তোমাতে করিবো বাস - golpo bazar

তোমাতে করিবো বাস পর্ব ১৬

তোমাতে করিবো বাস

তোমাতে করিবো বাস পর্ব ১৬
লেখনীতে-আফনান লারা

ঘোমটার পর্ব শেষ।তটিনি এবার ঘোমটা ছাড়াই ঘুরতে ফিরতে পারবে।সেটা মনে করে সে স্বস্তি পেলো।বাড়িতে এত এত মেহমান যে রুম থেকে বের হওয়ার ইচ্ছাটাই চলে গেছে তটিনির।এদিকে রুমে বসে বসে বাপ্পির মিষ্টি হাসি দেখতেও তার বিরক্তি আসছে।
‘ছেলেটা এমন হাসছে কি জন্যে?কি সমস্যা? এত ঝাড়ি দিই দিনে রাতে তারপরেও দাঁত কেলানো হাসি তার আসে কই থেকে?আজব!

তটিনি চোখ রাঙাচ্ছে দেখে বাপ্পি মাথা নামিয়ে ল্যাপটপটা টেনে কাছে নিয়ে আসে,এরপর নিজের কাজে মন দিয়ে ফেললো।বাপ্পি অন্যমনস্ক হয়েছে বলে তটিনি বিছানা ছেড়ে নামলো। পুরো রুমে একবার পায়চারি করে এরপর সে দরজাটা ধীরে খুলে বাহিরে উঁকি দেয় সে।এই বাড়ির মানুষদের আচার আচরণ স্বাভাবিক একটা পরিবারের নিয়মকানুন থেকে একটু ভিন্ন।

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বিয়েতে এত নিয়ম তো সাধারণ পরিবারদের হতে সে দেখেনি।এরা যেন নতুন নতুন নিয়ম বানিয়ে বিষয়টাকে কঠিন করে তুলছে।বাপ্পির রুমের সামনেই একটা ভেসিন আর আয়না এটাচসড্।সোজা দেয়ালের উপর আয়না লাগানো,তার নিচে ভেসিন।অর্থাৎ দরজা খুললেই বাহিরের কারোর মুখোমুখি পড়তে হবেনা।
শাড়ীর কুচিগুলোকে এক হাতে আঁটসাঁট করে ধরে তটিনি রুম থেকে বের হয়।আয়নাতে একবার নিজের দিকে তাকায় তার আগে,,,, সব ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য।

ঠিক নেই।লিপস্টিক লেপটে গেছে, এই জন্যই বুঝি বাপ্পি মিটমিট করে হাসছিল তখন থেকে।
‘লিপস্টিক লেপটালো কেন!ওহ হো!চা বিসকিট খেয়েছিলাম সে জন্য হয়ত।’
শাড়ীর কুচি ছেড়ে আঁচল টেনে ঠোঁটটা মুছে নিলো তটিনি এরপর সামনে হাঁটা ধরলো আবার।

বাপ্পির রুমের থেকে বের হলেই ডাইনিং রুমটা পড়ে।সেখানে তখন কেউ ছিল না বলতে একটা চার পাঁচ বছরের ছোট্ট বাচ্চা চেয়ারে বসে দই খাচ্ছিল চামচ দিয়ে।তটিনি ওকে এড়িয়ে অন্য রুমগুলো দেখতে গেলো।এরপরে ডানের রুমটা হচ্ছে বাপ্পির বাবা মায়ের।বামের রুম দাদা দাদির।আর কর্নারেরটাতে আপাতত বকুল আপু আর বুনি থাকছে।ওটা আসলে বুনির রুম।তটিনি বাপ্পির মায়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখতে যেতেই তাদের চোখে পড়ে গেলো।ওখানে ছিল বাপ্পির ফুফু আর ওর মা,দাদি।ওনারা তটিনিকে দেখে হাসিমুখে ভেতরে আসতে বললেন।

তটিনি মনের ভয়টাকে এক পাশ করে ওদের কথায় ভেতরে ঢুকলো।বাপ্পির মা হেসে ফুফুর হাত চেপে বললেন,’দেখলে কেমন লম্বা বউ এনেছি?’
ফুফু হাসি দিয়ে বললেন,’এরকম লম্বাই ঠিক আছে।বেশি লম্বা আবার তালগাছ মনে হয়।আমাদের সীমান্তর বউকে দেখছিলা?ওর বউ তো ওর থেকেও লম্বা’

এই নিয়ে সকলে হাসি শুরু করে দিলেন।তটিনি মনে মনে ভাবছে সামান্য এ কথায় এত জোরে খিক খিক করে হাসার কি আছে!তার তো বিন্দু পরিমাণ ও হাসি আসছেনা।ওনারা এবার সীমান্ত আর তার বউকে রেখে সীমান্তর অবিবাহিত বড় বোন যার বয়স ছাব্বিশ পার হয়ে গেছে,সে এখনও অবিবাহিত কেন সেটা নিয়ে গল্প শুরু করে দিছেন।

তটিনি নিজেকে অতিরিক্ত ব্যাক্তি ভেবে টুপ করে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।ডাইনিংয়ের সেই ছোট বাচ্চাটি তখনও চামচ কেটে কেটে দই খেয়ে যাচ্ছিল আর তটিনিকে দেখে যাচ্ছিল।তটিনির গায়ের রঙের শাড়ীটা আর ঐ বাচ্চাটির মায়ের শাড়ীটা রঙের দিক দিয়ে একি রকম বলে সে বারবার করে তটিনিকে দেখছিল।

তটিনি এবার বুনির রুমের দিকে চললো।সেখানে ছিল বাপ্পির মামাতো বোন আর ভাই।ওরা বসে বসে ফোন টিপছিল।দুজনেই বয়সে তটিনির কাছাকাছি বয়সী।ওরা তটিনি দেখে সালাম দিয়ে ফোন রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে।তটিনি ওদের ব্যস্ত হতে না বলে ঠিক আছে বলে চলে আসলো ওখান থেকে।
এখানে সবাই নতুন বউ বরকে ঘিরে আসলেও কেউই নতুন বর বউকে খুঁজেনা আর,কথাও বলতে চায়না।যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

আর কি করবে ভেবে তটিনি আবারও বাপ্পির রুমে ফিরে এসেছে।এসে দেখে বাপ্পি নেই।ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ আসছিল বলে ওখানে বাপ্পি আছে ভেবে তটিনি বাপ্পির ল্যাপটপটা দেখতে দেখতে ডিভানে বসে যায়।কাজের হিজিবিজি কিছু প্রোজেক্ট দেখে তটিনি আর হাত লাগায়নি।এসবে হাত লাগলে যদি ডিলেট হয়ে যায়।!

সেসময় বাপ্পি বের হয় ওয়াশরুম থেকে।গায়ের পাঞ্জাবি বদলে সে একটা সাধারণ টিশার্ট পরে এসেছে।তটিনিকে ডিভানে দেখে সে বিছানায় এসে বসলো।তটিনি ব্রু কুঁচকে বলে,’আপনি তখন দেখছিলেন আমার লিপস্টিক লেপটে গেছে তার পরেও আপনি বললেন না কেন?উল্টে হাসছিলেন!’
‘বলিনি কারণ তুমি হয়ত ভাববে আমি তোমার ঠোঁটের প্রতি আকর্ষিত বলে তাকিয়েছিলাম।তুমি তো আবার উল্টো বোঝার মানুষ’

‘মোটেও না!এখন থেকে ঠোঁটে কিছু লেগে থাকলে বলবেন।নাহয় অন্য মানুষের সামনে আমি লজ্জা পাবো’
‘আমার সামনে লজ্জা লাগেনা তোমার?”
‘না লাগেনা!এক মাস আগেও লাগতোনা,কারণ আমি জানতাম আপনার সাথে আমার কখনওই বিয়ে হবেনা,আপনাকে ইম্প্রেস করে কি লাভ হতো?’
‘তাই বলেই কি যতবার তোমাকে আর আমাকে একা দেখা করতে দেয়া হতো ততবারই তুমি শুধু মুখ ধুয়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আসতে?বিনা মেকআপে?’

‘ঠিক ধরেছেন!’
‘আর ইচ্ছে করে দাঁত বের করে স্যুপ খাচ্ছিলে?’
‘এটাও ঠিক ধরেছেন’
‘তুমি কি জানো তোমার এইসবেতেই আমি বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম?ভুল করে তুমি নিজেকে আমার সামনে সেটাই তুলে ধরলে যেটা আসলেই তুমি’

তটিনি ঠাস করে কপালে একটা বাড়ি দিয়ে বললো,’আরেহ আমি কি জানতাম আপনার মাথায় এত বুদ্ধি!তবে কি জানেন!স্ত্রী চয়েসের ক্ষেত্রে আপনার ধারণা একেবারে বাজে।আপনি আরও সুন্দরী, আরো শিক্ষিত, আরো বড়লোক ঘরের একটা মেয়েকে আপনার জন্য পেতেন। কিন্তু সেটা না করে আমাকে দেখতে এসে আমাকেই কনফার্ম করে দিলেন, এটা ঠিক করেননি।আমি আপনার জন্য ছিলাম না!’

‘আমার জন্য ছিলেনা?ছিলে বলেই আমার সাথেই তোমার বিয়েটা হলো তটিনি।’
তটিনি দম ফেলে হাতের ভারী সোনার চুড়ি গুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে চুপ করে থাকলো।এরপর যখন সে মাথা তুললো তখন দেখলো বুকে একটা বালিশ রেখে আর মাথার তলায় বালিশ একটা দিয়ে বাপ্পি নিদ্রায় তলিয়ে গেছে।তটিনি কাছে এসে ওকে দেখতে লাগলো।বকুল আপুর গর্ব করার পেছনে কারণ এই যে বাপ্পি এই পরিবারের হীরের টুকরো ছেলে!

সব কিছু ঠিক লাগলো বলেই বাবা এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন তটিনিকে বিয়ে দেয়ার জন্য।এর আগে অনেক পাত্র তটিনির জন্য দেখেছিলেন কিন্তু কাউকেই তার মন মতন হয়নি।কিন্তু বাপ্পিকে দেখে তিনি আর মনকে দাবায় রাখতে পারেননি।রাজি হয়ে গেলেন চট করে!

তটিনির বুকের ভেতর কামড় দিয়েছিল যেদিন সেদিনই সে বাপ্পির ছবিটা হাতে নিয়ে প্রথমবার দেখেছিল।সেই ছবিটাতে বাপ্পিকে এতটা সুন্দর লাগছিল যে বাড়ির যেই মানুষটাই হাতে নিচ্ছিল সেই বলছিল”মাশাল্লাহ”’
তটিনি ভয় পাচ্ছিল প্রথম কারণ বাপ্পির চাকরির কথা শুনে।

সে ভয় পাচ্ছিল কারণ এই ছেলেটা রিজক্ট করার মতন না।তার ভয় টা একটা সময় গিয়ে সত্যি হয়ে গেলো।একদিন সময় নিয়েছিল বাবা। তাও ওদের বাড়ির সবাইকে দাওয়াত দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য।তিনি শুরুতেই রাজি ছিলেন।তটিনি কত শত চেষ্টা করেছিল বিয়েটা আটকানোর জন্য।বাপ্পির শরবতে নুন ঢেলে ছিল,বাপ্পিকে ধমকে ধমকে বলেছিল সে আসিফকেই ভালবাসে!

কে জানতো এই উজবুকটাই ওর বর হবে।এমন জানলে নিজের শ্রম খরচ করে বিয়ে ভাঙ্গার পেছনপ সময় নষ্ট করতোনা।
দেখতে ভাল হলে কি হবে!ভেতরে ভেতরে এক নাম্বারের স্বার্থপর!মানে ডুই জানোস তোর হবু বউয়ের অতীত আছে।পাগলের মতন অন্য একটা ছেলেকে ভালবাসে!তোর দরকার ছিল এই মেয়ের পিছনে পড়ে থাকার??
তুই যদি এক মাস ধরে বিয়া বিয়া না করতি তবে এই সময়টা কখনও আসতোই না।আমার বাবাও অসুস্থ হতোনা,আসিফ ভাইয়ার বিয়ের কথাও উঠতোনা।আমিও জেদ করে তোকে বিয়ে করতাম না!সব তোর দোষ!’

‘জানি’
বাপ্পি চোখ বন্ধ করে জানি বলেছে বলে তটিনি থতমত খেয়ে এক দৌড় দিলো ওমনি তার হাতটা ধরে ফেললো বাপ্পি।তটিনি জিভ কামড়ে পেছনে তাকিয়ে হাত টান দিয়ে হটিয়ে বললো,’আমার অনুমতি ছাড়া আমায় টাচ করবেন না’
‘তুমিও আমার অনুমতি ছাড়া আমি ঘুমালে আমায় দেখবেনা!আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমায় পছন্দ করোনা,অথচ আমি এদিক সেদিক চোখ সরালেই আমায় দেখো,আমার ফোন দেখো,আমার ল্যাপটপ দেখো।আসলে তুমি ক্রাশ খেয়ে বসে আছো, স্বীকার করতেছো না’

‘আমি ক্রাশ খেয়েছি?ওটা আপনি খেয়েছেন।তাও আমার প্রতি’
‘সোটা তো আমি মেনেছি।মানতেছো না তুমি!’
সেই সময় বাবা আসলেন বাপ্পির রুমে।তটিনি সরে দাঁড়ালো।বাবা কাজের লোকদের দিয়ে বাপ্পির ডিভানটা তুলে নিয়ে গেলেন।নেওয়ার সময় বললেন,’তোর মামাতো ভাই আজ বাড়িতেই থাকবে।জানিস তো কত মানুষ।ওর জন্য ডিভানটা নিচ্ছি’

এই বলে সবাই চলে গেলো,সাথে ডিভানটাও।তটিনি হা করে তাকিয়েই আছে।বাপ্পি তার বুকের উপরের বালিশটা মাঝখানে রেখে বললো,’রাতে এভাবে শুলে হবে?’
‘সকালে উঠে যদি দেখি মাঝখানে বালিশ নাই তবে আপনার মাথায় একটা বালিশের তুলা বের হওয়া অবধি বালিশ দিয়ে পিটাবো’

তোমাতে করিবো বাস পর্ব ১৫

‘তার মানে বালিশ সরানোর জন্য শাস্তি হিসেবে শুধু একটা বালিশের বাড়ি??ও মাই গড!
আচ্ছা তুমি আমায় বালিশ দিয়ে পিটিও।আমার কোনো সমস্যা নাই’

তোমাতে করিবো বাস পর্ব ১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.