পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ২৩

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ২৩
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

পুরনো ঘা’এ খোঁচা লাগলে সেখান থেকে রক্তক্ষরণ বেশি হয়। যেমন হচ্ছে এখন সুজানার মা বাবার। বৃদ্ধ দুজন মানুষের মেয়ের শোকে পাগল পাগল অবস্থা। শুকিয়ে যাওয়া চোখ মুখ নিয়ে উনারা এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। আদিদ প্রথমে ভেঙ্গে পড়লেও হসপিটালে এসে উনাদের দেখে সে নিজেকে সামলে নেয়।

এই মানুষগুলো-কে দেখে সে নিজের মনে সাহস তৈরি করে। সত্যের মুখোমুখি তো হতেই হবে। সে নিজেকে শক্ত করে সুজানার মা বাবার কাছে গিয়ে বসে। উনাদের বোঝায়। মনে আশ্বাস দেয়। জানে এসব কিছুই কাজে দিবে না। যতই হোক, মা বাবা তো। এতদিন তো উনারা এই ভেবে বেঁচে ছিল যে, তাদের মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে, একদিন হয়তো ঠিক ফিরে আসবে। কিন্তু আজ, আজ এই মানুষগুলো আর কী ভেবে বেঁচে থাকবেন যখন উনারা শুনবেন এটা উনাদের মেয়ের’ই ক*ঙ্কা*ল…?

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সুজানার মা বাবার কাছ থেকে ডি এন এ সিম্বল নেওয়া হয়। এই সিম্বল এর সাথে ঐ ক*ঙ্কা*লের সিম্বল মিললেই ধরে নেওয়া হবে ঐটা সুজানার’ই ক*ঙ্কা*ল। বৃদ্ধ মানুষগুলো ভয়ে গুটি শুটি মেরে বসে আছেন। হয়তো মনে মনে দোয়া করছেন, যেন সিম্বল না মিলে।

শহর থেকে অনেকটা ভেতরে আসার পর পদ্মদের গাড়িটা থামল। এতটা পথ আসতে আসতে পদ্ম’র কিছুটা চোখ লেগে গিয়েছিল। গাড়িটা থামতেই সে পিটপিট করে তাকাল। বোঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে তারা। কিন্তু চারদিক এত অন্ধকার যে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। আরাফাত গাড়ি থেকে নামল। তারপর পদ্ম’র পাশের দরজাটা খুলে বললো,

‘নামো পদ্ম।’
পদ্ম আস্তে করে নামল। বিস্ময় নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
‘আমরা কোথায় এসেছি?’
আরাফাত হাসল। বললো,
‘তোমার কাঙ্খিত স্থানে। চলো।’

পদ্ম বুঝতে পারলো না। চারদিক ভীষণ নীরব। কোথাও তেমন কোনো সাড়া শব্দ নেই। কেবল কোথা থেকে যেন একটা অদ্ভুত পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আর তাছাড়া তাদের গাড়ি ছাড়া এখানে আর কোনো গাড়িও নেই। বাকিরা কোথায়, এখনো আসেনি? পদ্ম আরাফাত-কে বললো,
‘আচ্ছা, বাকিরা এখনও আসেনি? মা, বাবা কাউকেই তো দেখছি না।

‘আছেন। উনারা ভেতরে গিয়েছেন। চলো তুমি।’
পদ্ম’র ভীষণ অদ্ভুত লাগল বিষয়’টা। নতুন বউকে রেখে সবাই ভেতরে চলে গেল? আশ্চর্য!
আরাফাতের পেছন পেছন পদ্ম কিছুটা এগিয়ে গেল। সামনে গিয়ে দেখল একটা পুরোনো কাঁচা দালান। কেমন যেন দেখতে। একেবারে অপরিষ্কার আর অগোছালো। দু’তালার বারান্দায় মেয়েদের কিছু জামা কাপড় ঝুলানো। পদ্ম সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,

“এভাবে কেউ কাপড় নাড়ে। দেখতে কেমন বিচ্ছিরি লাগছে।”
দালানের কাঠের দরজাটা খুলে আরাফাত বললো,
‘চলো, ভেতরে চলো।’
পদ্ম ইতস্তত কন্ঠে বললো,
‘আমাকে বরণ করবে না?’
‘হ্যাঁ, করবে তো। সবাই ভেতরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, চলোই না।’

পদ্ম অস্বস্তি নিয়ে ভেতরের দিকে পা বাড়াল। ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই সে যেন ভীষণ অবাক হলো। কিছু মেয়ে কেমন অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এখানের কাউকেই সে চিনতে পারছে না। আরাফাতের মা, বোন উনারা কোথায়। পদ্ম আরাফাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘উনারা কারা? উনারা সবাই আমার দিকে এভাবে কেন তাকিয়ে আছেন?’
‘উনারা হলেন আমাদের গ্রামের কিছু আত্মীয়-স্বজন। গ্রামের মানুষ তো তাই হয়তো নতুন বউ দেখে এইভাবে তাকিয়ে আছে।’
‘ওহহ আচ্ছা।’

পদ্ম হালকা হেসে সবাইকে সালাম দিল। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে কেউ তার সালামের জবাব দিল না। পদ্ম’র যেন ব্যাপার’টা কেমন লাগছে। তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। তাই সে আরাফাত-কে বললো,
‘মা কোথায়? মা-কে ডাকুন না, আমাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’

‘আসলে, মা হয়তো রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত। তুমি চলো না আমি তোমাকে আমার রুমে নিয়ে যাচ্ছি।’
পদ্ম’র কাছে সবকিছু যেন কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। বউ বরণ না করে উনি রান্নাঘরে কাজ করছেন? আর তার উপর এই মহিলাগুলোও কেমন অদ্ভুত। কেউ কোনো কথা বলছে না অথচ কেমন ড্যাপ ড্যাপ করে তাকিয়ে আছে।

পদ্ম ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে আরাফাতের পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। নিচ তলায় একবারে কর্ণারের একটা রুমে আরাফাত পদ্ম-কে নিয়ে ঢুকল। রুমে ঢুকা মাত্রই যেন পদ্ম’র মনটা ভালো হয়ে গেল। কত ফুল দিয়ে সাজানো রুমটা। পদ্ম ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখতে লাগল। আরাফাত তখন তাকে বললো,
‘পদ্ম, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। ঐ যে আলামারিতে তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু রাখা আছে। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।’

আরাফাত চলে গেলে পদ্ম রুমের দরজা আটকে দিয়ে আলমারির কাছে যায়। সেখান থেকে বেছে বেছে একটা কাঁচা হলুদ রঙের সুতি শাড়ি বের করে। সেটা নিয়েই সে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।

আদিদের পুরো বাড়ি জুড়ে চিরুনি তল্লাশি চলে। তবে সেই তল্লাশিতে আহামরি কিছু পাওয়া যায়নি। কেবল পাওয়া গিয়েছে দুই একটা মোবাইল যেগুলো স্টোর রুমে ছিল। আর পাওয়া গিয়েছে দুইটা পুরোনো ছবি। ছবি দুইটাতেই দুটো মেয়ের অস্পষ্ট মুখ দেখা যাচ্ছে।

বাড়ি থেকে পুলিশ অফিসার অভিকে কল করে বলে, উনারা এই বাড়ির সবাইকে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। আদিদ আর সুজানার মা বাবাকে নিয়ে অভিও যেন থানায় চলে আসে। হসপিটালের টেস্টের ফাঁকেই অভি সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে থানার দিকে রওনা দেয়। অভি’রা থানায় গিয়ে পৌঁছাতেই দেখল আদিদদের বাড়ির দু’জন কাজের লোককে থানার একজন কনস্টেবল খুব বকাবকি করছেন। যেন উনারাই আসল আসামী। আদিদ বিরক্ত হয়ে তখন সেই কনস্টেবলের কাছে গিয়ে বলে,
‘উনাদের সাথে এমন করছেন কেন? উনারা কিছু করেননি।’

কনস্টেবল জবাবে বললো,
‘আপনি কী করে এত সিউর হচ্ছেন মশাই যে উনারা কিছু করেননি?’
‘উনারা আমাদের বাড়ির বিশ্বস্ত আর পুরোনো লোক, উনারা কিছু করেননি আমি জানি।’
‘বিশ্বস্ত লোকেরাই কিন্তু সবার আগে বিশ্বাস ভাঙ্গে, সেটা জানেন তো মি. আদিদ হোসেন?’
অফিসার বললো। আদিদ জবাবে বললো,

‘কিন্ত উনারা সত্যিই নির্দোষ।’
‘আপনার বাড়ি থেকে একটা ক*ঙ্কা*ল পাওয়া গিয়েছে। আরো পাওয়া গিয়েছে কিছু মোবাইল ফোন আর দুটো মেয়ের ছবি। আপনি বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস? এমন একটা সিচুয়েশনে আপনি কাউকে হুট করেই নির্দোষ বলে দিতে পারেন না। আগে আমাদের তদন্ত করতে দিন, তারপরই না বলতে পারবেন তারা আদৌ নির্দোষ কিনা?’

সবাইকে একে একে অনেক প্রশ্ন করা হলো। বেশি প্রশ্ন করা হলো আদিদ-কে। কারণ সুজানার হারিয়ে যাওয়ার আগে লাস্ট কথা তার সাথেই হয়েছিল।

এক থেকে দেড় বছরের আগের কেইস’টা আজ আবার রি ওপেন করা হয়েছে। প্রশাসন এবার যেন নড়ে চড়ে উঠল। আর তাতেই কপালে ঘাম ধরলো রুবি হোসেন আর আকবর সাহেবের। তবে উনারা এমন একটা ভাব ধরলেন যেন উনারা কিছুই জানেন না। এই ক*ঙ্কা*ল কার কিংবা এই মোবাইল ফোনগুলো, এই মেয়ের ছবিগুলো কোথা থেকে এলো, যেন সেই সম্পর্কে উনাদের বিন্দুমাত্র ধরাণা নেই। এমন একটা ভাব করছেন যেন এসব দেখে উনারা আকাশ থেকে পড়েছেন। কিন্তু কথায় আছে, সত্যকে হাজার চেষ্টা করেও ঢেকে রাখা যায় না। যেমনটা হয়েছে এখানেও।

রুবি হোসেন খুব কৌশলে অফিসারদের সকল উত্তর দিতে পারলেও, আকবর সাহেব ঠিকই মুখ ফসকে ভুল কথা বলে ফেলেন। যেখানে অফিসার রুবি হোসেনকে যখন জিগ্যেস করেন, সুজানার নিখোঁজ হওয়ার দিনে আকবর সাহেব কোথায় ছিলেন। তিনি তখন জবাবে বলেন, “বাসায়’ই ছিলেন।”

পদ্মফুল পর্ব ২২

আর অন্যদিকে আকবর সাহেবকে সেই একই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তিনি নাকি ঐদিন কোনো এক অফিসিয়াল কাজে শহরের বাইরে গিয়েছিলেন। ব্যস, এখানেই লাগল খটকা। আবার আদিদের কথা শুনে অফিসার জানতে পারেন, সেদিন তার মা বাবা দুজনেই বাসায় ছিলেন। আর আদিদ ছিল হসপিটালে। তো সব মিলিয়ে অফিসারের সন্দেহের তীর গিয়ে বিঁধল এবার আদিদের বাবার উপর…

পদ্মফুল পর্ব ২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.