পদ্মফুল পর্ব ৩৫
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
শীত শেষে এবার বসন্তের ডানা মেলার পালা। পুরো দমে সে প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রকৃতিতে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে। শীতের দাপটে নেতিয়ে পড়া গাছগুলো এবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। ডালে ডালে নতুন পাতা জন্মাচ্ছে। সেই সাথে জন্মাচ্ছে রঙ বেরঙের ফুল। তাদের সৌন্দর্য প্রকৃতি মুগ্ধ হচ্ছে।
চোখ জুড়াচ্ছে শহরের মানুষগুলোর। আর তারই ধারায় শহর জুড়ে প্রস্তুতি চলছে বসন্ত বরণের। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণগুলো নতুন রঙে সেজে উঠছে। ছাত্র ছাত্রীগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের সাজগোজ আর সাংস্কৃতিক কাজগুলো নিয়ে। আর সেই সুরেই টং এর দোকানের হালিম চাচার ভাঙ্গাচুরা রেডিও তে বাজছিল, ” বসন্ত এসে গেছে…বসন্ত এসে গেছে..”
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
৪’ঠা বসন্ত, ১৪২৯। সুন্দর একটা সকাল। বাইরে মিষ্টি রোদ। অন্যদিন গুলোর মতোই সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও আজকের দিনটা একটু বেশিই সুন্দর। মায়া আশ্রমের মানুষগুলো আজ সকাল থেকে একটু বেশিই ব্যস্ত। কেউ রান্না নিয়ে দৌড়া দৌড়’ই করছে তো কেউ আবার ঘর দোর পরিষ্কার করতে নেমেছে। সকালে ঘুম ভাঙতেই পদ্ম দেখতে পেল সকলের ব্যস্ততা। কিছুটা অবাক হলো সে। বড়ো বড়ো হাই তুলে সে বড়ো লিভিং রুম’টা তে গেল। তার রুমমেটরা সবাই এখানে। পদ্ম সবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কী ব্যাপার আপু, সবাই আজ সকাল থেকে এত কাজ করছে কেন? আজ কিছু আছে নাকি?’
মেয়েগুলোর মধ্যে থেকে একজন বললো,
‘সেকি তুমি জানো না?’
পদ্ম মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘না তো। কী আজকে?’
‘আজকে অভি ভাইয়ের জন্মদিন।’
‘ওমা তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। প্রতি বছর উনার বার্থ ডে তে আমরা অনেক আনন্দ করি। এবার ও তাই সকাল থেকে সব প্রস্তুতি চলছে।’
পদ্ম খুশি খুশি গলায় বললো,
‘ঠিক আছে তাহলে, আমি এক্ষুণি ফ্রেশ হয়ে এসে তোমাদের কাজে হেল্প করছি।’
পদ্ম সহ বাকি সব মেয়েরা বাগানে গেল। সেখান থেকে তাজা ফুল নিয়ে তারা রুম সাজাবে। অভির আর্টিফিসিয়াল ফুল একদমই পছন্দ না। তাই তাকে খুশি করতে এত আয়োজন। বসন্তের শুরু। ফুলে ফুলে ভরে গেছে বাগান। কী নিদারুণ তাদের সৌন্দর্য। বেশ ফুরফুরে মেজাজে মেয়েগুলো ফুল তুলছে। হঠাৎ তার মধ্যে থেকে একটা মেয়ে বলে উঠল,
‘এই সবাই দেখো, অভি ভাইয়ের হ্যান্ডসাম ডাক্তার বন্ধু চলে এসেছে। চল উনাকে ফুল দিয়ে স্বাগতম জানাই।’
তার জবাবে আরেকটা মেয়ে ধমক দিয়ে বললো,
‘মাথা খারাপ হয়েছে তোর? দেখছিস না আপা আছে সাথে। তোর জন্য সবাইকে বকা খেতে হবে।’
ওদের কথা শুনে ব্যাপারটা দেখার জন্য পদ্ম গেইটের দিকে তাকাল। দেখল আদিদ এখানকার আপার সাথে কথা বলতে বলতে ভেতরে ঢুকছে। এতগুলো দিন পর আদিদকে দেখে পদ্ম বিস্মিত হলো। নিষ্প্রভ হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। এই পাঁচ মাসে মানুষটা অনেকটাই বদলেছে। নিজের হয়তো আর তেমন যত্ন নেয় না। চোখগুলো কেমন বসে গেছে। চুল দাঁড়ি যে বড়ো হয়েছে সেদিকেও হয়তো তার খেয়াল নেই। মুখটাও খুব ফ্যাকাশে লাগছে। হয়তো ঠিক মতো খাওয়া দাওয়াও করছে না।
আদিদ বাগানের পাশ দিয়েই যাওয়ার সময় হঠাৎ থামল। ঘাড়া ঘুরিয়ে পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে আলতো হাসল সে। নরম গলায় সুধাল,
‘কেমন আছেন, পদ্ম?’
পদ্ম হাসার চেষ্টা করলো। বললো,
‘ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
‘আমিও ভালো আছি।’
‘আচ্ছা। আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন।’
‘ঠিক আছে।’
তারপর ওরা ভেতরে চলে গেল। তখন সেই মেয়েটা বললো,
‘খালি পদ্ম আপুকেই জিজ্ঞেস করলো। আমাদেরও একটু ভালো খারাপ জিজ্ঞেস করলে কী হতো?’
আবার তার পাশের মেয়েটা তাকে ধমক দিল। বললো,
‘উনি পদ্ম-কে চেনে তাই ওর সাথে কথা বলেছে। আমাদের কি চেনে যে আমাদের সাথে কথা বলবে? এত বেশি পকপক না করে এখন তাড়াতাড়ি ফুল তুল।’
মেয়েটা মন খারাপ করে আবার ফুল তুলতে লাগল।
বেশ অনেক ফুল তুলেছে তারা। অনেকগুলো ঝুড়ি হয়েছে। সেগুলো নিয়ে একে একে সবাই ভেতরে গেল। লিভিং রুমেই আদিদ বসা ছিল। আর তার সাথে বসে কথা বলছিল এই আশ্রমের মহিলা পরিচালিকা দুজন। ডিস্টার্ব হবে ভেবে কেউ কোনোরূপ শব্দ না করে ভেতরে যাচ্ছিল। কিন্তু এর মাঝেই আবার ঐ মেয়েটি বলে উঠল,
‘ডাক্তার সাহেব, দেখুন আমরা অনেক ফুল তুলেছি। আপনার কি কোনো ফুল লাগবে?’
ওর কথায় বাকি মেয়েগুলো থমকে গেল। তারা জিহ্বায় কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পদ্ম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। ষোল বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে, চোখ পড়েছে তার উনত্রিশ বছরের এক পুরুষের উপর। এই বয়সে চোখে সবাইকেই সুন্দর লাগে, আকর্ষণীয় লাগে। এই মেয়েটার কাছেও হয়তো আদিদ-কে তেমনি লাগছে। সেখানকার আপা দু’জন বিরক্ত হয়ে তাকালে অন্য মেয়েগুলো বলে উঠল,
‘এই রাণী চলতো।’
মেয়েটা তো গেলই না। উল্টো সে আরো আদিদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। উদ্বেগ নিয়ে বললো,
‘কী হলো, আপনি কিছু বলছেন না কেন? আপনার কি ফুল পছন্দ না?’
আদিদ মুচকি হেসে বললো,
‘পছন্দ।’
মেয়েটা খুশি হলো খুব। উত্তেজিত গলায় বললো,
‘কোন ফুল প্রিয় আপনার?’
আপা খানিকটা রাগি গলায় বললেন,
‘উনাকে বিরক্ত কেন করছো রাণী। অভি শুনলে কিন্তু খুব রাগ করবে।’
মেয়েটা মুখ কালো করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিদ বললো,
‘না না, আমি বিরক্ত হচ্ছি না।’
সে আবার মেয়েটার দিকে তাকাল। বললো,
‘আমার পদ্ম ফুল পছন্দ।’
কথাটা শুনে পদ্ম বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল। আদিদেরও হঠাৎ মনে হলো, এখানে পদ্ম ফুল বলাটা হয়তো তার ঠিক হয়নি। পদ্ম সামনে আছে বলে সে অস্বস্তিতে পড়ে গেল খুব। রাণী হেসে বললো,
‘আমার কাছে তো এখন পদ্ম ফুল নেই তবে গোলাপ ফুল আছে। নিবেন?’
আদিদ হালকা হেসে জবাব দিল,
‘না, এগুলো সব অভির জন্য রেখে দাও। আমার এখন ফুল লাগবে না।’
রাণী ঠোঁট উল্টে বললো,
‘আচ্ছা।’
তারপর সে সেখান থেকে চলে গেল। রাণী রুমে ঢুকতেই সবগুলো মেয়ে তাকে ইচ্ছে মতো বকলো। কেবল পদ্ম’ই তাকে কিছু বললো না। তার তো ভালো লাগছে। যখন থেকে সে শুনেছে আদিদের পদ্ম ফুল পছন্দ তখন থেকেই কেন যেন মনটা তার খুশিতে লাফাচ্ছে। পদ্ম ফুল তো তারও পছন্দ। তার নামের সাথে নাম মিলে বলে না, এমনিতেই এই ফুলটা তার পছন্দ। আজকে রাণী না জিজ্ঞেস করলে সে কখনো জানতেই পারতো না যে ডাক্তারবাবুরও পদ্ম ফুল পছন্দ। ভাগ্যিস, রাণী জিজ্ঞেস করেছিল…
আজকে দুপুরে অনেক কিছু রান্না করা হলো। আদিদ পুরোটা সময় এখানেই ছিল। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সে পদ্ম-কে ডেকে আনল। পদ্ম এলো। বললো,
‘ডেকেছিলেন আমায়?’
আদিদের তাকাল তার দিকে বললো,
‘হ্যাঁ, বসুন।’
পদ্ম অন্য একটা সোফায় বসলো। আদিদ তারপর বললো,
‘আজকে যে অভির জন্মদিন, সেটা জানেন নিশ্চয়ই?’
পদ্ম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। আদিদ বলে,
‘ওর জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিব বলেই আমি এখানে এসেছি। ও জানে না আমি যে এখানে আছি। সন্ধ্যার দিকে ও হয়তো এখানে আসতে পারে। আমি এর মাঝেই ওর জন্য ছোট্ট একটা আয়োজন করতে চাইছি। এখন তার জন্য আমার আপনাদের সবার হেল্প লাগবে। কারণ আমার এসবের ব্যাপারে খুব একটা আইডিয়া নেই তো, তাই।’
পদ্ম উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
‘সমস্যা নেই। আমরা সবাই আপনাকে সাহায্য করবো।’
‘আচ্ছা। আর আমার তার জন্য কিছু কেনাকাটাও করতে হবে, আসলে এইবার হয়তো লাস্ট বারের মতো আমি ওর বার্থ ডে সেলিব্রেট করতে পারবো। কারণ কয়েক মাসের মধ্যেই আমি দেশের বাইরে চলে যাবো…একেবারের জন্য। আর সেখানের’ই একটা হসপিটালে আমি ডক্টর হিসেবে জয়েন করবো। তাই ভাবছি শেষ বারের মতো ওর বার্থ ডে টা আমি আমার নিজের মন মতো করে যাই। আর তাই চাই, যেন খুব গুছিয়ে সব কিছু হয়। আচ্ছা, আপনি কি এখন ফ্রি আছেন? যেতে পারবেন আমার সাথে?’
পদ্মফুল পর্ব ৩৪
পদ্ম মাথা নিচু করে বললো,
‘জ্বি, পারবো।’
‘ঠিক আছে তাহলে, আপনি তৈরি হয়ে আসুন; আমি গাড়ি বের করছি।’
আদিদ উঠে বাইরে গেল। পদ্ম শুকনো মুখে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বললো,
“ডাক্তারবাবু একেবারের জন্য চলে যাবেন…কেন?”