার মাবুদ জীবনে যে ভুল করেছি করেছিই তার ক্ষমা নেই আমি জানি কিন্তু তাও এবার নিজেকে শোধরাতে চাই। তুমি আমায় ক্ষমা না করো আমি কিছুই বলবো না কিন্তু দয়া করে এবার আমার এই সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখাও। আমি আর কিছুই চাইনা তোমার কাছে শুধু আমার বাচ্চাটাকে ভালো রাখবেন।”
বলতে বলতে সেদিন সে সেই রাস্তায়ই বসে পড়েছিলো। সেই রাস্তাতেই অনি সেদিন তিয়াস কে পেয়েছিলো। তিয়াসই তার জীবনে নতুন আলোর খাচা নিয়ে আসে। সেই থেকেই অনির অভাগা ছোট্ট সংসার তার আনিকাকে নিয়ে।
– নিলয়!
– হুম বলো।
– আপু প্র্যাগনেন্ট জানো?
নিলয় অবাক হয়ে ফাযির দিকে তাকায় আর দৌড়ে মেহেরের রুমে যায়। মেহের রুসান তখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ছিলো। নিলয় চট করে পিছে ফিরে গেলো এবং বললো,”সরি সরি সরি ভুল সময়ে চলে এসেছি।”
রুসান মেহেরকে চট করে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। এদিকে মেহের লজ্জায় শেষ! রুসান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,”আয় আয় ভেতরে আয়।”
নিলয় পিছে ফিরে রুসানকে ডাইরেক্ট গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,,,”কংগ্রেস ভাইয়ায়ায়ায়া তুমি বাবা হবা আর আমি চাচ্চু হবো উফফফ ভাবতেই আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করছে।”
– তো নাচ না ফাযিকেও ডেকে আনি সেও তার হাসবেন্ডের নাচানাচির ভিমরতি দেখুক।
ততোক্ষণে ফাযি রুমে প্রবেশ করে ফেলেছিলো। রুসানের কথা শুনে ফাযি ফিক করে হেসে দিলো আয়াথে মেহেরও। ওহ আপনাদের তো বলাই হয়নি। মেহের এবং রুসানের বিয়ে হয়েছে সাত মাস আগে। আর সেদিনই নিলয় সবার সামনে বলেছিলো যে সএ ফাযিকে বিয়ে করবে। ফাযির পরিবার প্রথমে নাকোচ করলেও পরে রাজি হয়ে যায়। তাই দুই বিয়ে একসাথেই সম্পন্ন হয়।
সেদিন ইশরা চলে যাওয়ার পর নিলয় সেখানে বসেই কাঁদতে থাকে। তখন তার পাশে কেউ ছিলো না কিন্তু ফাযি ছিলো। সেদিন থেকে ফাযি সবসময় নিলয়ের পাশে থাকে। ফাযির সাথে থেকে নিলয় অনেকটাই নরমাল হয়। ফাযি একদিন হুট করেই তার পরিচয় দেয় যে ফাযি মেহেরের ছোট বোন। সেই থেকেই দুজনের মাঝে আরও গভীর সম্পর্ক হয়ে উঠে। কিন্তু নিলয় যে এভাবে হুট করে বিয়ের প্রপোজাল দিবে সে কখনো ভাবেনি।
– ম্যাম বাংলাদেশ থেকে আপনার কল এসেছে।
ইশরা দৌড়ে চলে আসে রিসিপশনে এবং কল রিসিভ করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”হ্যা…লো!”
– ইশরু মা আমার কেমন আছিস?
ইশরার মন নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো তবুও নিজেকে সামলে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো মামনি তুমি কেমন আছো?”
– তোকে ছাড়া কি করে ভালো থাকি বল? সেই ৫ বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলি একবারও আসলি আমাদের সাথে দেখা করতে।
ইশরা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,”কিসের আশায় যাবো মামনি বলতে পারো?”
রেহেক আর কিছুই বলতে পারলো না, কি বলবে সে তার যে কিছুই বলার নেই। তারপর আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে ইশরা নিজের ফ্লাটে চলে গেলো।
ইশরা ৫ বছর আগে লন্ডন এসেছে নিজের ডাক্তারি কমপ্লিট করতে। তার মাঝে আরেকটা কারণও আছে বলা যায়। ইশরা গলা থেকে স্টেথোস্কোপ টা নামিয়ে আপ্রোন টা খুলে বেলকনির ফ্লোরে দুই হাটুতে হাত রেখে বসে আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। চারপাশে সারি সারি মেঘ জমেছে তাতেই বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি নামবে। ইশরার মনেও হাজারো কালো মেঘ জমা হয়ে আছে যা ইশরার চোখের অয়ানি বৃষ্টি আকারে ঝড়লেও কমবে না। হঠাৎই খুব বৃষ্টি নামলো সাথে ইশরার চোখের পানি অঝোরে ঝড়তে লাগে। ইশরা তার ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য কতোই না যুদ্ধ করে এসেছে আর সেই মানুষটা আজ পর্যন্তও তাকে বুঝলো না। তার থেকে বিচ্ছিন্ন আজ পাঁচ বছর! অনির প্রমাণের জন্য কতোই না রিস্ক নিয়েছিলো সে। ইশরা চোখ বুজে নিজের অতীত ঘাটা শুরু করলো।
সেদিন ভিডিও পাঠানোর পর রাস্তা দিয়ে আসছিলো ওমনি ইশরা দেখতে পায় ফাযি আর মেহের রাস্তা দিয়ে হেসে হেসে হেটে যাচ্ছিলো। ইশরা মেহেরকে দেখে অবাক হয়ে যায় কারণ একদিন সে হসপিটালে কিছু কাজ করতে গেছিলো সেখানে মেহেরকে অনির সাথে দেখেছিলো কিছু রিপোর্ট নিয়ে কথা বলতে আর সবচেয়ে বড় কথা সেদিন অনির হাতে একটা প্র্যাগনেন্সি কিট ছিলো। ইশরা দেরি না করে ফাযিদের কাছে যায়। ফাযি ইশরাকে দেখে অবাক হয়ে বলে,”আরে তুই এখানে?”
ইশরা হাসিমুখে বলে,”হ্যাঁ এমনি ঘুরতে এসেছিলাম যাইহোক উনি কে?”(মেহেরকে উদ্দেশ্য করে)
– ওহ তোকে তো বলাই হয়নি ও হলো আমার বড় বোন মেহের যার কথা তোকে প্রতদিন বলি আর আপু ও হলো ইশরা আমার সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড।
– ওহ হাই ইশরা!
– আসসালামু ওয়ালাইকুম আপু। আচ্ছা আপু যদি কিছু মনে না করেন আমি কি আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে পারি?
– হ্যাঁ অবশ্যই ফাযি তুই গিয়ে গাড়িতে বস আমি আসছি।
মেহেরের কথামতো ফাযি চলে যায়। ইশরা অনির ব্যাপারে সব কিছু খুলে বলে এবং মেহেরের চিনতে যেনো সুবিধা হয় তার জন্য অনির ছবিও দেখায়। মেহের সবটা শুনে অবাক হয়ে বলে,”এতো বড় বিজন্যাসমেন কে সে এভাবে ঠকাচ্ছিলো কেমন প্রকৃতির এই মেয়ে আল্লাহ রহম করো।”
– সে যাইহোক আপু অনি মেয়েটার সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে তথ্য চাই দয়া করে আমাকে হেল্প করুন।
– শুধু তথ্য কেন আমি তোমাকে অনেক প্রমাণও দিবো।
সেইদিনই মেহের সব প্রুভ ইশরাকে দেয়। ব্যাস এতেই সব হয়।
সেদিনের পর সাদাফের সাথে বিয়ে হওয়ার পর ইশরা টানা ৬মাস সাদাফের মনে একটু খানি জায়গা পাওয়ার আশায় অনেক কিছুই করেছিলো কিন্তু তার সব কষ্ট বিফলে যায়।
ইশরা বুঝতে পারে জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায়না তাই সে খুব কৌশল করে লন্ডন চলে আসে ডাক্তারি পড়ার কথা বলে।তবে সত্যি টা শুধু রেহেকই জানে। সেইদিন থেকে সাদাফ একবারও ইশরার খবর নেয়নি তাই ইশরাও দিনরাত এক করে পড়াশোনায় বিজি থাকতো। যখনই শুনে তার জন্য বাংলাদেশ থেকে কল এসেছে তখনই সে ভেবে নেয় এই বুঝি সাদাফ তাকে ফোন দিলো আর তাকে ব্যাক নিয়ে যাবে। কিন্তু প্রতিবারই তার চিন্তা আশা ইচ্ছা শেষ হয়ে যায়।
ইস্ক মোবারাক পার্ট ১৪
ইশরার আজই ডাক্তারি ফাইনাল ইক্সাম শেষ হলো। কিছু দিন পর সে হবে একজন ডক্টর। ‘ড. ইশরা ইশতার’ এক নামে সবাই তাকে চিনবে। কিন্তু তার সাদাফের অপেক্ষা কি আদৌ শেষ হবে নাকি সম্পর্কের ইতি টানতে হবে?
এসবই ভেবে চোখ মুছে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তারপর বাইরে থেকে খাবার অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ কিছু নোটস ঘাটে।
আকাশ এখন পরিষ্কার বৃষ্টি প্রায় অনেকক্ষণ আগেই থেমে গেছে।এর মাঝেই খাবার চলে আসে। ইশরা খাবার কমপ্লিট করে কিছু ফাইল নিয়ে আবার হসপিটালে চলে যায়। সেখানে সেসব ফাইল জমা দিয়ে দেয়। আধুনিক প্রযুক্তির জন্য ইশরার রেজাল্ট এক সপ্তাহের মাঝেই দেয়া হবে।
দুইদিন পর,
ইশরা শপিং করতে বেরিয়েছে হাটতে হাটতে হঠাৎ দূরে একজনকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে রইলো।