পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ২

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ২
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

‘আপনি মিথ্যে কেন বললেন?’
পদ্ম ঢোক গিলল। বললো,
‘আ-আমি উনাদের চিনতে চাই না। আমি চাই না ঐ মানুষগুলোর কাছে আবার ফিরে যেতে, চাই না আমি। প্লীজ ডাক্তারবাবু, আমাকে উনাদের কাছ থেকে বাঁচান। প্লীজ, আমায় সাহায্য করুন।’

“ডাক্তারবাবু” সম্বোধন’টা শুনতেই আদিদের বুকের ভেতরটা হঠাৎ যেন কেমন করে উঠল। অনেক দিন পর সে আবার “ডাক্তারবাবু” নাম’টা শুনল। মস্তিষ্কে তখন ভেসে উঠল কিছু সুন্দর পুরোনো স্মৃতি। বুকের বা পাশ’টাই তীব্র ব্যথা অনুভব করলো সে। আদিদ নিজেকে সামলে নিল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘কী সাহায্য চান আপনি? আর কেনই বা আপনি মিথ্যে বলেছেন?’

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ডাক্তারবাবু, আমি আমার মামা মামির কাছে যেতে চাই না। উনারা খুব খারাপ, আমার উপর খুব অত্যাচার করেন। সেই যবে থেকে আমার মা বাবা মারা গিয়েছে ঠিক তখন থেকেই। কখনো উনাদের থেকে আমি এইটুকুও ভালোবাসাও পাইনি। আর..আর এখন উনারা চাইছেন এক মধ্যবয়স্ক লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দিতে। ঐ লোকটাও ভালো না। আমাকে প্রথম দিন দেখতে এসেই আমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিল। আমি ঐ লোকটাকে বিয়ে করবো না ডাক্তারবাবু। প্লীজ, আমাকে একটু সাহায্য করুন। দয়া করে আমাকে কোনো অনাথ আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করে দিন। আমি অনাথ আশ্রমে চলে যাবো। আমি ঐ মানুষগুলোর সাথে থাকতে চাই না।’

পদ্ম’র গাল গড়িয়ে উষ্ণ জল পড়ছে। আদিদ বিস্মিত চোখে চেয়ে আছে। তার এখন কী করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারছে না। অনেকক্ষণ ভেবে সে বললো,
‘এটা তো হয় না। আপনার মামা মামি আপনার গার্ডিয়ান, উনাদের অনুমতি না নিয়ে কী করে আমি আপনাকে কোনো অনাথ আশ্রমে নিয়ে যাবো। চাইলেই তো আর সবকিছু করা যায় না। সবকিছুর’ই একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়মের বাইরে আমি কিছু করতে পারবো না।

সেই অধিকার আমার নেই। তবে আপনি যদি চান তাহলে আমি পুলিশের সাহায্য নিতে পারি।’
‘লাভ নেই, আমি গিয়েছিলাম পুলিশের কাছে। আমার মামা মামি তাদের উল্টো বুঝিয়েছে, উনারাও আমাকে তেমন কোনো সাহায্য করতে পারেননি। কিন্তু তার ফল হয়েছিল ভয়াবহ। মামি আমাকে খুব মারে। মামা যা নয় তা বলে অপমান করে। তারপর থেকে আর সাহস হয়নি পুলিশের কাছে যাওয়ার।

আদিদ নরম সুরে বলে,
‘তবে আমার পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব না। আপনি রেস্ট নিন। আমি নার্সকে পাঠাচ্ছি।’
‘ডাক্তারবাবু!’
পদ্ম’র কন্ঠস্বর আটকে আসে। এত যন্ত্রণা তার আগে কখনো হয়নি। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যথায়। আদিদ ঘুরে তাকায়। পদ্ম’র অক্ষি কোণে টলমল করা জল দেখে আদিদের ও মায়া হয়। তবে তারও তো কিছু করার নেই। ডক্টর হিসেবে পেশেন্টকে সুস্থ করা ছাড়া আর কী দায়িত্ব থাকতে পারে তার প্রতি। কিন্তু মেয়েটার জন্য কিছু করতে পারলে হয়তো তার ভালো লাগতো। কিন্তু..

‘কিছু বলবেন?’
‘একটা লাস্ট অনুরোধ। এইটুকু অনন্ত আমার জন্য করবেন প্লীজ। বাইরে আমার মামা মামিকে গিয়ে বলবেন সত্যি সত্যিই আমার কিছু মনে পড়ছে না। আমি সবকিছু ভুলে গিয়েছি। কিচ্ছু মনে নেই আমার, কারো কথা মনে নেই। প্লীজ, ডাক্তারবাবু এইটুকু আমার জন্য করুন। অনুরোধ করছি আমি আপনাকে, প্লীজ।’
আদিদ খানিক ভেবে বললো,
‘ঠিক আছে।’

আদিদ কেবিন থেকে বের হতেই পদ্ম’র মামা মামি তাকে ঘিরে ধরলো। মামি কর্কশ গলায় বললো,
‘মাইয়ার কী হইছে? ও কী আসলেই সব ভুইলা গেছে? নাকি সব নাটক?’
আদিদ শান্ত গলায় বললো,
‘উনি মিথ্যে বলছেন না। মাথায় আঘাত পাওয়ার জন্য এমন হচ্ছে। চিন্তা করবেন না খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে। কিছুদিন উনাকে রেস্টে রাখলেই হবে।’

আদিদের কথা যেন মামির পছন্দ হলো না। তিনি চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলেন। আদিদ তাদের পাশ কাটিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেল। এই এক পেশার খাতিরে কত ধরনের মানুষ যে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। আর এইসব কিছুর পর তার এখন একটাই কথা মনে হয়, মানুষের চেয়ে বিচিত্র আর ভয়ানক প্রাণী আর একটাও হয় না।

পদ্ম কাঁদছে। তার এই একুশ বছরের জীবনে মা বাবা যাওয়ার পর এমন একটা দিনও যায়নি যেদিন সে একটু প্রাণ ভরে হেসেছে। সে হয়তো ভুলেই গিয়েছে লাস্ট সে কবে একটু আনন্দ করেছিল। প্রত্যেকটা মুহূর্ত এখন তার মৃত্যু যন্ত্রণার মতো কাটে। বার বার কেবল মনে হয় মা বাবা কেন তাকে একা এই পাষাণ দুনিয়ায় রেখে চলে গেল। তাকে কি সাথে নিয়ে যেতে পারলো না। মা বাবা যদি তাদের সাথে তাকেও নিয়ে যেত তাহলে কি আর তাকে এত কষ্ট পেতে হতো? হতো না। সে ভালো থাকতে পারতো। সুখে থাকতে পারতো। এইভাবে তাকে কাঁদতে হতো না।

পদ্ম’র খুব মাথা ধরায় সে চোখ বুজল। তখনই কেউ তাকে এক ঝটকায় শোয়া থেকে টেনে তুলল। পদ্ম’র আঁতকে উঠল। চোখ খুলে মামির মুখটা দেখে বুক কেঁপে উঠল যেন তার। মামি তার ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
‘তোর আমাদের কথা মনে পড়তেছে তাই না? কেন রে কেন মনে পড়তেছে না?

এত দিন যে তোকে এত টাকা খরচ কইরা খাওয়াইয়া পরাইয়া বড়ো করলাম সেই সব তুই ভুইলা গেলি। না, ভুললে তো চলবো না। আমাদের কষ্টের ফল তো তোকে দিতে হইব। ঐ সুলাইমানরে বিয়ে কইরা তোর আমাদের ঋণ মিটাইতে হইব। এসব ভুইলা যাওয়ার নাটক বন্ধ কর। কালই আমাদের সাথে বাসায় যাইবি। তারপর ঐ সুলাইমানরে বিয়ে করবি। আর যদি কোনো নাটক করছিস, একেবারে মেরে তোর ঐ মরা বাপ মা’র কাছে পাঠাই দিমু।’

পদ্ম ভয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। তার মাথা ঘুরাচ্ছে ভীষণ। চোখের সামনে সবকিছু যেন ঝাপসা দেখছে। সে মৃদু গলায় বললো,
‘হাতটা ছাড়ুন, ব্যথা লাগছে।’
মামি তার কথা শুনল না, উল্টো আরো জোরে চেপে ধরলো। পদ্ম তখন গোঙ্গিয়ে উঠল। কেবিনে তখন একটা নার্স ঢুকে এসব দেখে সে জোরে বলে উঠল,
‘কী করছেন কী? হাত ছাড়ুন উনার। উনি অসুস্থ, উনাকে রেস্ট নিতে দিন।’
মামি চেতে উঠে বললো,

‘আমাদের মেয়ের সাথে আমরা যা খুশি তাই করমু। আপনার কী তাতে?’
‘আরে অদ্ভুত! উনি ব্যাথা পাচ্ছেন, দেখছেন না? ছাড়ুন আপনি উনাকে। নয়তো আমি স্যারকে ডাকবো।’
স্যারের কথা শুনে মামি পদ্ম’র হাতটা ছেড়ে দিল। তবে নাক মুখ ফুলিয়ে বললো,
‘ঐসব স্যার টারের ভয় দেখাইয়া লাভ নাই। আমরা ঐসব দুই টাকার ডাক্তাররে ভয় পাই না বুঝছেন। তাড়াতাড়ি মেয়েরে সুস্থ করেন, কালকে যেন আমরা ওরে বাড়ি নিয়া যাইতে পারি।’

নার্সের ভীষণ রাগ হলো। এত অভদ্র কেন মহিলা’টা। ইচ্ছে করছে দু চার কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু এটা হসপিটাল আর সে ডিউটিতে আছে বলে আর কথা বাড়াল না। শান্ত কন্ঠে বললো,
‘স্যারের অনুমতি ছাড়া এখান থেকে একটা পেশেন্টকেও রিলেজ দেওয়া হয় না।’
মামি ফোঁস ফোঁস করতে তার স্বামীকে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়ে বললো,
‘যাও ঐ ডাক্তাররে বইলা আসো আমরা যে কালকে ওরে নিয়া যামু।’

‘আরে কালকের অনুমতি দিবে না বোধ হয়। অন্তত দুই দিন থাকতেই হবে। তার উপর ও আবার সবকিছু ভুলে গেছে। ওকে এই অবস্থাতে ডাক্তার ছাড়বে বলে তো মনে হয় না। আর তাছাড়া..’
‘তুমি না বড্ড বেশি বুঝো। তোমার ভাগ্নী এখানে পইড়া থাকলে তার চিকিৎসার দায় ভার কে নিবে? নিবা তুমি? এত টাকা নাই আমাদের। চুপচাপ গিয়া ডাক্তাররে বলো, আমরা কালকেই ওরে বাসায় নিয়া যামু।’
মামা বিরক্ত হয়ে বললো,

‘ঠিক আছে, বলছি।’
মামা আদিদের কেবিনে গিয়ে দেখলেন কেবিনে কেউ নেই। তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেন। কিন্তু তাও ডাক্তারের কোনো হদিস না পেয়ে তিনি আবার তার বউয়ের কাছে ফিরে গিয়ে বললেন,
‘ডাক্তার তো কেবিনে নেই।’
মামি ব্রু কুঁচকে ফেললেন। বললেন,
‘উফফ, আচ্ছা যাকগে কালকেই এসে একেবারে বইলা নিয়া যামু। এখন চলো বাসায় যাই। আমার ছুটকি দুইটা একা বাসায় ভয় পাইতেছে মনে হয়।’
‘আচ্ছা, চলো।’

আদিদ রিসিপশনে গিয়েছিল। পদ্ম’র যার গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট হয়েছিল তাকে সে চলে যেতে বলেছে। তবে সেই লোকটা ভালো ছিল, যাওয়ার আগে পদ্ম’র কাছে গিয়ে তাকে আর এমন করতে বারণ করেছেন। পদ্মও তখন উনার কাছে ক্ষমা চায়। ওর জন্য অযথা একটা মানুষকে এইভাবে পেরাশানিতে পড়তে হয়েছে ভেবে তার তখন খুব খারাপ লাগছিল।
আদিদ আবার ফিরে এসে খোঁজ নিয়ে দেখল পদ্ম’র মামা মামি চলে গিয়েছেন।

কিন্তু এইদিকে পদ্মকে যে একা থাকতে হবে সেটা তারা একবারও ভাবেননি। ওর ঔষধের প্রয়োজন, খাবারের প্রয়োজন, কাছের মানুষদের যত্নের প্রয়োজন এই মানুষগুলো সেটা বুঝলো না। কী নির্দ্বিধায় ওকে একা ফেলে চলে গেল। মানুষ এতটা নিষ্ঠুর কী করে হয়?

পদ্মফুল পর্ব ১

আদিদ পদ্ম’র কেবিনে গিয়ে দেখল সে চোখ বুজে আছে। সে নার্সকে ডেকে বললো,
‘উনাকে খাবার দিয়ে ঔষধগুলো দিয়ে দিন। উনার বাড়ির লোকেরা চলে গিয়েছেন।’
কথাটা পদ্ম’র কানে যেতেই সে যেন প্রাণ ফিরে পেল। অসুস্থ গলায় বললো,
‘ডাক্তারবাবু, কাল কি আমি চলে যেতে পারবো?’
‘কোথায় যাবেন আপনি?’

পদ্মফুল পর্ব ৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.