পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ৩২

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ৩২
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

একটা রৌদ্রদগ্ধ সকাল। আদালতে মানুষের আনাগোনা ক্রমে ক্রমে বাড়ছে। পদ্ম এই প্রথম এইরকম একটা জায়গায় এসেছে। কত মানুষ আসছে। একেক জনের একেক সমস্যা। পদ্মও তাদের মতোই একজন। তার থেকে অনেকটা দূরে আদিদ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই তার সামনে দিয়ে পুলিশ তার মা বাবাকে ভেতরে নিয়ে গিয়েছেন।

কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এই মানুষটা একবারও তাদের দিকে তাকায়নি। পদ্ম তখন আদিদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু মুখ দেখে তো আর মন পড়া যায় না। তার মনের ভেতরে তখন কী চলছিল সেটা কেবল সেই জানে। পুলিশ কিছুক্ষণ পরে এসে পদ্ম আর আদিদ-কে ভেতরে যেতে বলে। তারা ভেতরে যায়। খুব একটা মানুষ না হলেও আছে কয়জন। পদ্ম আর আদিদ গিয়ে একটা বেঞ্চে বসে। তাদের সামনেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব। দু জনেরই মাথা নত। ছেলের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছেন না হয়তো। আর না সেই সাহস পাচ্ছে আদিদ নিজেও। সেও বসে আছে নত মস্তিষ্কে।

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিছুক্ষণের মাঝেই বিচার কার্যক্রম শুরু হলো। আসামী পক্ষের উকিল নানাভাবে বিচারককে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তার এক পর্যায়ে তখন পদ্ম’কে বলা হলো, সামনে গিয়ে তার বক্তব্য পেশ করার জন্য। মনে ভয় হলেও সে এগিয়ে গেল। তার চোখ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে একবার তাকাল। তারপর সে জোরে দম নিয়ে বলতে লাগল সমস্ত ঘটনা। বিচারক সব শুনে রুবি হোসেন আর আকবর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনারা কি সত্যিই এসব করেছেন?’

রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব স্বীকার করলেন সবকিছু। তাছাড়া আর উপায় নেই। সব প্রমাণ হাতের কাছে। মিথ্যে বলেও কোনো ভাবে বাঁচা যাবে না। পদ্ম কাঠগড়া থেকে নেমে যেতেই এবার আদিদকে ডাকা হলো। আদিদ খুব কষ্টে উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে গিয়ে মনে হলো যেন তার পা আটকে যাচ্ছে। তবু ও সে কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াল। সামনের দিকে তাকাল না। নিজেকে শক্ত করে একে একে বলে গেল সবকিছু। সবশেষে সে বললো,

‘অন্যায়কারী যেন কোনোভাবেই বাঁচতে না পারে জর্জ সাহেব, এটা আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ রইল।’
আদিদের গলা থেমে যাচ্ছিল। এমন একটা দিনও যে কখনো আসবে সেটা সে কখনও কল্পনাও করেনি। তার মতো পাষাণ না হলে কোনো সন্তান হয়তো নিজ মা বাবার শাস্তি চায় না। সে বড্ড খারাপ একটা মানুষ। বুকটা ফেটে গেলেও সে সবকিছু সহ্য করে সেখান থেকে নেমে গিয়ে নিজের জায়গায় বসলো। তারপর একে একে আরো অনেককেই সামনে আনা হলো। অভিও স্বাক্ষী দিল। আরাফাতকেও আনা হলো। তাকে দেখেই পদ্ম’র রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছিল। আরাফাতও তখন সামনে দাঁড়িয়ে সবকিছু স্বীকার করলো।

সব স্বাক্ষী প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত এবার রায় দিল। রুবি হোসেন আর আকবর সাহেবকে আদালত বিশ বছরের জেল দিয়েছে আর আরাফাতকে দিয়েছে ত্রিশ বছরের। সাথে দিয়েছে মোটা অংকের টাকা জরিমানা।
আদালতের রায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আদিদ সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। তার সাথে বেরিয়ে যায় পদ্মও। রুবি হোসেন চলে যাওয়ার আগে ছেলেকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদিদ সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে যায় তার আর পরে খোঁজ পাওয়া যায়নি। অভি তাকে অনেকবার কল দেয় তবে সে কলও রিসিভ করে না।

পদ্ম ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। সে অস্থির হয়ে অভিকে বলে,
‘ডাক্তারবাবু কোথায় গিয়েছেন বলুন তো? ফোন ও তো ধরছেন না। কোনো অসুবিধা হয়নি তো? উনি যেভাবে গাড়ি টান দিলেন।’

‘চিন্তা করো না। আদিদ-কে আমি চিনি। ও আর যাই করুক, কখনো সু*সাইডের মতো কোনো ভুল করবে না।’
‘আমার উনার জন্য খুব খারাপ লাগছে। বারবার কেন যেন মনে হচ্ছে উনার এই কষ্টের জন্য আমি দায়ী।’
‘ধুর বোকা! তুমি কেন দায়ী হতে যাবে? ওর মা বাবা যা করেছেন তার জন্য তো উনাদের শাস্তি পেতেই হতো। সত্যকে কতদিন লুকিয়ে রাখা যায়। একদিন না একদিন তো সেটা সামনে আসবেই। উনাদের এই পরিণতি হওয়ারই ছিল। এখানে কারোর কোনো হাত নেই। ভুল করলে শাস্তি পেতেই হবে, এটাই নিয়ম।’

তারপর দুজনেই কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করলো। সেই নিরবতা কাটিয়ে তখন এক পর্যায়ে অভি বললো,
‘তো, তুমি কী ভাবলে? কোথায় যাবে?’
পদ্ম পিটপিট করে তাকাল। গম্ভীর গলায় বললো,
‘জানি না।’
‘আমার আশ্রমে গেলে কি তোমার খুব অসুবিধা হবে?’
‘না, কিন্তু..আসলে..’

‘বুঝতে পেরেছি। বিশ্বাস করতে পারছো না আমায়, তাই তো?’
‘না না, তা না। আসলে একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।’
‘অস্বস্তির কী আছে? সেখানে তোমার সমবয়সী আরো অনেক মেয়ে আছে। তাদের সাথে সময় কাটালে তোমার ভালো লাগবে।’
পদ্ম খানিকটা নিরব থেকে বললো,

‘ঠিক আছে তাহলে, আমায় নিয়ে চলুন।’
অভি খুশি হলো। বললো,
‘ওকে। তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।’
গাড়ি আসতেই পদ্ম আবার বললো,
‘ডাক্তারবাবুকে একবার বলবো না?’
‘আদিদ জানে। আমি ওকে বলে রেখেছিলাম।’
‘ওহহ।’
অভি গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললো,
‘নাও, এবার তুমি গাড়িতে উঠো।’

পদ্ম গাড়িতে গিয়ে বসলো। যতটা না তার অস্বস্তি হচ্ছে তার থেকে বেশি হচ্ছে ভয়। এত এত বিপদের সম্মুখীন সে হয়েছে যে এখন চারদিকে খালি বিপদই দেখে সে। নিজেকে শান্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে সে। তবু পারছে না। মন শান্ত হচ্ছে না। মেকি ভয়ে বারবার আড়ষ্ট হচ্ছে। পদ্ম চোখ বুজে ঝিম ধরে বসে থাকে। অভি একবার আড়চোখে তাকায় তার দিকে তারপর আবার সামনের দিকে তাকিয়ে তার ড্রাইভিং এ মনোযোগ দেয়।

পৌঁছতে খানিকটা সময় লেগেছে তাদের। গাড়ি থেকে নেমেই পদ্ম দেখল তার চোখের সামনে বিশাল এক জায়গা। যার চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু ছোট ছোট বাঁশের ঘর। বাঁশের ঘর এইজন্যই যে সেগুলো সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা হলেও ছাদ দিয়েছে বাঁশ দিয়ে। দেখতে অদ্ভুত হলেও সুন্দর। কিছুক্ষণের মাঝেই সেখানে অনেক মানুষ চলে এলো। অনেকগুলো মেয়ে সাথে দুজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। মহিলা দুজন এসেই অভিকে বললেন,

‘যাক এতদিনে তবে তোমার পায়ে ধুলো পড়েছে তাহলে। ভেবেছিলাম, হয়তো আমাদের ভুলেই গিয়েছো। তোমাকে দেখে এখন কিছুটা শান্তি পাচ্ছি।’
অভি হাসল। বললো,
‘তোমাদের কি ভুলা সম্ভব? তোমরা তো হলে আমার দ্বিতীয় মা। ভালো আছো তো তোমরা? আর এইদিকে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’

‘হ্যাঁ, আমরা খুব ভালো আছি আর এইদিকেও সবকিছু ঠিকঠাক। আচ্ছা, ঐ মেয়েটা কে?’
অভি পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ও হলো পদ্ম। ও আজ থেকে এখানেই থাকবে। ডানদিকে বাগানের দিকে যে রুমটা আছে, সেটাতেই ওর থাকার ব্যবস্থা করো।’

‘আচ্ছা আমরা ব্যবস্থা করে নিচ্ছি। তার আগে ওকে নিয়ে তুমি ভেতরে এসো।’
সবাই ভেতরে গেল। এই দুজন মহিলাই মূলত এখানের দেখভাল করেন। বেশ ভালো উনারা। উনাদের সাথে কথা বলে পদ্ম’র খুব ভালো লাগল। যদিও সে এখনও ততটা নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। কারণ মানুষ গিরগিটির চেয়েও ভয়নাক, তাই এত সহজেই কাউকে বিশ্বাস করতে নেই।

পদ্ম’র রুম ঠিক করে দেওয়া হলো। অন্যসব মেয়েরাও পদ্ম-কে বেশ সাদরে গ্রহণ করলো। তারা পদ্ম-কে একটা সাদা রঙের সুতি শাড়ি দিয়ে বললো, “ফ্রেশ হয়ে এটা পরে আসতে।” সাদা রঙ খুব একটা পছন্দ না হলেও পদ্ম শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। সে মেয়েদের মুখে শুনেছে, এখানে আসলে প্রথমদিন নাকি সবাইকে শাড়ি পরানো হয়। আর এই নিয়ম নাকি ঐ দুই মহিলার। তাদের শাড়ি পরা পছন্দ বলে তারা সব মেয়েদেরই প্রথম দিন শাড়ি পরতে বলেন। তবে কেউ যদি পরতে না চায় তবে তাদের জোর করেন না। কারণ এখানে কারোর জোর জবরদস্তি চলে না। এখানে সবাই নিজের মতো স্বাধীন।

শাড়ি পরে বাইরে বের হলো পদ্ম। বসার রুমে অভি বসে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছে। পদ্ম আসতেই তার চোখ পরল পদ্ম’র উপর। কপালে ভাঁজ পড়ল তার। সুতি সাদা শাড়ি। ভেজা চুল। বিষন্ন মুখ। সৌন্দর্য বুঝি এর থেকে আর তীব্র হতে পারে না। অভি চোখ নামিয়ে নেয়। প্রেম বড়ো ভয়ানক জিনিস। সে এই বুড়ো বয়সে আর প্রেমে পরতে চায় না। সে শান্ত গলায় বললো,

‘বসো পদ্ম।’
পদ্ম অন্যসব মেয়েদের মতো ফ্লোরে বসে পড়ল। সেটা দেখে অভি মুচকি হাসল আর মনে মনে বললো,
“এমন ভালো আর সহজ সরল মেয়েকেই তো প্রত্যেকটা ছেলে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়।”

দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে অভি আর পদ্ম বাইরের বাগানে হাঁটছিল। অভি তাকে এখানকার বিভিন্ন জিনিস চেনাচ্ছিল। তাছাড়া এটা ওটা বোঝাচ্ছিল। তাকে আশ্বাস দিচ্ছিল যেন ভয় না পায়। আর সে সময়ই অভির একটা কল আসে। সেটা রিসিভ করে কিছুটা সময় পার হতেই অভি চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘এসব কী বলছেন? কখন হলো এসব?’
অভির অস্থিরতা দেখে পদ্মও ভয় পেয়ে গেল। অভি ফোন রেখেই বললো,
‘সর্বনাশ হয়েছে!’

পদ্মফুল পর্ব ৩১

পদ্ম অস্থির গলায় বললো,
‘কী হয়েছে?’
অভি বিচলিত হয়ে বলে,
‘আদিদের এক্সিডেন্ট হয়েছে।’

পদ্মফুল পর্ব ৩৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.