তুমি আসবে বলে পর্ব ৫
নুসাইবা ইভানা
আরহার মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন যার কোনটার উত্তর এ মূহুর্তে জানা নেই আরহার। হাতে থাকা তার বাব,মা, মিসেস মারিয়া, মোর্শেদ আফরোজ, ও আট/নয় বছরের ছেলের ছবি। সেটিকে ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে নিলো। আরহা নিজের বাবা, মায়ের ছবি দেখে কেঁদে দিলো। বুঝ হওয়ার পর থেকে তার বাবাকে কখনো দেখেনি।
তার মা সব সময় বলতো একদিন তোর বাবা ঠিক ফিরে আসবে। এতোদিন শুধু বাবার শূন্যতা ছিলো এখন মায়ের শূন্যতা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। মনে মনে আওড়ালো। তোমরা আমাকে কেনো একা রেখে গেলে। আমার যে বড্ড কষ্ট হয়।
নীলু এসে বলল,আপনি কাঁদছেন কেনো আপনার কি বাসার কথা মনে পরছে? বাব,মার সাথে কথা বলবেন?কি হইছে আমাকে বলতে পারেন।
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরহাকে চুপ থাকতে দেখে নীলু আবার বললো, আচ্ছা একটা কথা বলেন, আপনার বাব,মা,এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলো কেনো!না মানে আপনাকে দেখো তো মনে হয় আমার ছোট হবেন!
চোখের পানি মুছে আরহা বললো, আপনার বয়স কত?
– তওবা তওবা আপনি আমারে তুই/ তুমি করে বলবেন। আমার বয়স পনেরো। ওই যে আরেকজন মধ্য বয়সি মহিলা দেখলেন “আমি তার মেয়ে” সাহেবরা বিদেশ যাওয়ার পর থেকে আমরাই এ বাসার দেখা শুনা করি।”আপনার নাম কি বউমনি।
– আদিয়াত নুজহাত আরহা। সবাই আরহা বলেই ডাকে। আমি বয়সে আপনার ছোট। আমার বয়স তেরো।
নীলু আরহার পাশে বসে বলে,তেরো বছর বয়সে তুমি এই এত্তো বড় বাড়ির বউ হয়ে গেলে।আচ্ছা তুমি পড়া লেখা করো না!
– পড়তাম তো ক্লাস সেভেনে।
– আমি নাইনে পড়ি। সই হবে আমার।
আরহার উত্তর দেয়ার আগেই নীলুর মা এসে বলে, শুরু করে দিয়েছিস তোর বকবক। যা রান্নাঘর থেকে বউমার খাবার নিয়ে আয়। আমি বউমাকে নিয়ে উপরে যাচ্ছি। তুই খাবার নিয়ে আয়।
সোনিয়া বেগম বারবার দরজায় উঁকি দিচ্ছেন, সেই যে হায়দার মিয়া বাসা ছেড়েছে আর ফেরার নাম নেই। প্রথমে চিন্তা না হলেও এখন ভিষণ চিন্তা হচ্ছে। মনে মনে ভাবছেন কই গেলো এতো রাইত ওইলো এহোনো ফিরা আইলোনা। সনিয়া বেগমের দুই ছেলে মেয়ে। ছেলটার বয়স সাত বছর নাম হারিছ।মেয়েটার বয়স পনেরো নাম সাবু। হারিস ঘুমিয়ে আছে। সাবু মায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,ওমা, মা বাবায় এহনো আইলোনা কেন?
– তা দিয়া তোর কি? খাইছোস এইবার ঘুমা।
হায়দার মিয়া বোনের কবরের পাশে বসে আছে। কখন কখন বিড়বিড় করে কিছু বলছে।নিজের বোনকে অনেক ভালোবাসতেন হায়দার মিয়া। তিন কূলে বোন ছাড়া আর ছিলোই বা কে? আজ বোনটাও নাই। মনের মধ্যে হাহাকার।
হসপিটালের খোলা মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ। দৃষ্টি তার আকাশের পানে।আজকের আকাশটা ঘনো কালো মেঘে ছেঁয়ে গেছে। চাঁদ তারাহীন এক বেরঙীন আকাশ। ঠিক মেঘের জীবনের মতো।
মেঘ মানতেই পারছে না হুট করে আরহা নামক ঝড় তাদের জীবনটাকে তছনছ করে দিলো সাজানো গোছানো জীবনটাকে নিমিষেই ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। ধপাস করে বসে পরলো সামনে থাকা বেঞ্জের উপর চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো কিছু ঘন্টা পূর্বের ঘটনা…..
বাসায় আসার পূর্বে মেঘ তার বাবাকে কল করে বলে,বাবা আমি ইমারজেন্সি টিকিট বুক করেছি তোমরা নিজেদের প্যাকিং করে ফেলো। আজ রাত দেড়টায় আমাদের ফ্লাইট।
– তুমি চাইলে যেতে পারো মেঘ। আমারা তোমাকে বাঁধা দেবো না। তবে তোমার মম আর আমি যাচ্ছি না কোথাও আমারা এখানোই স্থায়ী হবো।
– কোন কথার উত্তর না দিয়ে খট করে ফোনটা কেটে দিলো মেঘ।দ্রুত গতিতে ড্রাইভিং করে বাসায় এসে ভাঙচুর শুরু করে দিয়েছে। রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য প্রথমেই দেয়ালে টাঙানো ফটো ফ্রেম গুলো ছুড়ে মারলো, তারপর হাতের কাছে যা পাচ্ছে ছুড়ে মারছে।
মিসেস মারিয়া আর মোর্শেদ আফরোজ কথা বলছিলেন ভাংচুরের শব্দ শুনে দুজনেই নিচে আসেন।
মেঘে টেবিলের উপর থেকে কাঁচের জগ নিয়ে ছুড়ে মারে দূর্ভাগ্যবশত সেটি যেয়ে মিসেস মারিয়ার মাথায় আঘাত করে। সাথে সাথে মাথা ফে*টে রক্ত গড়িয়ে পরে মহূর্তে ফ্লোর ভিজে যায়। মিসেস মারিয়া চিৎকার শুনে মেঘ দ্রুত মিসেস মারিয়াকে ধরে। ততক্ষণে মিসেস মারিয়া জ্ঞান হারান।
মেঘ মিসেস মারিয়াকে কোলে করে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে কোন মতে হসপিটালে নিয়ে আসেন। এতোটুকু ভাবতেই মেঘের চোখ রক্ত বর্ণ ধারণ করলো।চোখ থেকে গড়িয়ে পরলো দু’ফোটা অশ্রু। হাতের আঙুলে চোখের জল টুকু নিয়ে টোকা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলে, প্রতি ফোটা চোখের পানি, প্রতি ফোটা রক্তের হিসেব দিতে হবে মিস আরহা।
আমার হৃদয়ে নিজের জন্য যে ঘৃণা জন্ম দিয়েছো নিজের নামে। তা যদি তোমাকে ভষ্ম করে না দেয়! তবে আমার নামও মেহের আফরোজ মেঘ না।
নিজেকে সামলে নিয়ে হসপিটালে প্রবেশ করে মেঘ।
কিছু সময় পূর্বেই জ্ঞান ফিরেছে মিসেস মারিয়ার। মোর্শেদ আফরোজ তার পাশেই তার হাত ধরে বসে আছে, চোখ খুলে অস্ফুট স্বরে বললেন, আমার মেয়ে কেমন আছে মোর্শেদ?
– আমি খোঁজ নিয়েছে আর নীলুর মাকেও বলেছি আরহা মায়ের যত্ন নিতে। তুমি টেনশন করো না।
মেঘ কেবিনে ঢুকতেই তার বাবা মমের কথোপকথন শুনতে পেলো। মনে মনে ক্ষিপ্ত হলেও মুখে তা প্রকাশ না করে, নিজের মমমের পাশে বসে পরলো। দু’হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলো। মিসেস মারিয়া শান্ত স্বরে বললেন দেখো তোমার প্রতি আমার কোন রাগ নেই মেঘ!
যেটা হয়েছে এক্সিডেন্টলি হয়েছে সে খানে তোমার কোন হাত ছিলো না। আসলে আমারই তেমার প্রতি অন্যায় করেছি। তোমার মনের বিরুদ্ধে যেয়ে তোমাকে বিয়ে করিয়ে। তুমি চলে যেতে পারো তোমাকে বাঁধা দেবো না। আর কখন বলবো না আরহাকে মেনে নিতে।আরহার তোমার পরিচয়ের দরকার নেই। আরহা আমার মেয়ে এটাই আরহার বড় পরিচয়।
– মম আমাকে একটু সময় দাও নিজেকে গুছিয়ে নিতে। হুট করে জীবনে এতো কিছু হয়ে যাচ্ছে সেগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে।
নার্স এসে মিসেস মারিয়াকে ইনজেকশন পুশ করলেন। মোর্শেদ আফরোজ নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, মারিয়াকে বাসায় কবে নিয়ে যেতে পারবো?
– কাল সকালেই নিয়ে যেতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে রুগির।
মোর্শেদ আফরোজ বললেন,মেঘ তুমি বাসায় চলে যাও খেয়ে রেস্ট নাও। তোমার মমের সাথে তো আমি আছি।
মেঘ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত প্রায় বারোটা ছাড়িয়েছে। তাই বললো,ড্যাড এতো রাতে আর বাসায় ফিরবো না এখানেই থাকবো।
– এখান থেকে বাসায় যেতে সময় লাগবে পনেরো বিশ মিনিট। চলে যাও। এখানে থাকতে তোমার কষ্ট হবে।
নীলুর মা, আরহা খাবার খাইয়ে, ঔষধ খাইয়ে দিলেন। আরহাকে শুয়ে দিয়ে আরহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আরহার কিছুতেই ঘুম আসছে না। তার মন পরে আছে সেই ছবিতে।
তার বাবা মায়ের কথা মনে পরছে। নীলুর মা এখান থেকে গেলে আরহা চুপিচুপি ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকবে, কতদিন তার মায়ের মুখখানি দেখা হয় না। মায়ের কথা মনে পরতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। নীলুর মা ভাবলেন আরহা হয়তো ঘুমিয়ে পরেছে তাই তিনি আরহার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে চলে গেলেন।
মেঘ হসপিটাল থেকে বের হয়ে একটু সামনের দিকে হেঁটে আসলো রাতের ঢাকা রিক্সায় ঘুরতে নাকি অন্য রকম ভালোলাগে। ইমতিহানের কাছে অনেক শুনেছে। তাই গাড়ি না এনে রিক্সায় উঠলো। এই সময় রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা মাঝে মাঝে দূরপাল্লার বাস গুলো সা সা ছুটে চলছে। থেমে থেমে মেঘেরা গর্জন করছে শীতল বাতাস বইছে। মেঘের দারুণ লাগছে ওয়েদারটা। বৃষ্টি নামবে যে কোন সময়। রিক্সা চালক বললো, বাবা আর কত দূর মনে হয় বৃষ্টি অইবো।
তুমি আসবে বলে পর্ব ৪
– এই তো মামা সামনেন মোড় থেকে একটু সামনে।
ইতিমধ্যে বৃষ্টির ফোটা পরতে শুরু করেছে মেঘ চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে। হঠাৎ নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই চোখ মেলে তাকালো মেঘ।