তুমি আসবে বলে পর্ব ৪০
নুসাইবা ইভানা
অল্পের জন্য বড় একটা দূর্ঘটনার কবল থেকে বেঁচে ফিরেছে মেঘ,আরহা। মেঘ আরহার মাথাটা নিজের বুকে চেঁপে রেখেছে। কিছু সময় পূর্বের কথা ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠছে।
আরহা বললো,ছাড়ুন কখন থেকে ধরে রেখেছেন। ছাড়বো না। একটুর জন্য তোমাকে হারাতে বসেছিলাম
– সব দোষ আপনার মাঝ রাস্তায় গাড়িতে বসে বউয়ের চোখের পানি মুছে দিতে হবে!
– মাঝ রাস্তায় গাড়িতে বসে বউয়ের কাঁদতে কেনো হবে!
আরহা মুখ ঘুরিয়ে বলে,বাস ড্রাইভার নেহাৎ ভালো মানুষ তাই বেঁচে আছেন। না হলে এতোক্ষণ পগার পাড়।
-তোমার মতো সেলিব্রিটি গাড়িতে আছে তো তাই বাস ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে।
– একদম মজা করবেন তারা জানবে কি ভাবে। লোকটা সত্যি ভালো।
– হুম পৃথিবীতে ভালো মানুষ এখনো বেঁচে আছে তাই তো পৃথিবী এতো সুন্দর।
– ঠিক বলছেন
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-আর-একবার আপনি করে বললে গাড়ি থেকে বের করে দেবো।
– আরে তুমি এতো রেগে যাচ্ছ কেনো। এবার তাড়াতাড়ি চলো। তোমার ফ্রেন্ডের বাবা,মা কেমন মানুষ কে জানে। আপুই একাকী ফিল করবে।
– নিজের বাবার চিন্তা করো আগে পরে সব দেখা যাবে।
– আরহা মন খারাপ করে বলে আমার বাবা।
– সরি বিবিজান কষ্ট দিতে চাইনি। আমি বলতে চেয়েছি হতেই পারে তোমার বাবা এখনো বেঁচে আছে। আমরা কোন ভাবে খুঁজে দেখবো যদি পেয়ে যাই।
– সে সব পরে হবে এখন চলুন তো।
– ভুলে যাচ্ছ কেনো তোমাকে একজন আপন মানুষের সাথে দেখা করাবো। ড্রাইভ করতে করতে বলে মেঘ।
– কখন থেকে একি কথা বলে যাচ্ছেন আর কত সময় লাগবে তাড়াতাড়ি করুন। আমিও দেখতে চাই আমার আপন মানুষটি কে?
– আর পাঁচ মিনিট তারপরেই পৌঁছে যাবো।
ইশতিয়াক সাহেব নিজের সব জিনিস পত্র গুছিয়ে নিচ্ছেন এখানে আর থাকবেন না। তিনি ঠিক করছেন সিলেটেই কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন।
মেঘ গাড়ি থামিয়ে আরহার চোখ বেঁধে দিয়ে বলে, চোখ বন্ধ রেখে আমার উপর ভরসা করতে পারবে তো?
আরহা মাথা নাড়িয়া সম্মতি জানালো।
মেঘ আরহার হাত ধরে সামনে এগিয়ে আসলো, ইশতিয়াক সাহেব সবে নিচে এসেছেন ব্যাগ পত্র নিয়ে। মেঘকে দেখেই বলে তুমি এখানে।
– আমি কি তোমার কাছে আসতে পারিনা বাবা।
ইশতিয়াক সাহেব বলল, তুমি তো একা আসোনি।
– হুম একা আসিনি আজ আপনার বেঁচে থাকার উৎস কেও নিয়ে এসেছি।
– তুমি কেনো এটা করলে, আমার এই মুখ আমি দেখাতে চাইনা। এই চেহারা যে অভিশপ্ত।
– এভাবে কেনো বলছেন বাবা।আপনার মেয়ে জন্মের পর থেকে আপনার চেহারা দেখনি। আজ পর্যন্ত কাউকে বাবা বলে ডাকতে পারেনি।
আরহা আর চোখ বেঁধে রাখতে পারলোনা। হাতের সাহায্যে চোখের সামনে থেকে কাপড় সরিয়ে দিতেই, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের কোন বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরছে।
মেঘ সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো।দীর্ঘ আঠারো বছর পর বাবা মেয়ে মুখোমুখি।
আরহা হাত বাড়িয়ে ছুয়ে দিলো ইশতিয়াক সাহেবকে। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো সত্যি আপনি আমার বাবা!
ইশতিয়াক সাহেব মেয়েকে এতো কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, হ্যাঁ মা,আমি তোর হতভাগা বাবা।
দু’জনেই কেঁদে কেঁদে নিজেদের মনের বাব প্রকাশ করছে।
প্রায় পঁচিশ মিনট পর মেঘ বললো, এখানে কি কান্নার প্রতিযোগিতা চলছে?
আরহা আর ইশতিয়াক সাহেব হেসে ফেললেন।
মেঘ বললো, বাবা এবার তো আমাদের যেতে হবে। ওদিকে ইমতিহান হয়তো অপেক্ষা করছে।
ইশতিয়াক সাহেব বললেন তবে চলো আমিও তোমাদের সাথে যাবো।
তিনজন রওনা হলো নূরদের বাসায়।
ইমতিহানের মা বললো, এই মেয়ে তোমার সাহস কি করে হলো আমার ছেলের গলা চেপে ধরার!
নীলু মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হোসনেয়ারা বেগম নীলুর হাত ধরে বলে এবার থেকে কোন অন্যায় করল৷ দু’জন মিলে গলা টি*পে দেবো।
নীলু এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। হোসনেয়ারা বেগম বললেন এতো বিস্মিত হতে হবে না। আমি তোমার শাশুড়ি ড,ট,কম “মা”। তাই এখন থেকে তুমি আমার ছেলের বউ প্লাস মেয়ে। নীলু কেঁদে ফেললো। হোসনেয়ারা বেগম বললেন এই বোকা মেয়ে এতো আনন্দের দিনে কাঁদতছো কেনো। আজ থেকে কোন কান্না কাটি নয়!
আরহা এসে দেখে নীলু কাঁদছে, একছুটে নীলুর কাছে এসে বলে, কি হয়েছে আপুই! তুমি কাঁদছো কেনো তোমাকে কে কি বলেছে আমাকে বলো?
ইমরান সাহেব (ইমতিহানের বাবা)আশ্চর্য দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে এটা কি করে হতে পারে একজন মানুষের সাথে এতো মিল সেই ঊনিশ বছর আগের কথা মনে পরে গেলো, সেই চোখ সেই নাক। তার বিষ্ময় আর একটু বাড়িয়ে দিতে ইশতিয়াক সাহেব পেছন থেকে আস্তে করে বললেন নিজের রক্ত তো তাই পরিচিত মনে হচ্ছে!
এতো বছর পর পরিচিত কন্ঠ শুনতে পেয়ে পিছু ফিরে বললেন ইশতিয়াক তুই!
সবার দৃষ্টি তখন ইশতিয়াক সাহেবর দিকে নিবদ্ধ। ইমরান সাহেব এগিয়ে এসে ভাইকে জরিয়ে ধরতে চাইলে।ইশতিয়াক সাহেব সরে দাঁড়ালেন। কড়া কন্ঠ বললেন, তোর মত ভাই আমার প্রয়োজন নেই। যে নিজের স্বার্থে নিজের বোনের জামাইকে ভাই পরিচয় দিতে পারে সে আমার কেউ না। আমি এখানে আমার মেয়ের জন্য এসেছি।
ইনতেহা বেগম ছুটে এসে ইশতিয়াক সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ভাইয়া তুমি বেঁচে আছো?
ইশতিয়াক সাহেব ইনতেহা বেগমকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, আপনারা ভুল করছেন। আপনি যেই ইশতিয়াককে চেনেন সে আরো ২৪ বছর আগেই মা*রা গেছে। এখন যে বেঁচে আছে সে এক অসহায় ইশতিয়াক যার একমাত্র সহায়তা তার মেয়ে।
এদিকে সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে তারা কেউ বুঝতে পারছে না।
নূর ইমতিহানকে বললো তুমি আমার মামাতো ভাই এটা আগে জানতে?
– আরে না। এসবের কিছুই তো বুঝে আসছে না। কি হচ্ছে এসব?
মেঘ এগিয়ে এসে বলে, বাবা তুমি আমাদের বুঝিয়ে বলো এসব কি হচ্ছে?
– এসব শুনে কোন লাভ নেই বাবা।তারচেয়ে আমরা যে কাজের জন্য এসেছি সেটাই শেষ করি!
– তোমাকে জোড় করবো না। তবে জানার আগ্রহ আছে। তুমি না বলতে চাইলে জোড় করবো না।
ইশতিয়াক সাহেব সোফায় বসলেন তারপর বলা শুরু করলেন, শারমিনকে আমি নিজ পছন্দ বিয়ে করি। তাই বাবা,আমাকে আর শারমিনকে বাসা থেকে বের করে দেন। তখন তোমার বাবা আর আমি মিলে ব্যবসা. শুরু করি। এরপর এভাবেই আমাদের দিন কাটতে থাকে। কিন্তু আমার জ*ঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হওয়া সব শেষ করে দেয়। আমার জেল হয়। আর তোমার বাবা মা দেশ ছাড়া হন।
এমন সময় আমার অসহায় স্ত্রী গর্ভাবস্থায় আমার পরিবারে কাছে সাহায্য চাইলে তারা তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়ে। জেল থেকে বের হতে হতে আমার সব ততদিনে শেষ। খবর নিয়ে জানতে পারি সম্পত্তির লোভে আমার বড় ভাই আমার ছোট বোনের হ্যাসবেন্ডকে নিজের ভাই বলে পরিচয় দেয়। এরা মানুষ না। তাই এদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
ইনতিহা বেগম ভাইয়ের পায়ের কাছে বসে বলে, আমাদের ভুল হয়েছে ভাইয়া আমাদের ক্ষমা করে দাও। তবে আরো একটা সত্যি কথা যেটা তুমি জানোনা। বাবা কিন্তু মা*রা যাওয়ার আগে অনেক খোঁজ করেছিলো ভাবির। কিন্তু পায়নি।
ইমতিহান আর আরহা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। ইনতিহা বেগম উঠে এসে আরহাকে জড়িয়ে ধরলেন এতো কাছে থেকেও আমি চিনতে পারলাম না। আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। ইমরান সাহেবও আরহার কাছে ক্ষমা চাইছেন। আরহা উভয়ের হাত ধরে তার বাবার পাশে নিয়ে গেলো, বাবার পাশে বসে বলে, বাবা আমি সব ভুলে যেতে চাই! যা হারিয়েছি তা হয়তো ফিরে পাবোনা। তবে যা পেয়েছি তা হারাতে চাইছি না।
ইশতিয়াক সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। উঠে এসে নিজের ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন।
মেঘ দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে আর ভাবছে, আজ বাবা,মা বেঁচে থাকলে কত ভালো হতো। এমন সময় নীলু মেঘের হাত ধরে বলে,মন খারপ করছো কেনো ভাইয়া তোমার আমি আছি তো এই ছোট বোন থাকতে তোমার আর কি চাই।
মান অভিমানের পালা শেষ করে সবাই মিলে বিয়ের ডেট ফিক্সড করলেন। আগমী ১৮ তারিখে বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে।
তুমি আসবে বলে পর্ব ৩৯
নূর বললো,আজ ১০ তারিখ হাতে বেশি সময় নেই বহুত কাজ করতে হবে।
ইমতিহান বলে তোর আবার কিসের কাজ রে।
– শপিং করা,পার্লারে যাওয়া, মেহেদী দেওয়া, তোমাদের বউকেে পাহারা দেওয়া।নাচ প্রাকটিস করা। আরো কত কি।
– সেটাই আমি ভাবলাম তুই না জানি কি রাজকার্য উদ্ধার করবি।