পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ১৪

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ১৪
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

গোধূলি লগ্ন, সূর্যের রক্তিম আলোয় পশ্চিমাকাশ’টা ঝলসে আছে। সেই ঝলসানো আলোর কিছু এসে পড়ছে পদ্ম’র মুখশ্রীতে। তার তৈলাক্ত গালগুলো সেই আলোয় চিকচিক করছে। নাকের ডগায় লেগে থাকা ঘামগুলোও চিকচিক করে জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্বের কথা।

তার ভেজা চোখের পল্লবগুলো কাঁপছে। বুকের ভেতর’টা ঢিপঢিপ করছে তার। তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে সামনের লোহার গেইট’টার দিকে। সুযোগ বুঝে এখান দিয়ে পালাবে সে। এই বাড়িতে থাকা আর সম্ভব না। ঐ লোক’টা খুব খারাপ। এই বাড়িতে থাকলে ঐ লোক’টা তাকে শেষ করে ফেলবে। আর সে এসব কাউকে মুখ ফুটে বলতেও পারবে না। ডাক্তারবাবু আর বড়ো মা এই খারাপ মানুষটাকে ভীষণ ভালোবাসে, তাই তাদেরকে সে কখনোই বিশ্বাস করাতে পারবে না। তাই সেই চেষ্টা সে করবেও না। এই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়াই একমাত্র সমাধান।

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পদ্ম তার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর ছাদের সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তার তখন হঠাৎ চোখ যায় সিঁড়ির কর্ণারের একটা দরজা দেওয়া রুমের দিকে। তালাবদ্ধ রুম। তবে কেন যেন এখানটাই দাঁড়ালে একটা উটকো গন্ধ তার নাসারন্ধ্রে এসে ঠেকে। তার খুব বিচ্ছিরি লাগে এই গন্ধটা। হয়তো এই রুম’টা অনেকদিন ধরে পরিস্কার করা হয় না, তাই এই গন্ধ।

পদ্ম নিচে নেমে তার রুমে যায়। আলমারি খুলে একটা ব্যাগ বের করে। তারপর সেই ব্যাগে কিছু কাপড় ঢুকায়। তার মন’টা খচখচ করছে। কাজটা ঠিক হবে তো? ডাক্তারবাবু আর বড়ো মা খুব কষ্ট পাবেন। বিশেষ করে বড়ো মা, এই মানুষটা তো তাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে।

এইভাবে উনাকে না বলে পালিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
পদ্ম ব্যাগ’টা সাইডে রেখে নিচে নেমে যায়। সে নিচে গিয়ে এদিক ওদিক কাউকে খুঁজতে লাগল। কাঙ্খিত ব্যক্তিকে না পেয়ে পদ্ম দরজা খুলে বাইরে বের হলো। ডানদিকে একটা রুম আছে। পদ্ম সেই দরজায় নক করলো। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে খালা উঁকি দিয়ে বজ্র গলায় জিগ্যেস করলেন,

‘কী চায়?’
‘খালা, আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে..’
খালা চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
‘না না, আপনার লগে আমার কোনো কথা নাই। আপনি যান তো, আজাইরা কথা বইলেন না।’
খালা পদ্ম’র মুখের উপর দরজা’টা লাগিয়ে দিল। পদ্ম বিষন্ন চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন বলছে, খালা এমন কিছু জানে যেটা জানা তার খুব জরুরী। কিন্তু বড়ো মা তখন ওভাবে কেন রিয়েক্ট করলো? ব্যাপারটা কি সত্যিই খুব স্বাভাবিক?

পদ্ম আবার নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। পদ্ম’র চোখ কিছুটা লেগে গিয়েছিল। সে শোয়া থেকে উঠে বসলো। বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখল, চারদিক অন্ধকার। পদ্ম উঠে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নিচ থেকে কিছু মানুষের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পদ্ম’র কাছে বড্ড পরিচিত মনে হচ্ছ সেই স্বর। পদ্ম দুই সিঁড়ি নামল।

সোফার রুমে বসে থাকা মানুষগুলোকে দেখে তার আত্মা যেন কেঁপে উঠল। মামা-মামী, উনারা এখানে কী করছেন? পদ্ম ভয়ে ভয়ে নিচে নেমে গেল। পদ্ম-কে দেখা মাত্রই তার মামী ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। ন্যাকামি করে কেঁদে বললেন,

‘ওমা রে কেমন আছিস তুই? তোর কথা মনে হইলে কষ্টে আমার বুকটা তো ফাইটা যায় মা।’
পদ্ম তার মামিকে নিজের কাছ থেকে ছাড়াল। তারপর বললো,
‘শুনে ভালো লাগল যে, আমার কথা তোমার অন্তত মনে পড়ে।’
‘ওমা পদ্ম! তোর সবকিছু মনে পইড়া গেছে? ও গো দেখছ, আমাদের পদ্ম’র সব মনে পইড়া গেছে।’
পদ্ম তখন টনক নড়লো। তার মনে পড়ল, সে তো সব ভুলে যাওয়ার নাটক করছিল। ধুর, নাটক’টা চালিয়ে গেলেই তো ভালো হতো…
পদ্ম দম ফেলে বললো,

‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে আমার। তোমাদের কি আর এত সহজে ভুলতে পারবো, বলো?’
পদ্ম তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আবার বললো,
‘তা এখানে কেন এসেছো তোমরা? আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য? আমি কিন্তু এখান থেকে এক পা ও নড়বো না।’
‘না না, আমরা তোকে নিতে আসি নাই তো; তোর কথা আমাদের খুব মনে পড়েছিল তাই তোকে দেখতে আসছি মা।’
পদ্ম হাসল, যেন ভীষণ মজার কথা শুনেছে সে।

সে আর কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ওর চলে যাওয়া দেখে মামী চোখ মুখ কুঁচকে কিছু বললো, যেটা কেউ শুনলো না।
পদ্ম’র মামা মামী বেরিয়ে গেলেন। রাত তখন আট’টা কী নয়’টা। মামা মামী বেরিয়ে যেতেই পদ্ম যেন প্রাণ ফিরে পেল। এতক্ষণ ভীষণ আতংকে ছিল সে। না জানি আবার কোন উদ্দেশ্যে এসেছেন উনারা। আর সত্যি বলতে, তার মাথায় এখনও একটা কথা বার বার ঘুরে, মামী এত সহজে কী করে মেনে নিল সবটা? আর বড়ো মা’ই এত সহজে কিভাবে তাদের মানিয়ে নিল, কিভাবে?

রাত দশ’টা,
পদ্ম বই পড়ছিল। তখন রুবি হোসেন তার রুমে এলেন,
‘পদ্ম!’
‘জ্বি, বড়ো মা।’
‘তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল।’
‘বলুন।’
‘বলছি, আগে এখানে বসো।’
পদ্ম রুবি হোসেনের পাশে বসলো। রুবি হোসেন তখন পদ্ম’র হাতে একটা ছবি দিল। পদ্ম অবাক হলো। ছবি’টা উল্টে দেখল। একটা ছেলের ছবি। পদ্ম আবার অবাক হলো। বললো,

‘এটা কে বড়ো মা?’
‘আরাফাত খান।’
পদ্ম আবার ছবি’টার দিকে তাকাল। বললো,
‘আরাফাত খান? কে উনি?’
রুবি হোসেন মুচকি হাসলেন। বললেন,
‘আগে বলতো, ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে?’
পদ্ম এবার চকিত হলো। বড়ো বড়ো চোখ করে বললো,

‘পছন্দ হবে মানে?’
রুবি হোসেন পদ্ম’র মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘আমাকে বিশ্বাস করো, মা?’
পদ্ম মাথা নাড়াল। রুবি হোসেন আবার বললেন,

‘আমি জানি তুমি আমাকে খুব বিশ্বাস করো। আর আমিও আমার এই মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসি। (একটু থেমে) আমার মেয়ে তো বড়ো হয়েছে, তাই না? ওর বিয়ে নিয়ে তো আমাকেই ভাবতে হবে। আমি জানি মা, তোমার মামি যা করেছিল তার জন্য তুমি ঠিক বিয়ের জন্য প্রস্তুত না, কিন্তু আমি শুধু একবার অনুরোধ করবো , তুমি ছেলেটার সাথে কথা বলে দেখো। আমি তোমার উপর কিছু চাপিয়ে দিব না মা। তোমার ভালোর কথা ভেবেই আমরা এই সিদ্ধান্ত’টা নিয়েছি। তুমি এখন ভেবে দেখো, কী করবে।’

পদ্ম রুবি হোসেনের কথার পিঠে কিছু বললো না। তিনি তাই আবার বললেন,
‘তুমি সময় নাও মা। সময় নিয়ে ভাবো। ছেলে কিন্তু খুব ভালো। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে। মা, বাবা আর ছোট্ট একটা বোন আছে। এখন সবটা তোমার হাতে। তুমি যা চাও তাই হবে।’
রুবি হোসেন রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পদ্ম ছবিটার দিকে আবার তাকাল। ছবির মানুষটা বেশ সুদর্শন। পদ্ম ছবিটা পাশে রাখল। মনকে প্রশ্ন করলো, এখন তার ঠিক কী করা উচিত।

জীবনের এত এত বৈচিত্র্য সে আর সহ্য করতে পারছে না। তার জীবন কেন এত অগোছালো? কেন অন্য সবার মতো স্বাভাবিক না? কেন এত কষ্ট পেতে হয় তাকে? কেন কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না? চোখ বুজলেই মনে হয়, আশে পাশের সবাই তাকে ধোঁকা দিচ্ছ, তাকে নিয়ে খেলছে। কাউকে যে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। বড়ো মা, উনাকে কি সত্যিই বিশ্বাস করা যায়? উনিও যদি তাকে ঠকায়?

পদ্মফুল পর্ব ১৩

পদ্ম ছবিটা আবার হাতে নিল। মনে মনে বললো,
‘যদি চেহারার মতো মানুষের মনটাও সুন্দর হতো!’

পদ্মফুল পর্ব ১৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.