তোমাতে করিবো বাস পর্ব ১৪
লেখনীতে-আফনান লারা
আসিফ বাপ্পির বরাবর সামনে বসেছে।এর আগে তাদের একসাথে বসা হয়নি।বিয়ের আগে যতবার বাপ্পির সাথে ওর দেখা হতো কেমন আছো,কি খবর ছাড়া তেমন কথা হতোনা।
বিয়ের দিন অবশ্য আসিফই বকবক করছে তটিনিকে নিয়ে।বাপ্পি বেশি বলেনি।সেদিন আর কথাও তাদের হয়নি।এখন সেই আগের দু লাইন বলার ইচ্ছাবোধ তাদের দুজনেরই ছিল না।সুতরাং নতুন কথা বলতে হবে।তবে কে আগে বলবে তাই ভাবছিল দুজন।
শেষে আসিফই বলে উঠে,’তটিনি কেমন জ্বালায়?’
‘ঠিক জানিনা ‘
‘ঠিক জানো না?জ্বালালো কিনা জানো না?’
‘তাও জানিনা।আসলে তটিনির সবই আমার ভাল লাগে তাই কোনটা জ্বালানো সেইটা বুঝতে পারিনা।’
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আসিফ মুচকি হাসে।এরপর টেবিলের উপরের পানির গ্লাসটা বাপ্পির দিকে এগিয়ে ধরে বলে,’আমি জানি তটিনি তোমায় বিরক্ত করেছে।তবে সে তোমার পরিবেশে খুব জলদি মানিয়ে নিতে পারবে।ও দারুণ একটা মেয়ে’
বাপ্পি পানি খেলোনা।গ্লাসটা অনেকক্ষণ ধরে দেখে বললো,’আচ্ছা একটা কথা জানতে পারি?’
‘কি?’
‘তুমি বিবাহিত, এ কথাটা তটিনিকে আগে কেন বললেনা?’
আসিফ মুচকি হাসে আবারও।এরপর বলে,’সেই বিরাট কাহিনী।সময় সুযোগ জায়গা দেখে একদিন বলবো নাহয়!তবে তটিনি আমায় যেরকমটা ভাবছে এখন,,, আমি কিন্তু সেরকমটা নই।পরিস্থিতির কাছে সবাইকেই হেরে যেতে হয়।আমিও হেরে গিয়েছিলাম।এখনও সেই হেরোটাই রয়ে গেলাম।
তটিনিকে যে পায়নি,সে জানে তাকে হারানো কতটা দুঃখের!!
‘তুমি রিনিকে ভালবাসো না?এটলিস্ট সে তোমার ওয়াইফ হয়!’
আসিফ কিছু না বলেই উঠে চলে যায়।কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও তা দেয়া যায়না।গলা দিয়ে সেই উত্তর আসতে আসতেই থমকে যায়।সব জবাব সব সময়ের জন্য হয়না!
রিনির সাথে বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হলেও তাদের বেশ করে কথা হয় আজকাল ধরেই।এর আগে তাদের কখনও নিবিড়ে,ঘনিষ্ঠ ভাবে কথা হয়নি।এক রুমে থাকা হয়নি,বসা হয়নি।যে বয়সে তাদের বিয়ে হয় সে বয়সে আসিফ জানতোনা বউ কাকে বলে!
চোখের সামনে চঞ্চল যে মেয়েটিকে গলা ফাটিয়ে ভাইয়া বলতে দেখতো সারা বছর,,,,সেই মেয়েটির প্রেমেই আসিফ প্রথমবার পড়েছিল।
মেয়েটিকে সে বুঝতে দেয়নি,কারণ সে জানে তার ভালবাসার অংশীদার হিসেবে অন্য একটা মানুষ গ্রামে বেড়ে উঠছে,দিন গুনছে।
তার পরেও সে এই মেয়েটির প্রেমে ডুবে গিয়েছিল।মেয়েটিকে তার বাবা মারতে আসলে সে প্রতিবার দেয়াল হয়ে দাঁড়াতো।কেয়ার করতো!দূর থেকে প্রাণভরে দেখতো।অথচ কাছে আসলেই সে এমন ভাব করতো যেন সে ওকে নিয়ে কিছুই ভাবেনা।তটিনি তাই কখনওই এটা মাথায় আনেনি যে আসিফ ভাইয়াও ওকে ওরই মতন করে ভালবাসে!!
যখন বোঝার বয়স হলো তখন আসিফ তটিনিকে নিয়ে সে ভাবনা রাবার দিয়ে মন থেকে মুছতে শুরু করলো।ভীষণ কষ্ট হতো তার এই ভেবে যে,সে যে মেয়েটাকে চাইছে তাকে সে কখনও পাবেনা!!পায় ও নি!
তার অনেক আগেই পাওয়া হয়ে গেছে অন্য কাউকে!যাকে সে কখনও চোখে চোখ রেখে দেখেনি। যার হাত ধরে কখনও সে দেখেনি,যার জন্য কখনও সে একটা ফুল আনেনি!যার নাম ধরে ডেকে ডেকে বাড়ি মাথায় করেনি সেই মেয়েটি আজ দিব্যি তার পাশের জায়গাটি দখল করে আছে।রীতিমতন তাকেও হয়ত আপন করে নিতে হবে!কিন্তু মনকে কে বোঝাবে?এতগুলো বছর ধরেও যাকে মন থেকে মোছা গেলোনা তাকে কি করে মন থেকে ভোলাবে!তটিনি যে ভোলার মতন মেয়ে না!
আসিফ রান্নাঘরে যাবার আগে যে করিডোরটা পড়ে তাতে একটা জানালা আছে বাড়ির পেছনের দিকটার জানালা।সেটাতে মাথা ঠেকিয়ে চোখের পানি ফেলছিল সে।
ঠিক সেসময়ে তটিনি লাইটার নিয়ে রান্নাঘর থেকে যাচ্ছিল,আসিফকে কাঁদতে দেখে সে থেমে যায়।আসিফের কান্নার কারণ সে ছাড়া আর কেউ নয় এটা সে বেশ বুঝতে পারছে।কিন্তু আসিফের প্রতি অগাধ ক্ষোভ তাকে আর এখানে থামিয়ে রাখতে পারেনি।সে চলে আসলো তার রুমে।
এখন কেঁদে লাভ কি?চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে!
ভালবাসার মানুষ হারালে হুশ আসে যে ঠিক কি হারাইছে।
তটিনি কবিতার পাতায় আগুন ধরাতেই যাচ্ছিল,ঐ সময়ে বাপ্পি এসে ওকে আটকিয়ে বলে,’ছোট বয়সী মেয়েদের মতন কাজ করবেনা।ওতোটাও ছোট না তুমি!’
‘যান আমার রুম ঠেকে।আমার ইচ্ছা আমি কি করবো না করবো!’
‘বইখাতাগুলো না পুড়িয়ে কেজি দরে বিক্রি করলে টাকা পাবে।সে টাকা দিয়ে চানাচুর ও খেতে পারবে’
তটিনি লাইটার ফেলে নিচে বসে গেছে এবার।বাপ্পি ভাবলো তটিনিকে হাসাবে কিন্তু ওকে এমন ভেঙ্গে পড়তে দেখে সে নিজেই দূর্বল হয়ে পড়েছে।
রিনি জামা বদলে রুম থেকে বের হতেই আসিফকে দেখে করিডোরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে।নিশ্চয় কেঁদেছিল,এটা সে বেশ বুঝতে পারছে।আর কান্নাটা যে তটিনির জন্য এটাও সে জানে।কিছু বলবে নাকি বলবেনা,বললেও কেমন রিয়েক্ট করবে তা ভেবে রিনি আর আগায়নি।কিন্তু লোকটা সম্পর্কে তার স্বামীই হয়।দরদ লাগছে বলে টিস্যুর বক্সটা এনে পাশে ধরলো সে।আসিফ মুখ ফুলিয়ে চলে গেছে কোনো কথা না বলে।যেন সে রিনিকে দেখেইনি।রিনি ও পিছু পিছু আসতেই,,ওর মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো আসিফ।মানে সে একা থাকতে চায়।
রিনি আর কি করবে সোজা তটিনির কাছের দিকে গেলো।
তটিনির রুমের কাছে এসে দেখে দরজা খোলা।সে ওমনি মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো বাপ্পি তটিনির দিকে করুণ চোখে চেয়ে আছে আর তটিনি বাচ্চাদের মতন কাঁদছে নিচে বসে বসে।
রিনি মনে মনে বললো,’দুই হাগলে অজ্ঞার লাই অজ্ঞা কান্দে,হাঁকে দি আঁই আর এই বেডা ফাঁইসা গেছি’🐸
[দুই পাগলে একজনে আরেকজনের জন্য কাঁদে।ফাঁকে দিয়ে আমি আর এই লোকটা ফেঁসে গেছি’]
রিনি মুখ বাঁকিয়ে দরজাটা টেনে দিয়ে চলে গেলো।ওকে তটিনি আর বাপ্পি কেউওই দেখেনি।
রিনি এবার তটিনিদের বাসার পেছনে এসে আসিফের রুমের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।আসিফ নিচে বসে বসে চোখ মুছছে ঠিক তেমন করে যেমনটা তটিনি করছিল।রিনি এক দৃষ্টিতে বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওকে দেখে বললো,”কাঁদাকাডি শেষ অইলে কইয়েন,বাপ্পি ভাই আর তটিনি বইনের লাই নাস্তা বানাইছি,আন্নে সহ খাইয়েন’
আসিফ ভূত দেখার মতন চমকে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে জানালার গ্রিল ধরে রিনি দাঁড়িয়ে আছে।আসিফ বিরক্ত হয়ে কাছে এসে জানালা আটকে দিলো এবার।রিনি জানালার ওপার থেকে বললো,’আন্নেরে কাঁদাকাডি করতে তো আঁই দেই হালাইছি।অন আর জানালা বন্ধ করি লাভ আছেনি?’
আসিফ আরও রেগে গেছে কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা।রাগটা ভেতরে ভেতরে পুষে রেখে চুপ করে থাকলো।
তটিনির কান্না থেমেছে।জিনিসপত্র গুলো যেভাবে আছে সেভাবে রেখেই সে উঠে পড়ে।বাপ্পি তখনও চুপ করে ছিল।সে কিছু করলে তটিনি না জানি ক্ষেপে যায় সে ভয়ে সে কিছুই করছেনা,তটিনি রোবটের মতন এক জায়গায় দাঁড়িয়েই ছিল,সেসময় বাপ্পির ফোনে ওর বড় বোন বকুলের কল আসে।তাই সে রিসিভ করে বাহিরে চলে আসলো।
‘কিরে বাপি??আর কতক্ষণ লাগবে তোদের?বাড়িতে সবাই নতুন বউকে দেখার জন্য ড্রয়িং রুম ভর্তি মানুষ এসে বসে আছে অথচ তোরা সামান্য জামাকাপড় নিতে গিয়ে এখনও আসছিস না।আসতেও তো দু ঘন্টার মতন লেগে যাবে,সেটা জানিস?’
‘হ্যাঁ আমরা সিএনজির অপেক্ষা করছি আপু।এখনই রওনা হবো’
বাপ্পি জলদি ফোন রেখে পেছনে ফিরতেই দেখে তটিনি তার হাতে জামাকাপড়ের ব্যাগ নিয়ে সোজা হাঁটা ধরেছে।বাপ্পিকে আর কিছু বলতে হয়নি।যাবার আগে তারা রিনিকে বলে চলে এসেছে।তটিনি কোনো কথাই বলেনি,শুধু বাপ্পি বলেছে তারা যাচ্ছে।
আসিফ কারোর কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছেনা বলে মুখ ধুয়ে এসে রুমের দরজা খোলে।খুলতেই দেখলো ওপারে রিনি হাতে কমলার প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,যেন এতক্ষণ দরজা খোলার অপেক্ষাতে ছিল।আসিফ কিছু না বলে ওর পাশ কাটিয়ে করিডোর দিয়ে সামনের দিকে গেলো।রিনি ওর পিছু পিছু আসতে আসতে বললো,’কমলা খাইবেন্নি?এইন্না মিডা!!!
[কমলা খাবেন?এত মিষ্টি!’
‘তুই খা’
‘আই তিনগা খাইছি।আন্নে অজ্ঞা খান।এতাগো কমলা মিডা’
[আমি তিনটা খেয়েছি।আপনি একটা খান।এনাদের কমলা মিষ্টি’
আসিফ তটিনির রুম খালি দেখে জানতে চাইলো ওরা কোথায়।
রিনি জানালো ওরা চলে গেছে।আসিফ স্বস্তির দম ফেললো তখন।সে চায়নি আর তটিনির মুখোমুখি হতে।ভালই হয়েছে ওরা না বলে চলে গেছে।নাহলে কষ্টটা আরও গাঢ় হতো।
আসিফ মুখে হাসি ফুটিয়ে পেছনে ফিরতেই রিনি কমলার প্লেট উপরে তুলে বললো,’কমলা খাইলে মাতা ঠাণ্ডা অয়।ইক্কিনি খান’
তোমাতে করিবো বাস পর্ব ১৩
[কমলা খেলে মাথা ঠাণ্ডা হয়।একটুখানি খান]