তুমিময় অসুখ সিজন ২ - Golpo Bazar

তুমিময় অসুখ সিজন ২ পর্ব ২ || tumimoy osukh 2

তুমিময় অসুখ ২

তুমিময় অসুখ সিজন ২ পর্ব ২
লেখা-ইশরাত জাহান ফারিয়া

আযানের শব্দে ঘুম ভাঙলো আমার। গুমোট অন্ধকারে আবছা আলোয়
আশেপাশে তাকাতেই চোখে পড়লো অভ্র ভাইয়ের আদুরে মুখখানা। কাউচে
উল্টো ঘুরে ঘুমিয়ে আছে, এক পা টি-টেবিলের উপর অন্যটা কোলবালিশের
উপর। অদ্ভুতভাবে ঘুমান লোকটা। আমি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় চলে
গেলাম। বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। আকাশ থেকে পড়া মুক্তোঝরানো পানি ভোরবেলা
খুব সুন্দর দেখায়। আলো-আঁধারির শহরে নিয়ন বাতিগুলো পথের কোনায়
কোনায় রহস্যময় বার্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে!

আমার ছোট্ট জীবনটাও এক অদ্ভুত রহস্যের আড়ালে ঢাকা। সবসময় ভদ্র,
চুপচাপ মেয়েটাও আজ কারো বাড়ির বউ, কারো স্ত্রী! কাল ছিলাম নিজের ঘরে
আর আজ! আজ অন্য বাড়ি, অন্য কারো ঘরে। মেয়েদের জীবনটাই এরকম।
মেয়েদের নিজস্ব বাড়ি নেই! জন্মের পর বাপের বাড়ি আর বিয়ের পর স্বামীর
বাড়ি! আমার মতো চুপচাপ, বিরক্তিকর একটা মেয়ের মাঝে মামানি এমন কি
দেখলেন যে আমাকে তার ছেলের বউ করেই নিয়ে এলেন? আমার ভদ্রতা,
সরলতা দেখে নিশ্চয়ই।

ভাবনার প্রহর কাটিয়ে চলে গেলাম রুমে। ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করে
ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুমটা খুব বড় আর পরিচ্ছন্ন। এতবড়
ওয়াশরুম সিনেমাতেই দেখেছি। শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছি, আমার গোসল
করতে বেশ সময় লাগে। এমন সময় ওয়াশরুমের দরজা ধাক্কানোর শব্দ পেলাম।
অভ্র ভাই জোরে জোরে চিল্লিয়ে বলছেন, ‘এই ভেতরে কে? হুম?’
অভ্র ভাই বোধহয় ঘুমের ঘোরে আছেন। সেজন্য আমি যে আছি এটা মাথায় নেই।
আমি আস্তেআস্তে বললাম, ‘আ..আমি!’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

–“কে?”
—“ইরাম।”
—“ওহহ,তুই। এখন বের হ এক্ষুনি।”
আমি অসহায় গলায় বললাম, ‘আমার শাওয়ার নেওয়া শেষ হয়নি, সময় লাগবে।’
অভ্র ভাই রেগে বললেন, ‘আমি কিছু জানিনা, এক্ষুনি বের হতে হবে।’
আমি বললাম, ‘দশটা মিনিট সময় দেন।’
—” না, এক্ষুনি।”
আরে কি ঝামেলা! এখনো অর্ধেক শাওয়ারই নেওয়া হয়নি আর ওনি দশটা মিনিট
টাইম দিতে পারবেন না! আজব তো। অভ্র ভাইয়া এমন জোরে দরজা ধাক্কাছে যে
এক্ষুনি দরজা ভেঙ্গে যাবে।আমার কান্না পেয়ে গেলো। কাঁদোকাঁদো গলায়
বললাম, ‘প্লিজ দুটো মিনিট সময় দেন। আমি কাপড়টা চেঞ্জ করে বেরুচ্ছি।’

কথাটা বলতে দেরি দরজা ভাঙতে দেরি হয়নি। আমার কথাটা শোনার আগেই
ভুলবশত দরজার ছিঁটকিনি অভ্র ভাইয়ের ধাক্কায় খুলে গিয়েছে। আর ওনি
অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ভেজা কাপড়ে জবুথবু হয়ে
দাঁড়িয়ে আছি। চুল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে, শাওয়ারটা তখনো চলছে। ইশ, কি
লজ্জ্বা! আমি উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কান্নাভেজা কন্ঠে বললাম, ‘প্লিজ
যান। আমি এক্ষুনি বেরুচ্ছি!’

অভ্র ভাইয়া বিরক্ত কন্ঠে বললেন, ‘ আমি বুঝিনি ডোর এভাবে ভেঙ্গে যাবে। স্যরি।’
বলেই দরজাটা ভিড়িয়ে সরে গেলেন। আমি আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেললাম।
হৃদপিন্ড ক্রমাগত হাতুড়ি পেটাচ্ছে। লজ্জ্বায় হাত-পা কাঁপছে। তাড়াতাড়ি শাওয়ার
শেষ করে বেরিয়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে। রুমে ঢুকেই দেখি ওনি গভীর ঘুমে
মগ্ন। বিছানায় এলোমেলো ভঙ্গিতে যেভাবে কোলবালিশ চেপে শুয়ে আছেন,
দেখলে যে কেউ অন্যকিছু ভাববে। পরনের পোলো শার্টের কলার ওনার থুতনির
উপর ওঠে আছে। শর্ট ব্লু-জিন্স পায়ের হাটু পর্যন্ত উঠে এসেছে।

.

পায়ের লোমগুলো এদিক ওদিক দুলছে! ঠান্ডা বাতাসে পর্দাগুলো পতাকার মতো
উড়ছে। আমি ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম ওনার দিকে। ইতস্তত করে ডাকলাম।
বললাম, ‘আপনি না ওয়াশরুমে যাবেন?’
অভ্র ভাই ঘুমের ঘোরে বললেন, ‘পরে যাবো। ডিস্টার্ব করিস না। ঘুমাতে দে।’

আমি সরে আসলাম। এতক্ষণ দরজা ভেঙ্গে ঢুকতে চাইছিলো আর এখন, এখন
কিনা যাবেনা। মাঝখান থেকে অর্ধেক শাওয়ার নিয়ে আমাকে বেরিয়ে আসতে
হলো। ভালো লাগেনা। এখনো অন্ধকার কাটেনি। আমি রুমের লাইট জ্বালিয়ে
নামাজ পড়ে নিলাম। লাইটের আলো ওনার চোখে পড়তেই লাফিয়ে উঠলেন।
রাগী চেহারা নিয়ে আমাকে নামাজ পড়তে দেখে আর কিছু বলেননি। চুপ হয়ে
গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। নামাজ শেষ করে আমি আলো নিভিয়ে রুম থেকে
বেরিয়ে এলাম।

নিচে নেমে দেখি মামানি আর বুয়া ডাইনিংয়ে রুটি বেলছেন। আমাকে দেখতে
পেয়ে মামানি দ্রুত আমার কাছে এলেন। বললেন, ‘এতো ভোরে উঠার কোনো
দরকার ছিলো তোর?’
—“আমিতো ভোরেই উঠি। অভ্যাস হয়ে গিয়েছে!”
—“নামাজ পড়েছিস?”
—“হুম।”
—“অভ্র’ পড়েছে?”
—“নাহ, ওনিতো ঘুমাচ্ছেন।”
মামানি একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। আমাকে বললেন, ‘কত চেষ্টা করি
ভোরবেলা ওঠাতে, নামাজটা পড়াতে। কিন্তু এই ছেলে নামাজটা কাযা করবেই।
ঘুম থেকে উঠবে দশটায়।’

.

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এতো দেরিতে?’
মামানি মৃদু হাসলো। বললো, ‘এসেছিস বাসায়। দেখবি এই ছেলের
কান্ডকারখানা।’ তারপর অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, ‘তোর আব্বু হয়তো বিয়েটা
মানতে পারেনি রে। কিন্তু কি করবো বল, নিজের ছেলেকে উচ্ছনে যেতে দেখলে
কোনো মা-বাবা কি ঠিক থাকতে পারে? তাই স্বার্থপরের মতো তোর মতো ভালো
একটা মেয়েকে অভ্র’র সাথে সারা জীবনের জন্য জুড়ে দিলাম। ক্ষমা করে দিস
মা!’

আমি হাসলাম। বললাম, ‘ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। এরকম করবে না কখনো!
আচ্ছা, মামা কোথায়? বাসার সবাই উঠেনি?’
—“নামাজ পড়ে মর্নিং ওয়াকে গিয়েছে তোর মামা। আর বাসার সবাই ঘুমাচ্ছে,
এখনো উঠার সময় হয়নি ওদের।”
—“ওহহ! তুমি কি করছো?”
—“নাশতা বানাচ্ছি!”
—“আমি বানিয়ে দিচ্ছি দাঁড়াও।”
মামানি হেসে বললেন, ‘আমি কি বউ এনেছি রান্না করতে? আমি বউ এনেছি
আমার ছেলেকে মানুষ করতে, আমার মেয়ে বানাতে এনেছি। আর নাশতা
বানানো শেষ। তোর কিছু কর‍তে হবেনা।’

আমি কিছু বলার আগেই ফোন এলো মামানির। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে
ফোন রিসিভ করে অনেকক্ষণ কথা বললো। আমি শুনতে পেলাম না। বুয়ার সাথে
ব্রেডে জ্যাম লাগাতে ব্যস্ত আমি! কিছুসময় পর মামানি আমার হাতে ফোন ধরিয়ে
দিয়ে বললেন, ‘কথা বল!’

আমি মিষ্টি হেসে লনে চলে এলাম। ওপাশ থেকে আব্বুর গলা শোনা গেলো। আমি
‘আসসালামু আলাইকুম’ বলতেই আব্বু সালামের জবাব দিয়ে চুপ করে রইলেন।
নিদারুণ নিঃস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলেন , ‘ এমন একটা ছেলের সাথে আমি তোর
বিয়ে দিতে চাইনি মা। নেহাৎ তোর আম্মু কথা দিয়ে ফেলেছিলো নাহলে মরে
গেলেও বখাটে ছেলের কাছে বিয়ে দিতাম না।’

.

আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। কেনো জানিনা, শুধু এটা জানি আব্বু অভ্র
ভাইয়াকে বিশেষ পছন্দ করেন না। আম্মুর জেদের কাছে হেরে গিয়ে আব্বু এ
বিয়ে থেকে আমাকে বাঁচাতে পারেনি। বিয়ের সময় উপস্থিত ছিলো না আব্বু।
নিজের আদরের রাজকন্যাকে কে-ই বা চায় বখাটে, অভদ্র ছেলের সাথে বিয়ে
দিতে? আমি আব্বুকে বললাম, ‘যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। তুমি ঠিক আছো তো?’

আব্বু তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘হুম ঠিক আছি। আর ওই অভদ্রটা তোর কিছু
করেনি তো? আমি কিন্তু তাহলে আমার মেয়েকে ওখানে থাকতে দেবোনা,
নিজের কাছে নিয়ে আসবো। এসব গুন্ডাপান্ডা ছেলে নিজের বউকে কি আর
ভালোবাসে? ভালোবাসা কি এটা কি ওরা জানে? স্ত্রীর গায়ে হাত তোলাটা ওদের
স্বভাব। এমন কিছু হলে আমাকে জানাবি।’

আমি আব্বুর কথা শুনে চুপ রইলাম। এমন কিছু যে হয়নি বা আদৌ হওয়ার
সম্ভাবনা নেই সেটা আব্বু কখনোই বিশ্বাস করেনা। আব্বু মনে করে অভ্র ভাইয়া
ভালো ছেলে নয়, মারামারি করাটাই অভ্র ভাইয়ার কাজ। এই বদ্ধমূল ধারণা থেকে
আজ পর্যন্ত আব্বুকে বের করে আনতে পারেনি কেউ! এখনো বোঝানো বৃথা,
তাই সেই চেষ্টা না করে আমি বললাম, ‘আচ্ছা জানাবো। রাখি!’

.

—“হুম, ভালো থাকিস। সমস্যা হলে জানাবি। আমি নিয়ে আসবো ওখান থেকে!”
—“আচ্ছা!”
বলেই ফোন রেখে দিলাম। লনের ঘাসগুলোতে দীর্ঘক্ষণ খালি পায়ে হাঁটলাম।
বাগানের গাছগুলোতে পানি দিলাম। আজ অনেক ফুল ফুটেছে গাছে! বাতাসে
একরাশ মুগ্ধতার ছোঁয়া! তখন পশ্চিমাকাশ অলৌকিক লাল, বৃষ্টিভেজা একটা
নতুন সকাল। প্রাচীর ঘেঁষে বসে থাকা দুটো চড়ুই পাখি নজরে আসলো আমার।

মুহূর্তেই মনে হলো, ‘জোড়া চড়ুঁইয়ের সংসার।’ আচ্ছা! আমার আর অভ্র ভাইয়ার
সংসারকে কি নামে আখ্যায়িত করবো? ‘আমার সংসার’ নাকি ‘জোড়া চড়ুঁইয়ের
সংসার’? সংসারের কি নাম হয় কখনো? হলে ভালো হয়। একেকজনের
সংসারকে একেক নামে চেনা যাবে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন সংসারের নাম!
বেশ ভালো লাগলো ব্যাপারটা।

রুমে এসে দেখি রুমটা পর্দা দিয়ে অন্ধকার করে ঢাকা। মাথার উপর ফ্যানের
ভনভন শব্দ কেমন ছন্দ ছড়াচ্ছিলো। অভ্র ভাইয়া আগের মতোই ঘুমে মগ্ন। হঠাৎ
করেই বলে উঠলেন, ‘এসেছিস তুই? কখন থেকে অপেক্ষা করছি!’
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘কেন? কেন অপেক্ষা করছিলেন আপনি?’
অভ্র ভাইয়া নড়েচড়ে বললেন, ‘আমার চুলগুলো টেনে দে। নইলে থাপড়িয়ে দাঁত
ফালাবো!’

তুমিময় অসুখ সিজন ২ পর্ব ১

ওনার হুমকিতে আমি ভয় পেলাম না। অন্ধকারে ওনার মুখ দেখা যাচ্ছেনা। চোখ
বন্ধ নাকি খোলা সেটাও বুঝতে পারছি না। সুইচবোর্ডের দিকে এগোতেই ওনার
রাগী গলা শুনতে পেলাম। বলছেন, ‘থাপ্পড় খাওয়ার শখ না থাকলে এক্ষুনি এদিকে
আয়। তোর হাত নাকি অনেক নরম? দেখি আজ, এই নরম হাত দিয়ে চুল টেনে
দিলে আরাম লাগে কিনা। এদিকে আয়, রাইট নাও!’

👉””তোমার রব যদি তোমাকে ইস্তেগফার করার কথা মনে করিয়ে দেন, তবে
জেনে নাও তিনি তোমাকে ক্ষমা করতে চান।”
— আলি ইবনে আবি তালিব (রা.)
সুবহান’আল্লাহ

তুমিময় অসুখ সিজন ২ পর্ব ৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.