তুমি আসবে বলে পর্ব ৩৬
নুসাইবা ইভানা
আজকের সূর্য অস্তের মতোই আরহার জীবনে থেকে অস্ত নিলো সমস্ত ঝড়ঝাপটা। আকাশে অর্ধ চন্দ্রের আলো হাজারো নক্ষত্রের মেলা। তার মধ্যে উৎসব মুখর পরিবেশ। আরহার কল্পনার বাহিরে ছিলো এই আয়োজন। কথায় আছে একটু সুখের জন্য অনেক গুলো খারাপ সময় পার করে আসতে হয়।সুখ আসবেই তবে ধৈর্য ধরে খারাপ সময়টা পার করতে হবে। দুঃখ একটা দীর্ঘ রাতের ন্যয়! তা যতই দীর্ঘ হোক না কেনো, সব অন্ধকার দূর করে একদিন নতুন দিনের আলো ফুটে উঠবেই। চারদিকে সবাই আনন্দ করছে, আরহার কথা জানতে পেরে গ্রামের সাবাই মিলে ছোট একটা আয়োজন করেছে।অতীতের সব গ্লানি মুছে নতুন ভাবে শুরু হচ্ছে জীবন। গ্রামের কয়েকজন মেয়েরা নাচছে গ্রাম্য গানের তালে, একপাশে মাদুরে বসে আছে আরহা আর মেঘ।
যদিও মেঘের এসব বিরক্ত লাগছে, তবুও আরহার মুখের অমায়িক হাসির জন্য নিজেও হাসি খুশি থাকছে। এরমধ্যেই শিউলি বললো, আরহা আমাদের গান শোনাবে গানের তালে আমরা নাচবো। সবাই এক সাথে আরহাকে গান গাইতে বললো।আরহা মানা করতে পারলো না।
মেঘের কানে মুখে বললো, শুনুন আমি যখন গাইবো তখন আপনি আমার দিকে তাকাবেন না।
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– বললেই হলো তাকাবো না। আমি তো তাকিয়েই থাকবো, তাকিয়েই থাকবো।
– তাহলে আমি গাইবো না
– যখন হাজার হাজর মানুষ তাকিয়ে থাকে তখন সমস্যা হয় না।
– না হয় না হাজার হাজর মানুষ আর আপনি কি এক হলেন!
– কেনো আমি কি এলিয়েন!
– আরে আপনি তাকালে আমার লজ্জা লাগবে তো বুঝেননা কেনো।
– তাহলে তো ভালো ভাবে তাকাবো তোমার লজ্জা রাঙা মুখ দেখতে।
– সেদিন তো আসলেন না।
– আসতাম তবে একটা ইম্পরট্যান্ট কাজে আটকে গিয়েছিলাম।
– সে যাইহোক প্লিজ আমার দিকে তাকাবেন না।
শিউলি পাশ থেকে বললো, তোরা কি এতো কথা বলছিস বল তো! সারাজীবন তো পরেই আছে কথা বলার জন্য। এবার গান ধর তো!
আরহা আর চোখে একবার মেঘের দিকে তাকালো, মেঘ সেই দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পেরে চোখ সরিয়ে নিলো।
আরহা গান গাইতে শুরু করলো…..
আইলারে নয়া দামান আসমানেরও তেরা
বিছানা বিছাইয়া দিলাম
শাইল ধানের নেরা
দামান্দ বও দামান্ত বও
দামান্দ বও দামান্দ বও
সিলেটি সুন্দরী করলো মনতো আমার চুরি,
Walking like A Boss lady
Shaking All her churi man
Know that I’am Gon’be The one to
Call you my wifey
দামান লইয়া আইলে বন্ধু
In a গরুর গাড়ি Baby
সিলেটি ফেরারি Baby
সিলেটি ফেরারি
বও দামন কওরে কথা খাওরে বাটার পান
যাইবার কথা কও যদি কা*ই*ট্টা রাখমু কান
দামান্দ বও দামান্দ বও
আইলারে নয়া দামান আসমানেরো তের
বিছানা বিছাইয়া দিলাম
শাইল দানের নেরা
দামান্দ বও দামান্দ বও
দামান্দ বও দামান্দ বও
গানের তালে তালে সবাই নাচছে। মেঘ নিচের দিকে থেকে একবারের জন্যও চোখ ফিরিয়ে আরহার দিকে তাকায়নি ।
বিষয়টা আরহা খেয়াল করেছে। গান শেষ হতেই কড়া তালিতে মুখরিত হলো চারপাশ।
আরহা চুপটি করে মেঘের পাশে এসে বসলে আলতো ভাবে নিজের হাতটা মেঘের হাতের উপর রাখলো।কোমল কন্ঠ বললো,তুমি কি রাগ করছে!
আরহার মুখে তুমি ডাক শুনে মেঘের হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো, বা’হাত দিয়ে বুকের বা’পাশ চেপে ধরলো। কেমন এক অনুভূতি, কেমন এক শীতল প্রবাহ বয়ে গেলো শরীর মন জুড়ে। যে অনূভুতি ভাষায় প্রাকাশ করার মতো না।
আরহা মেঘের আর একটু কাছাকাছি আসলো,তুমি আমার দিকে তাকালে সত্যি গাইতে পারতাম না। তবে কোন একদিন তোমার হাতে হাত রেখে,চোখে চোখ রেখে শুধু তোমার জন্য গাইবো।
মেঘ কি উত্তর দেবে আরহার কথা শুনে বেচারা শকট মনে হচ্ছে সে ভুল শুনছে। নিজেই নিজেকে চিমটি কাটলো।
আরহা এখনো সে ভাবেই মেঘের হাত ধরে আছে।
– এই তুমি এতোক্ষণ কি বললে আবার বলোতো!
– এবার আরহা ভিষণ লজ্জা পাচ্ছে।
– প্লিজ বলো না। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি আমাকে তুমি করে বলেছো।
আরহা কিছু না বলে নিজের হাত সরিয়ে নিতে চাইলো মেঘ ছাড়লো না। একজন এসে খাবার দিয়ে গেলো আজকে সবাই কলাপাতায় খাবে।
– আরহা মৃদু স্বরে বললো, কি হলো ছাড়ুন কেউ দেখলে কি ভাববে!
– যা ভাবার ভাবতে দাও! আগে তুমি করে বলো তবেই ছাড়বো।
– ছেড়ে দাও আমাকে।
-কি বলল৷ শুনতে পাইনি আবার বলো।
– ছেড়ে দাও না।
– মেঘ আরহার কানের কাছে মুখ এনে বললো তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না।
– তাহলে আর কি ধরে রাখুন খেতে হবে না।
মেঘ হাত ছেড়ে দিলো।
দু’জনেই খাবার খেয়ে নিলো। খাবার শেষ করে আরহা বললো, আমরা কিন্তু সকাল সকাল বের হব, আমার জন্য কতকিছু ঘটে গেলো। আপুই কতটা কষ্ট পেলো আমার একদম উচিৎ হয়নি এভাবে না বলে আসা।
-সেটা এখন বুঝতে পারলে বিবিজান! তোমার একটা ভুলে কতগুলো মানুষ কষ্ট পেলো। এরজন্যই বড়রা বলে ভাবিয়া করিয় কাজ!করিয়া ভাবিও না। যা করেছে তা আর বদলাতে পারবেনা।
– বিশ্বাস করুন এই মানুষগুলো ছোট বেলায় আমার সাথে যা ব্যবহার করেছে তাই ভয়ে আমি আপুইকে নিয়ে আসিনি যদি এবারও কিছু করে। যানেন এখনোও সেদিন রাতের কথা মনে পরলে ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যায়। মনে হয় আঘাত গুলো এখনো লেগে আছে। কথা বলতে বলতে আরহার গলা ধরে আসছে।
মেঘ আরহার হাতের উপর হাত রেখে বলে, বিবিজান সেসব এখন অতীত, আর অতীতকে মনে রেখে বর্তমানকে নষ্ট করা যাবে না। আর এনিয়ে কিছু বলবানা। ওই যে দূর আকাশে অর্ধ চন্দ্র দেখতে পারছো, সেও কিন্তু পূর্ণ হয়!তবে মজার বিষয় হলো আবার পূর্ন থেকে শূন্য হয়ে যায়। ঠিক মানুষের জীবনেো এমন সময় আসে অনেক চড়াই-উতরাই পার করতে হয়। তাই বলে,সব শেষ!
যেখান থেকে শেষ সেখখান থেকেই নতুন করে শুরু করতে হয়।খরাপ থাকা ভালো থাকাটা আমাদের হাতেই থাকে, শুধু ভাগ্যটা উপর থেকে নির্ধারিত। আমরা পরিস্থিতি মেনে নিয়ে ভালো থাকতে পারি।আজ যে পাশে আছে কাল সে নাও থাকতে পারে! তাই বলে জীবন তো থেমে থাকবে না।সে তো নিজ গতিতে চলতে থাকবে। আরহা মেঘের কাঁধে মাথা রাখলো, এতোক্ষণে সবাই ঘরে চলে গেছে। খোলা আকাশের নিচে, প্রেয়সীর মাথা কাঁধে নিয়ে অর্ধ চন্দ্র উপভোগ করছে এক যুবক।
মেঘ কথা থামিয়ে দিয়ে আরহাকে নিজের সাথে আগলে নিলো।
আরহার কপালে আসা ছোট চুল গুলো আলতো হাতে কানের পিছনে গুঁজে দিলো। ভালোবাসার অনূভুতি বরাবরি মধুর,আরহা চোখ বন্ধ করে মুহূর্তটাকে অনুভব করছে। মেঘ প্রেমময় কন্ঠে বললো,বাকিটা জীবন তোমাকে এভাবেই আগলে রাখতে চাই!তোমার জীবনের প্রতিটা দিন ভালোবাসাময় করে দিতে চাই! শুধু তুমি আমার পাশে থেকে সুযোগ দিয়ো আমাকে, তোমায় আগলে রাখার, তোমায় ভালোবাসার!
আরহা এতো গভীর কথার কোন প্রতিত্তোর করলোনা বরং নীরবে উত্তর দিলো।আর একটু মিশে গেলো মেঘের সাথে। এ যেনো না বলেও বলে দেওয়া হাজার কথা। মেঘ পরম আনন্দে আগলে নিলো আরহাকে। আজকের খোলা আকাশ, দূর আকশের চাঁদ, তারা আশে পাশের গাছপালা, আর নিশাচর পাখি যেনো সাক্ষী হয়ে রইলো এই ভালোবাসার। মেঘ আরহার কপালে আলতো করে ভারোবাসার পরশ এঁকে দিলো।
আরহার ইচ্ছে করছে এভাবেই জীবন পার করে দিতে, জীবনে এতো সুখ তার কঁপালে লেখাছিলো!আরহার খুব ইচ্ছে করছে মেঘকে একটু ভালোবাসতে! তবে তার লজ্জারা তাকে বাঁধা দিচ্ছে। খানিকক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে মেঘের যে হাতটা আরহাকে আগলে রেখেছে সেই হাতেই আরহার উষ্ণ ঠোঁটের পরশ এঁকে দিলো। কিছু মূহুর্তে জন্য দুজনেই হারিয়ে গেলো। মনে হচ্ছে সময়টা এখানেই থমকে যাক। মেঘ মোটেই প্রস্তুত ছিলো না।তার ধারনার বাহিরে ছিলো।
একজনের ঠোঁট হাতে তো একজনের ঠোঁট কপালে। ভালোবাসা বুঝি সত্যি সুন্দর।
একজন দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো আলতো হাতে নিজের চোখের জলটুকু মুজে নিলো প্রান্ত। বুকের বাম পাশে চিন চিন ব্যথা অনুভব করছে সে কি এক তীব্র ব্যথা। নিজের ভালোবাসার মানুষটা অন্য কাউকে ভালোবাসছে। সেখানেই হাঁটু মুড়ে বসে পরলো প্রান্ত। মৃদু স্বরে বললো, তোমাকে শুধু এভাবে ভালো থাকতে দেখতে চাই! আমার না হও তবুও ভালো থাকো।
রাতের আধার কেটে যেয়ে নতুন ভোরের আলো পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি, সকালের শীতল বাতাসে ঘুম উবে গেলো আরহার। নিজেকে মেঘের বাহুতে আবদ্ধ দেখতে পেয়ে ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো মিষ্টি হাসি।ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভালোবাসার মনুষটির দিকে। মেঘের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে পরে আছে। আরহা মেঘের চুলগুলো নিয়ে খেলা করছে।
সাবু এসে বললো, তোমরা ঘরে আহো, এহন সবাই কামে যাইবো।
মেঘ আর আরহা উঠে পরলো, দু’জনের মন আজ প্রফুল্ল।
নাস্তা করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলো।
ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে গেলো
তুমি আসবে বলে পর্ব ৩৫
নীলু অপেক্ষায় আছে আরহার ফিরে আসার,ইমতিহান সোফায় বসে আপলে খাচ্ছে আর নীলুর এক্সাইটমেন্ট দেখছে। মনে মনে ভাবছে কে বলবে, এরা দু’জন আপন বোন নয়।
কলিং বেলের আওয়াজ শুনেই নীলু দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। তবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে মুহূর্তেই নীলুর হাসি খুশি মুখটা চুপসে গেলো।