তোমাতে করিবো বাস পর্ব ৩৩
লেখনীতে-আফনান লারা
বকুল আপুর কথা মতন তটিনি বাপ্পির পাশে এসে দাঁড়ায়।বাগানে বসে থাকা আসিফ ওর দিকে তাকিয়েছিল অথচ সে জানলোইনা সেটা।তার চোখ ছিল বাপ্পির উপর।বাপ্পি হাত দিয়ে গেইট সাজানোর একজন লোককে দেখিয়ে দিচ্ছিলো নাম কোথায় লাগাবে।
তটিনি ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে চুপ করে থাকলো। তটিনির গায়ের সেই পারফিউমের ঘ্রান নাকে এসে বাঁধতেই বাপ্পি চুপ হয়ে গেছে।তাও পেছনে তাকালোনা।পুনরায় আবারও কাজে মন দিলো সে।
ওর বাবা তটিনিকে দেখে ওখান থেকে চলে গেছেন।
বাপ্পি কাজে যেন আরও ভাল ভাবে মনযোগ দিয়ে বসেছে।
তটিনি হাতের চুড়ির ঝুনঝুন আওয়াজ করলো হাতটাকে নাড়িয়ে।বাপ্পি এবার আরও সামনে চলে গেছে কথা বলতে বলতে।তটিনিও কম না সেও পিছু পিছু গেলো।
মাটিতে পড়া ছিল দুইটা কাঁচি আর একটা দা।
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাগানের মালি থেকে এগুলা চেয়ে এনেছিল ডেকোরেশনের লোকেরা।তটিনির চোখ বাপ্পির দিকে ছিল বলে সে আর নিচে খেয়াল করেনি।তার পায়ে জুতা ও ছিল না।বাগানে বের হবার আগে জুতা খুলে বেরিয়েছিল সে, কারণ শাড়ীর সাথে জুতা আটকে যাচ্ছিল বারবার।
যে দূর্ঘটনা ঘটার তাই ঘটলো।তটিনি পা রাখলো কাচির উপর।পায়ের অনেকটাই কেটে গেলো যখন তার পা কাচিতে পড়ে।
তটিনির চিৎকারে বাপ্পি পেছনে তাকায়না।সে ভাবে হয়ত নাটক করে ওকে ফেরাতে চেয়েছে।এদিকে আসিফ আর রিনি বাগান থেকে ছুটে আসলো ওখানে।আসিফ নিচে বসে তটিনির পা ছুঁতেই তটিনি হাত দিয়ে চোখ মুছে পা পিছিয়ে নিয়ে বললো,’যে দেখার সে আসেনি যখন,, তখন কাউকে আর দেখতে হবেনা’
‘বুবু রাগ করেন কা!চাই কেতো কাটছে।দেখান আঁরে’
রিনি নিচে বসে তটিনির পা ধরে দেখে অনেকটাই কেটে গেছে।সে ভয় পেয়ে আসিফের দিকে তাকালো।আসিফ তটিনির ধমকে ওকে ধরার সাহস পাচ্ছেনা।তাই বাপ্পির দিকে তাকিয়ে ওকে ডাকলো।বাপ্পি এবার পেছনে তাকায়।বিরক্তি নিয়ে বলে,’কি?’
‘তোমার বউ পা কেটে ফেলেছে।আসবেনা?নাকি আমি কোলে তুলে বাসায় নিয়ে যেতাম?তোমার বউ কিন্তু এখন আর আমার কোলে উঠতে চায়না।তার কোলে উঠার নতুন মানুষ হয়েছে কিনা!’
বাপ্পি তাও বিশ্বাস করেনি কিন্তু তটিনির পায়ের উপর চোখ পড়তেই রক্তাভ দেখে তার বুক কেঁপে উঠলো।ওর পায়ের দিকে তাকাতে তাকাতে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তটিনির চোখে অশ্রু দেখে নিচে বসে যায় বাপ্পি।
তটিনি বারবার চোখ মুছতেছিলো।রিনি ভেতরে চলে গেছে সবাইকে ডাকতে।বাপ্পি ওকে ধরতে যাবে তখনই তটিনি আসিফের ঘাঁড়ে হাত রেখে উঠে দাঁড়ায়।তারপর আসিফের হাতটা ধরে বলে,’আমায় বাসায় দিয়ে আসুন ভাইয়া’
আসিফ তটিনির হাতটা বাপ্পির হাতে দিতে যেতেই তটিনি চোখ রাঙিয়ে তাকায়।আসিফ আর সাহস করেনা।তটিনিকে ধরে বাসায় নিয়ে যাওয়া ধরে কিন্তু ওর পায়ের এত বাজে অবস্থা যে সে এক পা দিয়েও হাঁটার জোর পারছেনা।
আসিফ বাপ্পির দিকে তাকিয়ে ইশারা করে তটিনিকে নেয়ার জন্য।
তটিনি তা দেখেনি।সে হাঁটার বৃথা চেষ্টা করছে।
বাপ্পি কাছে এসে ওকে কোলে তুলে নিলো সোজা।তটিনি ভাবতেও পারেনি সে এমনটা করবে।
বাপ্পি ওকে নিয়ে সোফায় নামিয়ে পা ধরতে যেতেই তটিনি পা ছাড়িয়ে ফেলে মাথা তুলে রিনিকে বললো রুম থেকে তার ফেন এনে দিতে।বাপ্পিকে সে পা ধরতেই দিচ্ছেনা।
রিনি ফোন এনে দিতেই তটিনি তার বাবাকে কল করে জানালো তারা কখন আসবে, সে বাসায় ফিরতে চায়।বাবা জানতে চাইলেন এত তাড়াহুড়োর কি আছে।
তটিনি কিছু বলেনা।তাদের শুধু তাড়াতাড়ি আসতে বলে।
বাপ্পি দূর থেকে তটিনির পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।তটিনি তাকে ধরতেই দিচ্ছিলোনা।শেষে আসিফ আর রিনি তড়িগড়ি করে ব্যান্ডেজ নিয়ে ওর পা ঢেকে দিতে দিতে বললো এটা ডাক্তার দেখাতে হবে,তাদের ফার্স্ট এইডে কিছু হবেনা।
তটিনি মুখটা কালো করে বসে ছিল।ইতোমধ্যে বাড়ির সবাই খবর পেয়ে গেছে তটিনির পা কাটা গেছে।বাপ্পি দূরে সরে গেলো আর সকলে তটিনিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
কার রাগ হয়ে থাকার কথা,আর কে রাগ করছে।
ডাক্তারের কাছে যেতে হলোনা।ডাক্তার নিজেই আসলো বাসায়।তটিনির পায়ে ভালভাবে ঔষুধ লাগিয়ে ওর হাতে ইনজেকশন লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
বকুল আপু বাপ্পিকে বললেন তটিনিকে যেন রুমে নিয়ে যায় কিন্তু তটিনি মানা করে দিতে চাইলো,এইবার তার মানা কেউ শোনেনি কারণ মেহমান আসা শুরু হয়ে গেছে।সকলে এসে সোফাতেই বসবো।তাই নতুন বউকে এভাবে সোফায় বসে থাকতে দেয়া যাবেনা।
তটিনি অনিচ্ছার সত্ত্বেও রুমে ফেরত আসলো তাও বাপ্পির সাথো।রুমে আসতেই ওদের পেছনে আর কেউ আসলোনা।বাপ্পি দরজা লাগিয়ে তটিনির কাছে চলে আসতেই তটিনি মুখটা ঘুরিয়ে নেয়।
বাপ্পি ওর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,’আমার চাইতে আসিফের হাত বেশি নিরাপদ মনে হলো?’
‘যখন আমি ব্যাথা পেলাম তখন ঐ আসিফই ছুটে এসেছে’
‘আমি জানতাম না।জানলে ওর আগে আমিই আসতাম’
তটিনি আর কিছু বলেনা। বাপ্পি ওর পাশে বসে পা ছুঁতে নিতেই তটিনি পা সরিয়ে নেয় আবারও।এরপর বলে,’আমি বাবার বাসায় গেলে আমার সাথে আপনাকে আসতে হবেনা।যাবার দরকার নেই।আমি চাই কদিন একা থাকতে’
বাপ্পি কিছু বললোনা।শুধু তটিনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তটিনির ইনজেকশনে ঘুম আসার মেডিসিন ছিল বলে ওপাশ ফিরে বসতেই তার চোখ লেগে গেলো।
বাপ্পি আর ওকে বিরক্ত করেনি।ওর গায়ে কম্বল টেনে রুম থেকে বের হয়।আসিফ এখন বাপ্পির জায়গায় গিয়ে ডেকোরেশনের দিকটা দেখছে।
বাপ্পি ওর সাথে এসে দাঁড়াতেই আসিফ মাথা ঘুরিয়ে বলে,’তটিনি খুব জেদি তাই না?’
‘অনেক’
‘কেনো রাগ করেছে?’
‘সে পড়ে গেছে আর আমি না দেখার ভান ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।এটা ওর ধারণা আর কি।তাছাড়া এর আগে ওকে একটু ইগনর করেছি”
‘ওসব কিছুনা।ব্যাথার সাথে সাথে রাগটাও কমে যাবে’
‘তটিনির রাগ কমে কিসে জানো?’
‘আমি জানি চকলেট চিপস খেলে।তবে তুমি যেহেতু ওর হাসবেন্ড হও।ওকে আদর সোহাগেই জেদ কমিয়ে নিতে পারো।এইসব আবার জিজ্ঞেস করা লাগে?’
ওমনি রিনি এসপ আসিফের হাত জোড় করে ধরে বলে,’আঁরেও আদর হোয়াগ করেন ‘😌
‘উঃ!!সর সামনে থেকে।সারাদিন চুইংগামের মতন লেগে থাকা আমার একদম পছন্দ না।’
‘আন্নে আঁরে আদর হোয়াগ কইরলে আঁই ভালা অই যাইয়াম’
‘তোর আবার কি হইছে?পা ভাঙছে না হাত?’
‘আঁর কলিজা টুকরা টুকরা অই গেছে আন্নের বিরহে।এইবার আদর হোয়াগ করি আঁরে সারি দেন’
[আমার কলিজা টুকরাটুকরা হয়ে গেছে আপনার বিরহে।এইবার আদর সোহাগ করে আমাকে সারিয়ে দেন]
বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ হবার পর গাড়ীতে তটিনি যখন উঠলো তখন সে তার পাশে বাপ্পিকে বসতে দেখে তার মেজাজ খারাপ হলো আরও দ্বিগু।চেঁচিয়ে বললো সে যেন না আসে।
কিন্তু গাড়ীর একটা মানুষও তার চেঁচানোতে কোনো রিয়েকশান দেখায়নি।যেন সব আগ থেকে ঠিক করে রাখা।
তটিনি নিজে নিজে গাড়ী থেকে বের হতে চাইলো কিন্তু বাপ্পি তার হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলে বসিয়ে রাখে।
‘জোরজবরদস্তি করে যাবেন সাথে?’
‘কিসের জোরজবরদস্তি? বৌভাতের দিন বর বউ যাইতে হয় একসাথে।তুমি না চাইলেও যেতে হবে’
তটিনি আর কিছু বলেনা।গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।পথে তার আবারও ঘুম আসায় সে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমালেও এক ধাক্কায় তার মাথা ঘুরে জানালা থেকে সরে যায়।আর একটা সময়ে সে বাপ্পির ঘাঁড়ে মাথা রেখেই পুরাটা পথ কাটিয়ে দেয়।ফিরতে তাদের রাত দশটা বাজে।
তটিনি সেসময় চোখ মেলে নিজেকে বাপ্পির বুকে পেয়ে ছিটকে সরে যায়,পরেই পায়ে ব্যাথা পেয়ে তার হুশ আসে একেবারে।বাপ্পি নিজে গাড়ী থেকে আগে নেমে তটিনির পাশের দরজা খুলে ওর দিকে হাত বাড়ায়।তটিনি গাড়ী ধরে নিজে নিজে নামার চেষ্টা করে আবারও পড়ে যাওয়া ধরলো।বাপ্পি ওকে এবারও ধরে ফেলে বলে,’এরপর আর ধরবোনা।ঠাস করে পড়ে আসিফকে ডেকে নিও বরং।দাঁত থাকতে তো দাঁতের মর্ম বুঝোনা’
তোমাতে করিবো বাস পর্ব ৩২
বাপ্পি তটিনিকে নিয়ে ওর রুমে এসেই দুজনে থেমে যায়।
তটিনির মামাতো ভাই বোনেরা মিলে রুমটাকে সাজিয়ে রেখেছে ওদের জন্য।
ওরা রুমে আসতেই বাইরে দিয়ে দরজা লাগিয়ে সকলে হিহি হাহা করতে করতে চলে গেছে।
তটিনি বিছানায় বসে গাল ফুলিয়ে বললো,’ওদের মানা করেন এরকম করে যেন না হাসে।এমন করে হাসতেছে যেন আজই আমরা!!!আমার বয়ে গেছে!এরকম দায়িত্বহীন মানুষকে ছোঁয়ার!’