তোমাতে করিবো বাস পর্ব ১৮
লেখনীতে-আফনান লারা
মায়ের ঝাড়ি খেয়ে রিনি গরম পানিতে চুবিয়েই তোয়ালেটা সরাসরি আসিফের পিঠে উঠিয়ে দিলো।আসিফ ওমনি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিঠ মুছতে মুছতে বললো,’মাথা কি গেছে তোর?’
আসিফের রাগ দেখে রিনির মা এক দৌড়ে পালিয়েছেন, এদিকে রিনি যেভাভে বসে ছিল সেভাবে এখনও বসে আছে।রিনিকে চুপ করে থাকতে দেখে আসিফ আর কিছু বলেনি,নিজের পাঞ্জাবি দিয়ে পিঠ মুছে বসে থাকলো খাটের অন্যপাশে।তারপর দম ফেলে বললো,’আমি কাল সকালে আমাদের বাড়িতে যাব।আমি গ্রামে এসেছি আর মাকে দেখতে যাইনি এটা শুনে মা আমার উপর ভীষণ রাগ করবে।গিয়ে তাকে দেখে সোজা ঢাকা চলে যাবো।তুই ওখানে থাকলে থাকিস,না থাকলে আবার বাড়ি ফিরে আসিস।’
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রিনি মুখ বাঁকিয়ে রুম থেকে বের হতেই মায়ের সামনে পড়লো।মা কোমড়ে হাত রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন।মানে কথাগুলো সব শুনেছেন।রিনি মাথা ঘুরিয়ে চলে গেলো শরবত বানাতে,মা ও পিছু পিছু আসলো তার।
‘আসিফ ঢাকায় অন কিয়ারে?’
‘আঁই কি জানি!আঁই কি হেতেনের লগে হারাদিন থাইনি??’
‘থাস না কা?অন যেন একবার যাই হালাইছস তো আবার হিরি আইছস কা?আবার যা!’
‘হেতেন নিতো চা না দেও ন??’
‘এগিন কইলেই অ নি!!তুই এল দরি ইগার লগে থাইস। আর মাইয়া মানুষ তুই, এইসব শিখান লাগে কা তোরে? গালের এই হাল বানাই রাখছস কা?হাজিটাজি থাকতি হারোস না??জামাইরে কেমনে খুশি বানান লাগে জানোস না?সখিনা জরিনারে দেখেস না ওরা কেমন রঙঢং করে।অবশ্য তুই কেমনে জানবি তুই তো বিয়ার হরে জামাইরে একদিন ও হাস ন!’
কথাটা রিনির গায়ে লাগলো।শরবতে চিনি না দিয়ে খালি ট্যাং গুলে রেখে হনহনিয়ে নিজের রুমে এসে আলমারি খুলে দাঁড়ালো।আসিফ আপাতত কারিমের রুমে বসে আছে।রিনির রুমের খাট ঠিক করা অবদি সে ওখানেই থাকবে।কারিম গেছে কাঠ মিস্ত্রিকে ডেকে আনতে।
রাত্রিবেলার খাবার শেষ করে আবার আগেরমতন যে যার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেলেছে।তটিনি অপেক্ষায় ছিল একটা রুম খালি হবার যেটাতে সে গিয়ে ঘুমাবে,ভোরে সবাই ওঠার আগে আবার চলেও আসবে কিন্তু তার কপাল!!রুম যেটা খালি ছিল সেটাতে বুনি আর তৃষা ঘুমিয়েছে।বুনির রুমে বকুল আপু আর তার হাসবেন্ড।
তটিনি সব রুম চেক করে উপায় না পেয়ে আবারও রুমে ফেরত চলে এসেছে।বাপ্পির দেয়া গিফটটা ভালভাবে দেখা হয়নি।তখন বাপ্পিকে ওর মা ডেকে নিয়ে গেছিলেন।নতুন ফোনের কত ঝামেলা।বসে বসে সফটওয়ার আপডেট দেয়া লাগে।এগুলা সে পরে করবে।যেটা জরুরি সেটা করতে গিয়েই হেরে বসে আছে।
কোনোমতেই বাপ্পির সাথে সে ঘুমোতে পারবেনা।কারণ সে কখনও এভাবে ঘুমায়নি।তার রুমে তার নিজের বোন ঐশীই আসতোনা।কারণ নিজের রুম শেয়ার করা তটিনির পছন্দ ছিল না।বাপ্পির জায়গায় আসিফ ভাইয়া হলেও অনেক কষ্টে ওকে অভ্যাস বদলাতে হতো।কিন্তু এই বাপ্পিকে তো সে এমনিতেও পছন্দ করেনা তবে কি করে সে এই রাত কাটাবে!একটা ছেলের সাথে রাত কাটানো কি ছোট কোনো ব্যাপার!!
রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তটিনি ঘামছিল।বাপ্পি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ওকে মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে বললো,’আমি কি করছি আবার?’
ওমনি তটিনি ওর দিকে ফিরে আঙ্গুল তুলে বললো,”আপনি রাতে নাচানাচি করেন না তো?’
‘নাচানাচি মানে?রাতে কোন মানুষ নাচানাচি করে?
‘করে,,,ঐ যে হাত পা ছোড়াছুড়ি!’
বাপ্পি হাসতে হাসতে বিছানায় বসলো তারপর পা তুলে খাটের সাইডের একটা ড্রয়ার খুলে লোশন বের করে বললো,’আমিও তোমার মতই ছোট থেকে একা বিছানায় শুয়েছি তাই জানতাম না আমি রাতে ঘুমালে কি করি ঘুমের ঘোরে।এরপর একদিন অফিস থেকে সিলেট ট্যুরে গেছিলাম সেখানে হোটেলে একজন কলিগের সাথে ঘুমাতে হয়েছে।
সকালে কলিগ জানালো আমি নাকি রাতে যেভাবে শুই সকালে তার উল্টো টা থাকি।মানে প্রচুর ঘুরাঘুরি করি।এবার বলো এটা কি আমার দোষ?’
‘আপনারই দোষ।!দিনে নিশ্চয় ভাবেন শিয়াল মুরগীর দৌড়াদৌড়ি আর তাই রাতে সেটা দেখেন!’
‘মোটেও না।তুমি আসার আগে আমি কাজ ছাড়া কিছুই বুঝতাম না।বাবা মাকে জিজ্ঞেস করে দেখো।আমার লাইফে কাজের বাহিরে কিছুই ছিল না’
তটিনি বিড়বিড় করতে করতে বাপ্পির কাছে এসে হাত পেতে বললো,’আপনার আলমারির চাবি দিন’
বাপ্পি চুপচাপ ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে দিলো।ওমনি তটিনি আলমারি খুলে ভেতর থেকে দুটো কাঁথা বের করে সেগুলা ভাঁজ করপ বিছানার মাঝখানে রেখে বললো,’এপাশে আসলে ঘুমের মধ্যে রেখে হাঁড় ভেঙ্গে দিব’
‘তুমি এই সিরিয়ালের মতন নাটক কতদিন চালু রাখবে?’
‘যতদিন না সিরিয়াল শেষ হবে!’
আসিফ জানালার গ্রিল ধরে আকাশের চাঁদ দেখছিল।তটিনির জন্য খারাপ লাগছে!ভীষণ!কিন্তু তার কিছুই করার নেই।
কিছু অনুভূতির নাম হয়না!তারা নাম পায়না।তবে নাম ছাড়াই থেকে যায় চিরজীবন।
মনের একটা কোণে তাদের স্থায়ী বাসস্থান থেকেই যায়।যত মানুষই লাইফে থাক না কেন,ঐ জায়গাটা কখনও সরেনা।
ঠিক সেইসময় দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে আসিফ চাঁদ থেকে চোখ নামিয়ে পেছনে তাকায়।
কিন্তু যা সে দেখলো তা দেখে তার আকাশ থেকে পড়ার মতন অবস্থা হয়ে গেছে।
তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিনি।খয়েরী রঙের জর্জেটের শাড়ী পরিহিত,ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক, কপালে বড় করে একটা টিপ।চুলগুলোকে খোলা ছেড়ে দেয়া,হাতে শরবরবতের ট্রে।আসিফকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিনি দু কদম এগিয়ে বললো,’মনু!শরবতটা খেয়ে নেন’
এটা শুনে আসিফ কাশতে কাশতে বিছানায় বসে গেলো।রিনি ছুটে এসে শরবতটা ওর হাতে দিতে যেতেই আঁচলটা টুক করে পড়ে গেছে শরীর থেকে।
তা দেখে আসিফের এবার কাশি মাথার তালুতে উঠে গেছে।মাথায় বাড়ি দিতে দিতে সে অন্যদিকে ফিরে গেলো।কাশির জন্য কিছু বলতেই পারছেনা।
রিনি দ্রুত আঁচল ঠিক করে বলে,’ওপস সরি!!আম্মা জোর করি হিচল কাপড় এইডা ধরি হিইন্দাই দিছে।শুধু হড়ি যা শুধু হড়ি যা।অন আবার হড়ি গেছে!
আইচ্ছা আন্নে এত কাশেন কা?’
[আম্মা জোর করে পিছলে শাড়ীটা ধরে পরিয়ে দিছে।শুধু পড়ে যায়,শুধু পড়ে যায়।এখন আবার পড়ে গেছে!আচ্ছা আপনি এত কাশতেছেন কেন? ]
‘খুশিতে কাশি আমি।বেয়াদব কোথাকার!জীবনে শাড়ী পরিস নাই তুই?’
‘হিনছি!সুতার গুলা হিনছি।জর্জেটের গুলা এই প্রথম হিনলাম”
‘যা সামনে থেকে।তোকে কে বলছে এমন সং সেজে আসতে?এত লিপস্টিক কেন দিছোস??শাড়ী পরলে সেফটিফিন দিতে হয় জানিস না!’
‘জানি!সেফটিপিন টোগাই হাই ন, হেয়াইল্লাই এমনেই চলি আইছি।’
[জানি!সেফটিপিন খুঁজে পাই নাই,তাই এমনেই চলে এসেছি]
‘যা শাড়ী খুলে আয়,লিপস্টিক মুছ!’
‘লিপস্টিক কিচ্চে আন্নেরে?কোনাই খুলতাম??’
‘কোনাই খুলতাম মান?আমার সামনে খুলবি নাকি তুই??’
‘আম্মার কাছে যাইলে যদি হুনে আঁই শাড়ী খুলতাম চাই তাইলে শাড়ী খুলি আবার হাডাই দিবো একুলে।তার চাইতে বরং একুলেই খুলি!’
[আম্মার কাছে গেলে যদি শুনে আমি শাড়ী খুলতে চাই তাহলে শাড়ী খুলে আবার পাঠিয়ে দিবে এখানে।তার চেয়ে বরং এখানেই খুলি]
‘এই তোর বয়স কত হইছে!!এরকম বেয়াদবি করছিস!’
রিনি যেন এক কান দিয়ে কথা ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে ফেলে।আঁচলটা গলার পেছন দিয়ে নিয়ে আবার সামনে এনে ওড়নার মতন পরে আসিফের পাশে বসে বললো,’আঁরে দেই আন্নের কেইন্না লাগে এক্কানা কন না’
[আমাকে দেখে আপনার কেমন লাগে একটু বলেন না]
‘ভূত লাগে!ঐ যে গাছের ঢালে ঝুলে থাকে।ওদের মতন’
‘হাঁচা করি কন।আঁরে দেখি দুই মিনিট আঁক করি ছিলেন। আঁই খেয়াল করছি!তার মানে হাগল হই গেছেন ক্যান না😌?’
[সত্যি করে বলেন।আমাকে দেখে দুই মিনিট হা করে ছিলেন। আমি খেয়াল করেছি।তার মানে পাগল হয়ে গেছেন তাই না?]
‘মোটেও না!হঠাৎ করে ভূত দেখলে মানুষ এমন তাকিয়েই থাকবে’
‘ভূত দেখার চাহনি আর মুগ্ধতার চাহনি আঁই চিনি মিঃজামাই!!থাক স্বীকার না করলে আঁর কি!!আচ্ছা লিপস্টিক মুছতে কইলেন কেন?না মুছলে কিরবেন?আন্নের কি ডর লাগে কোনো কিছুতে?’
আসিফ কপালের ঘাম মুছে সরে বসলো।রিনি ওর আরেকটু কাছে এসে বললো।,’আম্মা কইছে গাত বাজি থাকতাম😌’
[আম্মা বলেছে গায়ে লেগে থাকতে]
‘সর তুই!আমার দম আটকে আছে। কাছ থেকে সর!’
‘আন্নের কথা না হুনি!আম্মার কথা
তো হুনতে অইবো।নাহলে আম্মা ধরি পিডাইবো।আইয়েন একসাথে লাগি বসি থাকি’
আসিফ সরতে সরতে বিছানার শেষ প্রান্তে চলে এসেছে।রিনি আবার ওর খুব কাছে এসে বসে পড়ে।তারপর আর কিছুই করছেনা।তাকে নাকি তার মা বলেছিল আসিফের সাথে লেগে বসে থাকলে ভালবাসা বাড়বে,দূরে দূরে থাকলে ভালবাসা কমে।তাই সে এটাই করছে।
তোমাতে করিবো বাস পর্ব ১৭
এদিকে আসিফের দম তখন যে বন্ধ হয়েছিল এখনও খুলছেনা,মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে।কি ফ্যাসাদে পড়ে গেছে।রিনিকে দেখে মনে হয় আজ সারারাত শান্তি দিবেনা।
ঠিক তখনই পাশ থেকে শোনা গেলো,’আন্নের কাছে অজ্ঞা সেফটিপিন অইবো?’
[আপনার কাছে একটা সেফটিপিন হবে?]