তোমাতে করিবো বাস পর্ব ৫
লেখনীতে-আফনান লারা
তটিনিকে একা ডাকেননি বাবা,ডেকেছেন বাপ্পি সমেত।দুজনেই ওনার সামনে কেবিনের ডাবল সোফাটায় বসে আছে।বাবা অনেকক্ষণ চুপ ছিলেন তটিনি মনে মনে জিকির করছে বাবা যাতে বিয়ে করতে না নলে।কারণ সে খুব ভাল করে জানে বাবা এখানে তাদের ডাকার কারণ ঠিক কি।
চুপ থাকার বেশ কিছুক্ষণ পর তটিনির বাবা মুখ খুললেন।উপরের ছাদের দিকে চেয়ে থেকে বললেন,’জানো বাপ্পি বাবা,আমার ছোট বোন একটা ছিল।ছিল বলছি কারণ সে এখন আর নেই।নেই কারণ বাবা তাকে তার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে বাধ্য করেছিল। বিয়েটা অবশ্য হয়েছিল শেষমেশ,কিন্তু আমার বোনটা শোক নিতে পারেনি।
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে আকাশ নামের একটা ছেলেকে প্রচণ্ড ভালবেসেছিল।বাবা মানেনি,আমরাও কিছু বলেনি।বললেও বাবা পাত্তা দিতেন না।আমার বোনটির বিয়ের পরেরদিন লাশ মিললো বাসর ঘর থেকে।সে আত্নহত্যা করেছে।নিজের ভালবাসাকে সে ভুলতে পারেনি,নতুন মানুষটাকেও মেনে নিতে পারেনি।দুয়ের মাঝে সে নিজরে জীবনটা দিয়ে দিলো।কি লাভ হলো?সে তার ভালবাসার মানুষটাকে পেয়েছে নাকি বাবা তার মেয়েকে পেয়েছে?
সে অনেক বছর আগের ঘটনা।সেসময় তটিনির মা ও শিশু ছিল।আমি ছিলাম বালক।সবাই ওকে ভুলে গেছে।আমিও ভুলে গেছি কিন্তু আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেলো।আমিও কিন্তু একই কাজ করতে যাচ্ছিলাম।হয়ত এখন অসুখের দোহায় দিয়ে বাপ্পি তোমার সাথে তটিনিকে বিয়ে করতে বাধ্য করতে পারতাম কিন্তু আমি সেটা করবোনা।তটিনির এমনিতেও মাথার তার ছিঁড়া।আত্নহত্যার মতন বেকুবি করতে সে এক মিনিট ভাববেনা।তাই আমি আর বিয়ে করতে বলবোনা ওকে।বাবা বাপ্পি,আমায় মাফ করে দিও।আমার দ্বারা তটিনিকে জোরজবরদস্তি করা আর করা আর হবেনা।নিজের ছোট বোনের সেই ঘটনাটা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসছে।ভাবতে পারছো!তটিনির সাথে যদি এমন হয়!’
তটিনি মনে মনে বিশাল আকারের খুশি হয়ে গেছে।ছোটকালে মায়ের কাছে শুনেছিল তার একটা ফুফু আত্নহত্যা করে মারা গেছিলো।কারণ মা বলেনি,কেউই বলেনি।সেও আগ্রহ দেখায়নি।সেই ফুফুর ঘটনা তাকে আজ বাঁচিয়ে দেবে কে জানতো!
তটিনি খুশিতে দাঁত কেলালো।কিন্তু বাপ্পির ভেতরটা পুড়ে গেলো তখন।বুকে হাত রেখে সে তটিনির দিকে তাকায়।তটিনির কপালের লাল টিপটা ওকে খুব আঘাত করলো সেসময়।তটিনির ঠোঁটের রাঙা লাল রঙ তার বুকের ভেতরটা খাঁনখাঁন করে দেয়।করুণ চাহনিতে সে তটিনিকে দেখছে।নতুন বউয়ের এই বেশ তাকে খুব করে কষ্ট দিল হঠাৎ করেই।নিজের গায়ের শেরওয়ানিতে হাত রেখে বাপ্পি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে।কেন বর কনে সেজেও তাদের বিয়েটা আজ হলোনা,কেন বিধাতার এই নিয়ম রটলো!!!কেন তার সাথেই এমন হলো!!!
করিডোর থেকে শোনা গেলো আসিফ এসেছে।ঐশী চেঁচিয়ে বলছিল কথাটা।বাপ্পির চোখ বেয়ে তখন পানি পড়ছিল।তটিনি দেখলোনা।আসিফের নাম শুনে সে ছুটে চলে গেছে ঐদিকে।বাপ্পি চোখ মুছে ওর চলে যাওয়া দেখে গেলো কেবল।ওকে কাঁদতে দেখেছে তটিনির বাবা।তিনি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন শুধু।
আসিফের হাত ধরে রেখেছিল রিনি, এই পরিবেশে সে নতুন।সবাই তাকে ড্যাবড্যাব করে দেখছিল বলে সে আসিফের হাতটা খুব শক্ত করে চেপে ধরছিল।ঐশি,ওর মা,ফুফু এবং বাপ্পির মা সবাই রিনিকে দেখছিলেন।আসিফ মনে মনে সময় গুনছিল তটিনির আসার।কারণ তটিনি আসলেই এখানে আজ আগুন লাগবে।
তটিনি ছুটে এসে আসিফকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে ওকে ছুঁতে যাবার আগেই দেখে একটি মেয়ে আগে থেকেই আসিফের হাতটা জড়িয়ে ধরে ওর গায়ের সাথে লেগে ইতস্তত বোধ করছে ওদেরকে দেখে।
হলুদ রঙের থ্রি পিস পরা খোলা চুলের মেয়েটিকে দেখে তটিনির একটা সময়ের জন্য গায়ে জ্বালা করে উঠলো।আসিফকে এর আগে কোনো মেয়ের সাথে সে দেখেনি। এভাবে তো কখনওই না।আসিফের হাত এমন করে সবসময় সে ধরেছে,তবে এই মেয়েটি কে!
তটিনি রিনির দিকে ওমন করে তাকিয়ে আছে দেখে আসিফ তটিনির মায়ের দিকে চেয়ে বললো,’খালামণি ওকে চিনসো?’
‘ওয় তো জয়নাল ভাইয়ের মেয়ে রিনি না?’
‘হ্যাঁ’
‘আরেহ কত বড় হয়ে গেছে।ওকে সেই ছোট কালে দেখছিলাম।এখনও সেই আগের মন চিকনচাকনই আছে,গায়ের রঙটা পরিষ্কার হয়েছে মনে হয়।ও এখানে এত রাতে?কার সাথে আসলো?তুই কোথায় পেলি?’
আসিফের গলা শুকিয়ে গেছে।এত বড় কথা পেশ করবার আগে ওর সব চাইতে বেশি ভয় হচ্ছে তটিনিকে নিয়ে।
তাও সাহস নিয়ে বলে উঠলো,’ও আমার স্ত্রী। ক্লাস এইটে থাকতে ওর সাথে আমার বিয়ে হয়।এখনও উঠিয়ে নেওয়া হয়নি।চাকরি পেলে অনুষ্ঠান করবো এই আর কি’
এই কথা শুনে সকলে অবাক চোখে তাকালো রিনির দিকে।তটিনি ভাবছে আসিফ নাটক করছে।কোথা থেকে একটা মেয়েকে এনে নাটক করছে যাতে করে তটিনি ওকে ঘৃনা করে।তটিনি তখন হেসে বললো,’আচমকা কারোর হাত ধরে বলবেন সে আপনার ওয়াইফ আর আমরা বিশ্বাস করবো?বোকা বানাচ্ছেন কেন শুনি?’
আসিফ মাথা নিচু করে আবার খালার দিকে চেয়ে বলে,’আসলে এই কথাটা বাবা আপনাদের জানায়নি কারণ খালামণি জানোই তো,বাবার সাথে আঙ্কেলের কেমন মনমালিন্য! আমিও জানাইনি কারণ আমি চাইনি বিষয়টা কেউ জানুক।সব কিছুর একটা সময় থাকে।আজ সেই সময়টা এসেছে বলে মনে হলো।আজও জানাতাম না অবশ্য।কি হয়েছে জানো!রিনি কাউকে না জানিয়ে একা একা ঢাকা চলে এসেছে।এখন আমি ছাড়া তো আর কোনো উপায় নাই’
খালামণি চোখ কপালে তুলে ধমকের সুরে বললেন,’হানিফ ভাই এটা মোটেও ঠিক করেন নাই।এত বড় একটা কথা,এতগুলো বছর পর আমি জানছি!!তুই জানিস আসিফ আমি তো তোর জন্য মেয়ে দেখাও শুরু করে দিছিলাম।এত বড় কথা মানুষ কিভাবে চাপিয়ে রাখতে পারে!’
তটিনি তখনও রিনির দিকে তাকিয়ে ছিল।সবকিছু তার কাছে নাটক ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছেনা।বিয়ে যদি হয়েই থাকে তবে আসিফ বছরের পর বছর ঢাকাতে পড়ে থাকতো কেন!ছুটি পেলেও গ্রামে দুদিনের বেশি থাকতো না কেন!এটা নেহাত নাটক হবে!’
তটিনির চোখের চাহনি দেখে আসিফ আন্দাজ করেছে সে এখনও বিয়ের কথাটা বিশ্বাস করেনি।
বাপ্পি নিজেকে ঠিক করে কেবিন থেকে বের হতেই আসিফকে দেখে।তটিনিও ওখানে ছিল।বাপ্পির মনে হলো এখানে আর তার প্রয়োজন নেই তাই সে মাকে বললো তারা এখন বাসায় ফিরে যাবে।কিন্তু বাপ্পির মা বললেন আরও কিছু সময় দাঁড়াতে।এখানে কি চলছে সেটা তিনি দেখবেন।অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটতে থাকলে সেটা দেখতে ওনার অনেক ভাল লাগে।যদিও সেই ঘটনার সাথে তার দূর দূরান্তের কোনো সম্পর্ক নেই তাও তিনি ঐ ঘটনা মনযোগ সহকারে শেষ অবধি দেখবেনই।
বাপ্পি তাই মন খারাপ করে করিডোর ছেড়ে বাহিরের দিকে চলে গেছে মাকে রেখেই।এখানে যত থাকবে তত দম বন্ধ লাগবে।
তটিনি আসিফের একটু কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,’ভাইয়া এইসব নাটকবাজি দেখিয়ে আমাকে ভুলাতে পারবেনা একটুও’
আসিফের অবাক লাগছে এত বড় কথা তটিনি মানতে চাইছেনা বলে।সে ভেবেছিল কথাটা শুনে নির্ঘাত তটিনি জ্ঞান হারাবে কিন্তু ও যখন বিশ্বাসই করছেনা তখন মোড় তো অন্য দিকে ঘুরে গেলো!
রিনি আসিফের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,’মাইয়া ইগা আন্নেরে হছন্দ করে ক্যান না?[এই মেয়েটা আপনাকে পছন্দ করে তাই না?]
আসিফের হিচকি উঠে গেলো রিনির কথা শুনে।তারপর সেও ধীর গলায় রিনিকে বললো,’এত বুঝতে হবেনা তোকে।কে বললো এইসব?’
‘নইলে কোন মাইয়া এইন্না এক্কান খবর হুনিও কয় মিছা কতা!আঁই বুইজ্জি এই মাইয়া আন্নেরে হছন্দ করে’
[নাহলে কোন মেয়ে এরকম একটা খবর শুনেও বলবে মিথ্যা কথা?আমি বুঝেছি এই মেয়েটা আপনাকে পছন্দ করে]
আসিফ নড়েচড়ে দাঁড়ায়।রিনিকে দেখে হাবাগোবা মনে হলেও সে মোটেও হাবাগোবা নয়।অত্যন্ত চালাক ও দুরুন্ত স্বভাবের।চোখ দেখেই পেটের কথা বুঝে যায় সে।তার এই চঞ্চলতা ভবিষ্যতে যাতে গ্রামের যুবকগণের মাঝে প্রস্তাবের লাইন না ধরিয়ে দেয় সে ভয়ে জয়নাল ফুফা রিনিকে আসিফের নামে করে দিয়েছেন যাতে করে কোনো বদনামি না ঘটে যায়।
তটিনি রিনিকে আসিফের কানে ফিসফিস করতে দেখে আবারও তার গায়ে জ্বলে উঠলো।
বিরক্ত হয়ে বললো,’ভাইয়া!এইসব নাটক বন্ধ করবেন?’
তটিনির মা তখনই ওর হাত চেপে ধরে বললেন,’করিডোর ভর্তি মানুষের সামনে,তোর বাবার অসুস্থতার মাঝে আসিফ মজা করছে তোর মনে হয়?আসিফ মজা করার মতন ছেলে?জীবনে ওকে মজা করতে দেখেছিস?তাহলে এটা মজা কেন মনে হচ্ছে তোর?’
তটিনি মায়ের ধমকের সুরে বলা কথাগুলো শুনে আসিফের দিকে ফিরে তাকায়।আসিফ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।তার মানে এই কথা সত্যি!কিন্তু কি করে!কিভাবে?
তটিনি মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে দেখে আসিফ আর কথা বাড়ালোনা।খালামণিকে বলে তটিনির বাবাকে দেখতে কেবিনের ভেতর ঢুকে গেলো।রিনি তখনও করিডোরেই ছিল।
তটিনি চেয়ারে বসে থেকে রিনির দিকে তাকিয়ে আছে।ওর এমন অগ্নি দৃষ্টি দেখে রিনি পা টিপে টিপে সেও আসিফের পিছু পিছু কেবিনের দিকে চলে গেলো।তটিনি তার বিয়ের বেনারসী শাড়ীটা খাঁমছে ধরে কাঁপছে অনবরত ।রাগ হলেই ওর কাঁপুনি উঠে যায়,এখনও তাই।
ওকে কাঁপতে দেখে মায়েরই ভয় হলো। তিনি দ্রুত ঐশীকে ইশারা করে ফিল্টার থেকে পানি আনতে বলে দিলেন।
ঐশীও ছুটে গিয়ে পানিও নিয়ে আসলো।তটিনির দিকে পানির গ্লাসটা ধরতেই সে চট করে উঠে গেলো চেয়ার থেকে।রাগতে রাগতে চলে গেলো ওখান থেকে।ঠিক সেই জায়গায় গেলো যেখানে বাপ্পি গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘এই যে শুনুন’
তটিনির গলা শুনে বাপ্পি গ্লাস থেকে মাথা ওঠায়।বারান্দার থাই গ্লাসে মাথা ঠেকিয়ে পাঁচ তলার নিচের ব্যস্ত রোডটা দেখছিল সে।তটিনি বাপ্পির কাছে এসে ডান কান ধরে বলে,’সরি,এক্সট্রেমলি সরি!!আমার ভুল হইছে আপনাকে বিয়ে করতে মানা করায়।ক্ষমা করে দিন।
রাত ৯টা বাজে এখন। এখনও বিয়ের সময় আছে।চলুন আমরা বিয়ে করবো’
‘এপ্রিল মাস আসতে এখনও ৪মাস বাকি।এখনই এপ্রিলফুল বানাতে চাও?’
‘নাহ।এটা সত্যি প্রোপোজাল দিলাম,একসেপ্ট করেন।দেরি হয়ে যাচ্ছে’
‘কি এমন ঘটনা ঘটায় এই সিদ্ধান্ত নিলে?দেখো আমি কিন্তু আরও একবার বিয়ের আসর থেকে উঠতে পারবোনা।যা বলবে ভেবে বলবে’
তটিনি দম ফেলে বললো,’আসিফ ভাইয়া আমায় ধোকা দিয়েছে।বিরাট বড় ধোকা,এত্ত বড় ধোকা।যেটা আমি হজম করতে পারছিনা,বমি পাচ্ছে,মাথা ঘুরছে,অমিডন ঔষুধটা আম্মুর কাছে আছে,নেয়ার সাহস নাই।মনে হয় প্রেসার ও লো হয়ে গেছে।
জানেন!উনার নাকি বউ আছে তাও ১০বছর পুরোনো।ভাবতে পারছেন?সেই খবর আমি আজ জানলাম।আমিও বিয়ে করতে পারি।বিয়ে করে দেখিয়ে দিব’
তোমাতে করিবো বাস পর্ব ৪
‘বলা যত সহজ করা তত কঠিন তটিনি।যাও ফিরে যাও।আজকের জন্য তোমায় আর বিয়ে করতে হবেনা।ভাবো,তোমার বয়স কম।ভাবতে সময় নিচ্ছো না সেই জন্যই!ভাবলে বুঝতে পারবে আজ বিয়েপাগলা করা তোমার জন্য মঙ্গল হবেনা।’
‘অবশ্যই হবে,আমি আজই বিয়ে করবো।আমি হেরে গেছি সেটা যাতে কেউ না বুঝে।আপনি কি আমায় বিয়ে করতে চান না?তবে বলে দিন।আমি পাশের বাসার জিংকু আন্টির বলদা ছেলে মহিউদ্দিনকে বিয়ে করে নিব।তাও আমি আজই বিয়ে করবো’