তোমাতে করিবো বাস পর্ব ৭
লেখনীতে-আফনান লারা
তটিনিদের বাসা থেকে বাপ্পিদের বাসা অনেকদূর। প্রায় দু ঘন্টার পথ পাড়ি দিতে হয়।এত দূরের বিয়ের প্রস্তাব টা আসলো কি ভাবে?সে আরেক কাহিনী।বাপ্পির অফিসের বসের ছোটকালের বন্ধু হলো তটিনির বাবা।সেই সূত্রে প্রস্তাবটা ঘুরেফিরে এসেছিল।
বিয়ে হবেনা মনে করে পাত্রপক্ষের সবাই চলে এসেছে বিকেলেই।
এদিকে বিয়েটা তো হয়েই গেলো,বাপ্পির মা এতক্ষণে গিয়ে ফোনে জানিয়ে দিয়েছেন খবরটা।সেখানে সব প্রস্তুত রাখতে বলে দিছেন,এরপর ফোন রাখেন তিনি।তটিনি সারাদিনের দখলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল,বারবার চোখ লেগে আসছিল তার,ঝিমোচ্ছিল।শত কষ্ট করে সে ঘুমটা আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল কারণ সে জানে ঘুমোলেই বাপ্পির কাঁধে মাথা চলে যাবে।এটা সে চায়না।বাপ্পি মনে করবে মেয়েটা অল্পতেই গায়ে পড়া স্বভাবের।এই ধারণা মাথায় চেপে সে রাতের ঘুমটাকে ধরে রাখছে।
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাপ্পির চোখে ঘুম নেই।সে সবসময় রাত করেই ঘুমায়।অনেক সময় তার ঘুমাতে ৩টাও বেজে যায়।এই ঘুম কম হবার পেছনে অনেক ডাক্তারের ভিজিটে টাকা ঢেলেছে।তাও তার ঘুমের কোনো হিল্লি হয়না।আবার সকাল হলে সে কি ঘুম!কেউ তাকে তুলতে পারেনা।অফিসে দেরি করে যেতে যেতে অভ্যাস হয়ে গেছে।বসের ঝাড়ি খেয়েও তার স্বভাব বদলায় না।এখন তাই মূর্তির মতন মাঝখানে বসে সে গাড়ীর আলোয় ফাঁকা রাস্তা দেখতে ব্যস্ত।
রাত তখন সাড়ে এগারোটা বাজে।তারা সবে আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়েছে।যেতে যেতে রাত ১টা বেজে যাবে।
তটিনি আর ঘুম ধরে রাখতে পারেনি।নিজের দুহাত দিয়ে নিজেকে ধরে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে।বাপ্পি তটিনিকে এমন করে শুতে দেখে ঠিক বুঝে গেছে তটিনি ওর গায়ে যাতে না আসে তাই সে এমন করে শুয়েছে।যেন অপরিচিত ছেলের পাশে বসছে সে।
মানুষ অপরিচিত কারোর পাশে বসেও এমন বিহেভ করেনা যেটা তটিনি করছে!
-“ভেবেছিলাম বিয়ে করতে যেমন রাজি হয়ে গেছে, আমাকে মেনে নিতেও ওর বেশি সময় লাগবেনা!কিন্তু নাহ!ধারনাটা ভুল।
যে আমার গায়ের সাথে গা লাগবে বলে এমন করে পাশের সিটে শুতে পারে তার থেকে এগুলা আশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না!!”
রাত সাড়ে বারোটার দিকে গাড়ী থামলো একটা টিনের চায়ের দোকানের সামনে।ড্রাইভার ঘুম কমাতে চা খাবে তাই থামিয়েছে।বাপ্পির মা ওপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছেন।বাপ্পি তটিনিকে ওমন রেখেই ওর সামনে দিয়ে গাড়ী থেকে নামলো।ড্রাইভারের সাথে চা নিয়ে খাওয়ার সময় ওর চোখ গেলো গাড়ীর দিকে।গাড়ীর ভেতর বসে বসে তটিনি চোখ চুলকাচ্ছে।বাপ্পি গাড়ী থেকে বের হবার সময় সম্ভবত ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
বাপ্পি আরেক কাপ চা নিয়ে এসে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো।তটিনি চোখ ঘঁষামাজা করে মাথা তুলে দেখে ওপারে বাপ্পি দুহাতে দুকাপ চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তটিনি তখন মাথার যন্ত্রণায় কপাল কুঁচকিয়ে রাখছিল।ভুল সময়ে ঘুম ভাঙ্গলে প্রচণ্ড রকম বিরক্তি বোধ হয় তার।এখনও তাই,তারপরেও গাড়ী থেকে নামে সে।ধমকে বলতে চাইলো”আমি কফি খাই না,জানেন না!’
কিন্তু তখনই বাপ্পি কাপটা এগিয়ে ধরে বলে,’এটা কফি না,এটা চা’
তটিনির কপাল কুঁচকানো কমে গেলো।কিছু না বলেই বাপ্পির হাত থেকে চায়ের কাপ নেয় সে।তারপর আবারও কপাল কুঁচকে বলে,’এটাতে কিছু মেশাননি তো?’
‘হ্যাঁ।নেশার ঔষুধ মিশিয়েছি।খেয়ে নাও।বাসরটা মারাত্মক হবে আমাদের ‘
বাপ্পির এ কথা শুনে তটিনি চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও দিলোনা।বাপ্পির দিকে চেয়ে বললো,’নিন আপনার হাতের কাপটা আমায় দিন।আপনাকে আমি বিশ্বাস করিনা’
বাপ্পি কাপটা এগিয়ে ধরে বলে,’এটাতে কিন্তু আমি দুটো চুমুক দিয়ে ফেলেছি’
‘তাতে কি!তাও বোঝা গেলো ওটাতে নেশাজাতীয় কিছু মেশানো নেই।’
তটিনি নিজের কাপটা বাপ্পিকে দিয়ে ওর কাপটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে।বাপ্পি মিটমিট করে হাসছিল তটিনির অবস্থা দেখে।তটিনি পেছনে ফিরে দোকানের দিকে তাকিয়ে বলে,’এত রাতে এই দোকান খোলা কেন?’
‘আমাদের মতন নতুন বর কনের রাতটাকে জাগিয়ে রাখার জন্য’
‘আপনার মনে লাড্ডু ফুটছে কেন এতো?’
‘ফুটবেনা??এই এক মাস আমি কত দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম।”””তটিনি আমার হবেনা”””
“”””তটিনি আমার হবে।””””
এই দুই লাইনে কত সংশয় নিয়ে আমার সকাল হতো, জানো তুমি?’
তটিনি চা শেষ করে হাত নামিয়ে কাপটা ঝুলিয়ে ধরে বলে,’নিচে শোয়াবো। আমার সাথে শোয়ার স্বপ্ন গুছিয়ে দেবো।চিনেন আমায়?’
‘নিচে কেন শুবো?আমার রুমে ডিভান আছে।ওটাতে আমি শুবো।নিচে কেন শুতে হবে?’
‘ওহ!আপনি তো আবার বড়লোক!যেটা দেখে আব্বু পাগল হইছিল!’
‘কেন তুমি জানতেনা আমি যে আবার বড়লোক?’
‘না জানতাম না।আপনার দেয়া সেই গিফটটা আমি পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়েছি।কি করে জানতাম আপনি কেমন বড়লোক আর আপনার গিফট দেয়ার ধরণ কিরকম!’
‘ওটাতে কম করে হলেও সাত হাজার টাকার চকলেট ছিল তটিনি।আমার বোনের সাথে যুদ্ধ করে জিতে, আমি চকলেট গুলো কিনেছিলাম তোমার জন্য।নিজে না খাও,তোমার বোনকে দিতে পারতে।খাবার অপচয় আমার পছন্দ না’
‘আর আমার আপনাকে পছন্দ না।আপনি জানেন ও না আমার কি পছন্দ আর অপছন্দ!আমি চকলেট পছন্দ করিনা,এটা যদি জানতেন তবে আমায় সাত হাজার টাকার চকলেট পাঠাতেন না।আমাকে চায়ের বদলে কফি দিতেন না’
‘এরেঞ্জ ম্যারেজে এইসব আগে থেকে জানতে হয় তটিনি???’
তটিনি চুপচাপ কাপটা দোকানে রেখে গিয়ে গাড়ীতে বসে গেলো।কিছুই বললোনা।বাপ্পি ওর পরে নিজেও এসে বসে গাড়ীতে।এবার মাঝখানে তটিনি।জানালার পাশে বাপ্পি।তটিনি ওর দিকে তাকাচ্ছেনা। গাল ফুলিয়ে সামনের দিকে চেয়ে আছে।যেতে আর আধ ঘন্টার মতন লাগবে।
তটিনির বিয়ের গাড়ী চলে যেতেই আসিফ চলে গেছে বাসার ভেতর,রিনিকে রেখেই।রিনির সেদিকে খবর নেই।সে ঘুরে ঘুরে তটিনিদের উঠানটা দেখছে।তটিনির বাবাকে বলতে শুনেছে আজ থেকে রিনি আসিফের সাথে এই বাসাতে থাকবে।তার মানে এই বাসাটাকে তার আপন করে নিতে হবে।
সে খুশি হয়ে পুরো উঠানটায় গোলচক্কর দিয়ে বাসার ভেতরের দিকে গেলো।ভেতরে এসে আসিফকে কোথাও সে দেখেনি।রাতের খাবার হয়ে গেছে এখন শোয়ার অপেক্ষা।আসিফ গেলো কোথায়?রীতিমত তার রুমেই রিনির ঠাঁই হবার কথা।বিয়ের পর এই প্রথমবার সে আসিফের সাথে এক রুমে থাকবে এটা মনে পড়ে যাওয়ায় লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে সে মুচকি মুচকি হাসছিল সোফার রুমে দাঁড়িয়ে।
তটিনির সেজো খালা ছিলেন ওখানে।রিনিকে তিনি চিনেছেন।অনেক আগে দেখেছিলেন,যখন সে ক্লাস সিক্সে পড়তো তখন।রিনিকে দেখে চেনার উপায় হলো চিকনা শরীর আর মাথার উপরে সবসময় চুলে puff করা থাকে।তিনি দূর থেকেই রিনিকে দেখছিলেন,রিনিকে ওমন করে হাসতে দেখে আগাগোড়া কিছুই বুঝলেন না কারণ তিনি জানেন ও না এই রিনি তাদের আসিফের বউ।যারা জানে তারা সবাই হাসপাতালে।
তিনি হাতে বেঁচে যাওয়া রোস্ট আর পোলাওর প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।ভাবলেন রিনিকে সাধবেন তাই এগিয়ে এসে বললেন,’রিনি খাইবা?’
রিনি ভাবনার ঘোর থেকে বেরিয়ে খালার হাতের প্লেটের দিকে চেয়ে থেকে বলে,’না খাইতাম ন।ঐতেন কোনাই?’
‘ঐতেন কে?’
‘ঐ যে ঐতেন।কইতে শরম লাগে আঁর🙈’
‘তোর ঐতেন কে আবার!যেভাবে বলছিস যেন তোর বিয়ে করা বর।আচ্ছা তোর কি বিয়ে হয়েছে রিনি?অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ হয়না তো তাই কিছুই জানিনা।’
এই কথা বলে খালা আবারও রিনির পা থেকে মাথা অবধি দেখে বললেন,’নাহ!তোরে দেখে বিয়াইত্তা লাগেনা’
‘আরে আঁই বিয়াইত্তা।জানো কার লগে বিয়া অইছে??’
‘কিহ কস!তোর বিয়া হইছে?কার লগে?তোর জামাই কই?’
‘তোঁঙ্গো আসিফের লগে’
খালা হা করে রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।সেই সময় হাসপাতাল থেকে আসা তটিনির মেজো খালা এসে বললেন,’একি রিনি তুই এখানে কি করিস?যা আসিফের রুমে।এত রাতে আর জেগে থেকে লাভ নেই।শুয়ে পড়।কাল সকালে যত কথা হবে’
তোমাতে করিবো বাস পর্ব ৬
রিনি মাথা নাড়িয়ে সামনের দিকে চলে গেছে।এদিকে তটিনির সেজো খালা রূম্পা হা করে দাঁড়িয়েই আছেন।তার বড় মেয়ে রুনার সাথে আসিফের বিয়ে দেবেন বলে এক বছর