পদ্মফুল পর্ব ১৯
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
পদ্ম লাল রঙের একটা জামদানী শাড়ি পরেছে। শাড়িটা রুবি হোসেন তাকে দিয়েছেন। সে এই প্রথম শাড়ি পরেছে। নিজেকে আয়নায় দেখে বারবার যেন বিস্মিত হচ্ছে সে। আজকে তাকে অন্যরকম লাগছে। কেমন যেন নতুন বউয়ের মত একটা ফিল হচ্ছে তার। শাড়ি পরা শেষে সে হালকা পাতলা কিছু জুয়েলারিও পরে নিল। এগুলোও রুবি হোসেন দিয়েছেন।
তারপর চুলটা খোঁপা করে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়েছে। শাড়ির আঁচলটা টেনে এনে মাথায় ঘোমটা দিতেই মনে হলো এবার সত্যি সত্যিই তাকে বউ লাগছে। ইশ, এবার তো লজ্জা লাগছে তার! আরাফাতের সামনে কী করে যাবে, সেটাই ভাবছে সে। গেইট দিয়ে ঢুকার সময় পদ্ম একবার বারান্দা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকে দেখেছিল। পাঞ্জাবী গায়ে সুদর্শন লাগছে তাকে।
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রুবি হোসেন রুমে এসে পদ্ম-কে তাড়া দিয়ে বললেন,
‘পদ্ম, হয়েছে তোমার? উনারা তো নিচে অপেক্ষা করছেন তোমার জন্য। চলো এবার..’
পদ্ম লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বললো,
‘আমি তৈরি, বড়ো মা।’
পদ্ম-কে তখন আপাদমস্তক দেখে রুবি হোসেন বললেন,
‘মাশাল্লাহ, কী সুন্দর লাগছে তোমায়! আরাফাত তোমাকে এইভাবে দেখলে তো আজই বিয়ে করে নিতে চাইবে।’
পদ্ম ভীষণ লজ্জা পেল। সে মাথা নিচু করে দু হাত কচলাতে লাগল। রুবি হোসেন হালকা হেসে বললেন,
‘থাক, আর লজ্জা পেতে হবে না। চলো, এবার নিচে চলো।’
তিনি পদ্ম-কে সাথে নিয়ে নিচে নামলেন। আরাফাত আর পদ্ম এই প্রথম মুখোমুখি হতে চলেছে। পদ্ম’র হৃৎস্পন্দন যেন ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলছে। সে নিচে সবার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে সালাম দিল। তখন তার সালামের জবাব দিয়ে একজন ভদ্রমহিলা বললেন,
‘এদিকে এসো, আমার পাশে এসে বসো মা।’
কথার ধরনে পদ্ম’র মনে হলো, উনি হয়তো আরাফাতের “মা”। পদ্ম-কে তিনি তার পাশে বসালেন। তার বরাবরই আরাফাত বসা। কিন্তু সে লজ্জায় তাকাতে পারছে না তার দিকে। সেখানে বেশি কেউ ছিল না। আরাফাতের মা, বাবা, বোন আর আরো একজন ভদ্রলোক, হয়তো উনি আরাফাতের চাচা হোন।
সবাই তাকে টুকিটাকি এটা ওটা প্রশ্ন করলো। পদ্ম বেশ স্বাচ্ছন্দ নিয়ে সেসব প্রশ্নের জবাব দিল। একপর্যায়ে বলা হলো ছেলে আর মেয়েকে একটু আলাদা কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। কথা মতো দুজনকেই পাঠানো হলো পদ্ম’র রুমে। এতক্ষণ পদ্ম’র অস্বস্তি লাগলেও এখন কেন যেন তার খানিকটা ভয়ও করছে। তার গলা যেন শুকিয়ে উঠছে। আরাফাত তার রুমে এসে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্ম সৌজন্যের খাতিরে বললো,
‘বসুন।’
আরাফাত হালকা হেসে বিছানার এক কোণে বসলো। তারপর সে পদ্ম-কে ও বসতে বললো। কিছুটা দূরত্ব রেখে পদ্মও তার পাশে গিয়ে বসলো। পদ্ম বুঝতে পারছে না তার এখন কিছু বলা উচিত নাকি চুপ করে থাকাটাই বেটার অপশন। ঐদিকে আরাফাতেরও তাই মনে হচ্ছে। দুজনেই এইভেবে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। একপর্যায়ে আরাফাতই তার সাথে প্রথম কথা বলার চেষ্টা করে বললো,
‘আপনার আর এই বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই তো?’
পদ্ম অপ্রস্তুত হাসল। মিনমিনিয়ে বললো,
‘না মানে আসলে, বড়ো মা যা বলবে তাই হবে।’
আরাফাত তখন হেসে বললো,
‘তার মানে আপনি রাজি?’
পদ্ম লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আরাফাত তখন আবার প্রশ্ন করলো,
‘আপনার কি আমার সম্পর্কে আর কিছু জানার আছে?’
‘না, বড়ো মা আমাকে সব বলেছেন। আর তাছাড়া আপনিও তো আপনার সম্পর্কে সবই বলেছেন। আর কী জানার থাকতে পারে? তবে, আপনার যদি আমার সম্পর্কে কিছু জানার থাকে তবে প্রশ্ন করতে পারেন।’
আরাফাত আলতো হেসে জবাবে বললো,
‘আপনার সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি ততটুকুই যথেষ্ঠ। আমার আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই।’
পদ্ম মনে মনে ভীষণ স্বস্তি পেল। অবশেষে তার জীবনে সুন্দর কিছু হতে চলছে। একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হতে চলছে। আহা, বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে তার। যেন এতসব কিছু ভেবে সে অন্যরকম একটা সুখ পাচ্ছে।
নিচে বড়োদের অনেক আলোচনা হলো। কী আলোচনা হলো সেটা পদ্ম বা আরাফাত কেউই জানে না। তারা মাত্রই নিচে নেমেছে। আর নামা মাত্রই দেখল সবাই বেশ উৎসাহ নিয়ে একজন অন্যজনকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। ইতিমধ্যেই আরাফাতের ছোট বোন পদ্ম’র মুখে এনে মিষ্টি পুরে দিল। পদ্ম বুঝে গেল এটা কিসের ইঙ্গিত। তারমানে সবাই রাজি। পদ্ম’র মতো আরাফাতও ভীষণ খুশি। মিষ্টি খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই আরাফাতের বাবা বললেন,
‘আমরা কিন্তু শুভ কাজে দেরি করতে চাই না, আপা। আপনারা রাজি থাকলে আগামী শুক্রবারেই বিয়েটা হয়ে যাক?’
রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব দুজনেই এতে সম্মতি জানিয়ে বললেন,
‘আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে ছেলে মেয়েকে প্রশ্ন করুন, তাদের আবার কোনো সমস্যা নেই তো?’
আরাফাতের বাবা তখন পদ্ম আর আরাফাতের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘তোমাদের কোনো আপত্তি নেই তো?’
পদ্ম লজ্জা পেয়ে মৌনতা গ্রহণ করলো। আরাফাত বললো,
‘না বাবা, আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
সবাই তখন সমস্বরে বলে উঠল, “আলহামদুলিল্লাহ।”
কিছুক্ষণ আগে মেহমান’রা সবাই চলে গিয়েছেনে। পদ্ম তার রুমে বসে বসে তার হাতের অনামিকা আঙ্গুলের আংটি’টা দেখছে। আজই এটা আরাফাতের মা তাকে পরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। ভাবতেই অবাক লাগছে, তার অন্য আর চার পাশ’টা মেয়ের মতো স্বাভাবিক ভাবেই একটা বিয়ে হচ্ছে। কখনো ভাবেনি সে এমন কাউকে সে তার জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবে। মামা, মামী তার জন্য যেসব ছেলে দেখছিল তাদের কথা ভাবতেই তো তার গা শিউরে উঠে। আরাফাত ভীষণ ভালো একটা ছেলে। হয়তো ভবিষ্যতে তাকে ভীষণ ভালোবাসবে…
আজ বৃহস্পতিবার। আর কালকে শুক্রবার। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এসেছে। বিয়ে নিয়ে পদ্ম’র উত্তেজনার কোনো কমতি ছিল না। তবে বাড়ি জুড়ে আলাদা কোনো হৈ চৈ ছিল না। সে রুবি হোসেনকে বলেছে, তাদের বিয়েটা নাকি মসজিদে হবে। খুব সাধারণ ভাবে। আর তার কথা মতোই তাদের বিয়ের ব্যবস্থা মসজিদেই করা হয়েছে। আজকের দিন পেরুলেই কাল নতুন আরেকটা দিন। যেই দিনটা অন্য দিনগুলোর মতো হবে না। মনে ভেতর ভীষণ অস্থিরতা আর ভয় কাজ করলেও পদ্ম নিজেকে সাহস দিচ্ছে এই বলে যে, এই বিয়ের পর হয়তো সত্যিই তার জীবন পাল্টে যাবে।
বিকেলের দিকে পদ্ম তার রুমে বসে আরাফাতের সাথে কথা বলছিল। হঠাৎ সে তখন বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ শুনতে পায়। আর সেই শব্দ শোনা মাত্রই তার মন বলে উঠে, “ডাক্তারবাবু আসেনি তো?” পদ্ম বারান্দায় যায় দেখার জন্য।
পদ্মফুল পর্ব ১৮
গেইট দিয়ে সেই পরিচিত গাড়িটা ঢুকতে দেখেই পদ্ম’র ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে চমৎকার হাসি। ডাক্তারবাবু এসেছেন। নিশ্চয়ই বড়ো মা তাকে তার বিয়ে উপলক্ষে আসতে বলছেন। এত দুশ্চিন্তার মাঝেও ডাক্তারবাবুকে দেখে পদ্ম আরো এক দফা স্বস্তি পেল। মনে মনে বললো, “ডাক্তারবাবু বাড়িতে থাকলে সব কিছু ভালোই ভালোই হবে…”