পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ৩৩

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ৩৩
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

হসপিটালে গিয়ে আদিদ-কে দেখে অভি আর পদ্ম থমকে গেল। অভি ছুটে গেল আদিদের বেডের কাছে। মাথায় আর হাতে তার ব্যান্ডেজ করা। ডাক্তার বললো তার নাকি জ্ঞান এখনও ফেরেনি। মাথার আঘাত’টা বেশ গভীর ছিল।
পদ্ম দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে। আদিদের এক্সিডেন্টের কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল তার। আদিদের কিছু হলে সে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতো না।

অভি আদিদের হাত জড়িয়ে ধরে তার পাশে বসে থাকে। আদিদ-কে এর আগে এতটা অসহায় কখনো মনে হয়নি তার। সেই সুদর্শন, সুঠাম পুরুষ মানুষটা আজ কতটা অসহায় হয়ে বেডে শুয়ে আছে। ভালো মানুষগুলোর সাথেই কেন এত খারাপ হয়? দুনিয়াতে তো এত এত খারাপ মানুষ, কই তাদের সাথে তো কখনো কোনো খারাপ কিছু হয় না। যত কষ্ট শুধু ভালোদেরই পেতে হয়। এটাই নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিষ্ঠুর নিয়ম।

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাতে আদিদের জ্ঞান ফিরল। আদিদ চোখ মেলে তাকিয়েছে দেখে পদ্ম’র যেন খুশির অন্ত রইল না। সে দ্রুত বাইরে গেল। অভি বাইরে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিল। পদ্ম ছুটে গিয়ে বললো,
‘ডাক্তারবাবুর জ্ঞান ফিরেছে।’
অভি ফোন রেখে দ্রুত কেবিনের ভেতর ঢুকল। আদিদের ঘোলা দৃষ্টি প্রথমেই অভির মুখে পড়ল। তাকে আলতো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘আমার কী হয়েছিল?’
অভি কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
‘তুই এক্সিডেন্ট করেছিলি। কে বলেছিল অত স্পিডে গাড়ি চালাতে? আজ যদি তোর কিছু একটা হয়ে যেত? তোর উপর তো আমার খুব ভরসা ছিল। ভেবেছিলাম তুই খুব স্ট্রং। আর যায় হয়ে যাক না কেন, নিজের কোনো ক্ষতি হতে দিবি না। কিন্তু তুই তো আমার ভরসার যোগ্য’ই না। শালার, মরার শখ হয়েছিল না?’

আদিদ জবাব দেয়না। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে কেবল। অভি মুখ ঘুরিয়ে বললো,
‘এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তোকে দেখে আমার একটুও মায়া হচ্ছে না, বুঝেছিস? পড়ে থাক তুই, আমি আর তোকে দেখতে আসবো না।’

আদিদ তাও কিছু বলে না। মাথাটা ঘুরিয়ে সে এবার পদ্ম’র দিকে তাকায়। পদ্ম বিষন্ন মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আদিদ জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। তারপর মৃদু সুরে বলে,
‘আমি মা*রা গেলেই বা কী হতো? বেঁচে থাকা মানেই নিজের কষ্ট বাড়ানো। তার থেকে ম*রে যাওয়াটাই শ্রেয়।’
অভি তার দিকে তেড়ে এলো। বজ্র কন্ঠে বললো,
‘তুই না ডক্টর? তোর মুখে কি এসব মানায়? কেন বলছিস এসব? আমি কি তোর কেউ না? আমায় বুঝি তুই একটুও ভালোবাসিস না?’

আদিদ মুচকি হেসে চোখ বুজে। তখন চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল’টা অভি আর পদ্ম’র দৃষ্টিগোচর হয়। আদিদ চোখ বুজা অবস্থাতেই তীব্র ঝাঁঝাল গলায় বলে,
‘আমার মা বাবার কথা এত কেন মনে পড়ছে? আমি কেন উনাদের ভুলতে পারছি না? আমি তো উনাদের মনে রাখতে চাই না। তাও কেন…কেন বার বার আমার উনাদের কথাই মনে পড়ছে? কেন..কেন..কেন?’

আদিদ থামে। জোরে শ্বাস টানে। দম আটকে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ তখন তার কর্ণকুহুরে কারো তীক্ষ্ণ কান্নার স্বর প্রবেশ করে। আদিদ বিস্মিত চোখে তাকায়। পদ্ম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আদিদ তার ব্রু কুঁচকে ফেলে। বিরক্ত গলায় বলে,
‘এই মেয়েটা কেন কাঁদছে?’
পদ্ম নাক টানে। ধরা গলায় বলে,

‘এই সব কিছুর জন্য আমি দায়ী, ডাক্তারবাবু। আমি আসার পর থেকেই আপনার জীবনে সমস্যা শুরু হয়েছে। সব দোষ আমার। আমার কারণেই হয়েছে এসব।’
এই বলে সে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে আরম্ভ করে। আদিদ আর অভি এক জন অন্যজনের মুখের দিকে তাকায়। আদিদের মেজাজ বিগড়ে যায়। এমনিতেই মাথা টাথা তার ঠিক নেই, এখন আবার এই মেয়ের কান্নার শব্দে তার আরো বিরক্ত লাগছে। তাই সে রাগী গলায় বলে,

‘আপনি থামবেন। আমি কি একবারও বলেছি, এসবে আপনার হাত আছে? অযথা কেন আমায় বিরক্ত করছেন? আপনার জন্য কিছুই হয়নি। যা হয়েছে তা সব ভাগ্যের দোষে হয়েছে। তাই নিজেকে এইভাবে দোষ দেওয়া বন্ধ করুন।’
পদ্ম শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছল। তারপর ঢোক গিলে বললো,

‘আমি জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে। মা বাবা ছাড়া কোনো সন্তানই ভালো থাকতে পারে না। এই তো আমি, প্রতিটা জায়গায় জায়গায় এতটা অপমান এতটা কষ্ট সহ্য করছি তাও সবকিছু মেনে নিচ্ছি কষ্ট করে। কারণ আমি এতিম, আমার মা বাবা নেই, যাওয়ার মতো কোনো আশ্রয় নেই। আর তার থেকেও বড়ো কথা হলো, আমি মেয়ে। আমি চাইলেই সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে পারবো না।

কারণ এই পৃথিবী আমার জন্য সেইফ না। কিন্তু, আপনি সেটা পারবেন। যেভাবে খুশি যার সাথে খুশি থাকতে পারবেন। কেউ আপনাকে কিচ্ছু বলবে না। আপনিও অসহায় তবে আমার মতো না। কারণ আপনি ছেলে, আপনি একজন ডক্টর। আপনার পাশে কেউ না থাকলেও আপনি ঠিক একা একাই চলতে পারবেন। কারো সাহায্যের আপনার তেমন প্রয়োজন হবে না। কিন্তু, এই ক্ষেত্রে গিয়ে আমি আটকে যাবো। আমি একা চলতে পারবো না। একা থাকতে পারবো না।

আমাকে বাঁচতে গেলে অন্যের সাহায্য নিতে হবে। নিজেকে সবকিছু থেকে সেইফ রাখতে হলে আমাকে কারো না কারোর উপর নির্ভর করে থাকতেই হবে। আমি তাতে বাধ্য। কারণ..ঐ যে আমি মেয়ে। আজ আমার সাথে এত কিছু হয়ে গেল..তাও আমি বেঁচে আছি। বেঁচে থাকতে হচ্ছে আমাকে। ম*রে যেতে চাইলেই তো আর ম*রে যাওয়া যায় না। তাই আমাকেও বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। আর আপনাকেও এইভাবেই বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। এছাড়া আর কিছু করার নেই আমাদের।’

পদ্ম থেমে নিশ্বাস ফেলল। অনেক কিছু বলে ফেলেছে সে। তার কথা শুনে অভি আর আদিদ দুজনেই চুপ হয়ে আছে। ওদের এই চাহনি দেখে পদ্ম’র কিছুটা অস্বস্তি লাগে। সে হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘বেশি কথা বলে ফেলেছি, তাই না?’
পদ্ম’র কথা শুনে অভি হেসে বলে,

‘না, বেশি কথা বলোনি। যা বলেছো ঠিক বলেছো। তবে তোমরা কেউ মোটেও অসহায় না। পৃথিবীতে কেউই অসহায় না। সবার পাশেই সৃষ্টিকর্তা আছেন। তাই নিরাশ হওয়া যাবে না। উনি কখন কীভাবে মানুষকে পরীক্ষা নেন সেটা কেউ জানে না। তাই সবসময় ধৈর্য ধরতে হবে। তোমাদের দু’জনকেই বলছি, মাথা থেকে সব উল্টা পাল্টা চিন্তা দূর করে এবার নতুন করে বাঁচতে শেখো।’

আদিদ খানিকটা হাসার চেষ্টা করলো। বললো,
‘সবাই দেখি খুব কথা শিখেছে। শুধুই আমিই কিছু বলতে পারিনা। ডাক্তার হতে এত এত মোটা মোটা বই মুখস্ত করলাম তাও তোদের মতো এত সুন্দর কথা শিখতে পারলাম না।’
আদিদের কথা শুনে অভি আর পদ্ম হাসে। আদিদ তখন হুট করেই অভিকে জিজ্ঞেস করে,

‘তা, বিয়ে করছিস কবে? আন্টির সাথে কথা হয়েছে?’
তারপর সে আবার পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললো,
‘পদ্ম, আপনার কী মত এই ব্যাপারে?’
পদ্ম ঠিক বুঝলো না। সে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললো,
‘কোন ব্যাপারে?’
আদিদ প্রসন্ন হেসে বললো,

পদ্মফুল পর্ব ৩২

‘আপনার আর অভির বিয়ে ব্যাপারে। এখন তো এই বিয়ে খাওয়ার জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে তাই না?’
পদ্ম’র চোখ মুখ কুঁচকে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কপালে চওড়া ভাঁজ পড়ল তার। কাট কাট গলায় বললো,
‘আমি কেন উনাকে বিয়ে করতে যাবো?’

পদ্মফুল পর্ব ৩৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.