পদ্মফুল পর্ব ৪০
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
দেখতে দেখতে চলে গেল পাঁচ’টা বসন্ত।
আরেকটা গ্রীষ্মের সকাল। চারদিকে ধু ধু রোদ্দুর। সেই রোদ্দুরেই গায়ে একটা সুতি শাড়ি জড়িয়ে এক রমণী ছুটল তার গন্তব্যে। যাওয়ার পথে টঙের কাছে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা ও গলাধঃকরণ করলো সে। এই গরমে কেউ চা খায়? সেই প্রশ্নের জবাব তার মাঝে নেই। কারণ, আজকাল চা ছাড়া তার চলেই না।
একটা রিক্সা কোনোভাবে ম্যানেজ করেই দ্রুত ছুটল সে। পনেরো মিনিটের রাস্তা জ্যামের কারণে আধ ঘন্টায় পার করতে হলো। প্রচন্ড গরমে ঘেমে গেয়ে একাকার সে। কোনো রকমে রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে ছুটল সামনের দিকে।
বাচ্চাগুলো তার জন্য অপেক্ষা করছে সেই কখন থেকে। সে এসেই জিভে কামড় দিল। কান ধরে বললো,
‘সরি রে আজও লেইট হয়ে গিয়েছে। আসলে হয়ে কী..’
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘থাক, আপনার আর এক্সকিউজ দিতে হবে না। যেদিন থেকে এখানে এসেছেন সেদিন থেকেই আপনার একের পর এক সমস্যা শুনেই যাচ্ছি। নেহাতই অভি বলেছে, তাই কিছু বলতে পারছি না। নয়তো আপনার মতো সময় জ্ঞানহীন মেয়েকে কখনোই আমি এখানে রাখতাম না।’
কথাটা বলেই লোকটা তার সামনে থেকে চলে যায়। পদ্ম হাসে। এ আর নতুন কী! এখানে আসার পর থেকেই এই লোকের রাগ সে সহ্য করছে। তার মাথায় আসে না, এত রাগ নিয়ে কী করে একটা মানুষ বেঁচে থাকে। কিছু থেকে কিছু হলেই, চেঁচিয়ে সারা বাড়ি মাথায় তুলেন।
বাচ্চাগুলো পদ্ম-কে নিশ্চুপ থাকতে দেখে মন খারাপ করে বলে,
‘তোমার কি মন খারাপ হইছে, আপা?’
পদ্ম তাদের দিকে তাকায়। হেসে বলে,
‘কই না তো। মন খারাপ হবে কেন?’
সেখান থেকে একটা বাচ্চা মেয়ে বলে উঠে,
‘স্যার সবসময় খালি তোমারে বকে। স্যার’টা একটুও ভালো না।’
পদ্ম বড়ো বড়ো চোখ করে বলে,
‘এইভাবে বলতে হয়না বাবু। স্যার তো আর আমাকে এমনি এমনি বকে না। দেখো না, আমি প্রতিদিন লেইট করি তাই তো স্যার আমার উপর রাগ করেন। আর আমার তাতে একটুও মন খারাপ হয় না, বুঝেছো সোনা? আচ্ছা, এখন এসব বাদ দিয়ে বলো আমরা কোথায় ছিলাম? আজ আমাদের কী পড়ার কথা ছিল?’
আরেকটা ছেলে বললো,
‘আপা, আজকে ক খ পড়াবেন বলছিলেন।’
‘ঠিক আছে, তাহলে শুরু করি।’
পদ্ম বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করলো। তার কথা আড়াল থেকে সেই লোকটি শুনছিল। লোকটি মাঝে মাঝে অবাক হয়, মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেন? এত রাগ দেখানোর পরও তার মাঝে বিন্দুমাত্র খারাপ লাগা কাজ করে না। কতটা আদর দিয়ে বাচ্চাগুলোকে পড়ায় যেন নিজের সন্তান। মেয়েটাকে যত দেখছে ততই যেন সে তার আরো গভীরে চলে যাচ্ছে।
বাচ্চাগুলোকে ছুটি দিয়ে পদ্ম তার ব্যাগ গোছাচ্ছিল। তখনই পেছন থেকে নরম গলায় কেউ তাকে ডাকল। পদ্ম পেছন ফিরে তাকিয়ে বললো,
‘স্যার, আপনি? কিছু বলবেন?’
লোকটি ইতস্তত কন্ঠে জবাব দিল,
‘আ’ম সরি, পদ্ম। আমি হয়তো সবসময় আপনার সাথে একটু বেশিই রাগ দেখিয়ে ফেলি। আসলে ছোট বেলা থেকেই আমি এমন। খুব টাইম মেইনটেইন করে চলি। আর কেউ যদি সময়মতো কিছু না করে তখন আমার খুব রাগ হয়। আর সেই রাগ সহ্য করতে না পেরে এইভাবে চেঁচিয়ে উঠি। আমি জানি এটা ঠিক না। কিন্তু আমি পারি না নিজেকে কন্ট্রোল করতে। আ’ম সরি পদ্ম, আ’ম এক্সট্রিমলি সরি।’
পদ্ম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যেন। ঠোঁটের কোণে শুকনো হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
‘আপনি এইভাবে কেন বলছেন, স্যার? দোষ’টা তো আমার। আমি একেবারেই ইররেগুলার। একদিনও টাইম মতো আসতে পারিনা। আসলে স্যার, রাত জেগে ব্লকের কাজ করি বলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে লেইট হয়ে যায় আর তাই এখানে আসতেও লেইট হয়ে যায়। আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে আমাকে টাটা বাই বাই করে দিত। আপনি ভালো মানুষ বলে এখনো আমাকে সহ্য করে আছেন। ধন্যবাদ স্যার। আমার কাল থেকে আর লেইট হবে না, একেবারে সিউর।’
লোকটি হাসল। বললো,
‘আমি জানি কাল আপনার আবার লেইট হবে। আর আপনি কালও এসে এই একি কথাই বলবেন।’
পদ্মও হেসে ফেলল তার কথায়। তারপর লোকটি বললো,
‘আচ্ছা তাহলে, যান এবার। কাল আবার দেখা হচ্ছে, আল্লাহ হাফেজ।’
এই বলে সে সেখান থেকে চলে গেল। পদ্ম তার ব্যাগ গুছিয়ে নিজের পরের গন্তব্যের দিকে রওনা দিল।
গোসল সেরে বেরিয়ে দেখল চার’টা বাজে। পদ্ম দ্রুত তখন রান্নাঘরে গিয়ে খাবার বাড়তে লাগল। খেতে খেতেই মেয়েরা চলে আসবে। উফফ, আজকে মার্কেটে না গেলেই হতো, তাহলে আর এত লেইট হতো না তার। সে তাড়াহুড়ো করে খাচ্ছিল। তখন তার সামনে একটা মেয়ে এসে বললো,
‘আহ আপু, আস্তে খাও না, গলায় লাগবে তো।’
পদ্ম ভরা মুখে বললো,
‘আস্তে খাওয়ার সময় নেই রাণী, মেয়েরা চলে আসবে।’
‘তো কী হয়েছে, ওরা না হয় একটু বসবে। তুমি আস্তে ধীরে খাও তো। নয়তো গলায় খাবার আটকে আবার আরেক বিপদ বাঁধবে।’
রাণীর কথায় পদ্ম আস্তে আস্তেই খেল। মেয়েরাও কিছুক্ষণের মাঝে চলে আসে। পদ্ম আস্তে ধীরে সবকিছু গুছিয়ে তাদের সামনে গিয়ে বসে। রাণীকে ডেকে তার রং আর কাঠের ব্লকগুলো আনতে বললো। সে সেগুলো নিয়ে এসে নিচে পদ্ম’র সাথে পাটিতে বসে পড়ল।
পদ্ম কিছু মেয়েকে ব্লক প্রিন্টের কাজ শেখায়। সে নিজে আশ্রমে এই জিনিসগুলো শিখেছিল। আজ সেগুলো দিয়েই নিজের ভরণপোষণ চালাচ্ছে। আর তার সাথে আছে রাণী। আশ্রমের সবাই যখন যার যার মতো স্বাবলম্বী হয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল রাণীই তখন একমাত্র পদ্ম’র হাত ধরে বলেছিল, “আপু, আমি তোমার সাথে থাকবো।” আর সেদিন থেকেই রাণী তার সাথেই আছে।
রাণী কে নিয়ে সে ছোট্ট একটা ভাড়া বাসায় থাকে। মেয়েটা ছিল বলেই তার জীবন আজ এতটা সহজ হয়ে উঠেছে। সে এতটা সাহস নিয়ে সব কাজ করে যাচ্ছে। এই হাতের কাজ আবার তার ছোট্ট পাঠশালা, এইসব কিছুর পেছনেই রাণীর অনেক অবদান আছে। পদ্ম মাঝে মাঝে ভাবে, মেয়েটা কেন তাকে এত ভালোবাসে? সে কোনো কারণ খুঁজে পায়না। এই স্বার্থপর পৃথিবীতে থেকেও রাণীর ভালোবাসা কতটা নিখুঁত, কতটা সুন্দর, ভাবতেই পদ্ম’র ছোট্ট মনটা সুখে ভরে উঠে।
অন্যদিনের মতোই আরেকটা সুন্দর, স্বাভাবিক সকাল। আবারও পদ্ম ছুটল তার পাঠশালার বাচ্চাদের পড়ানোর উদ্দেশ্যে। আজ আর সে লেইট হয়নি। লেইট হবে ভেবে টঙের মামার হাতে চা টাও ছেড়ে গিয়েছে সে। আফসোস হচ্ছিল খুব, কিন্তু সে নিরুপায়।
রিক্সা নিয়ে দ্রুত পৌঁছে গেল সে তার গন্তব্যে। গিয়ে দেখল সেখানে অভি আর নিঝুম। পদ্ম’র মনে যেন তখন এক পশলা খুশি এসে ভর করলো। নিঝুমের কোলে থাকা বাচ্চা মেয়েটি পদ্ম-কে দেখা মাত্রই আদু আদু বুলিতে বলতে লাগল,
‘পদঅঅঅ।’
সবাই তার আওয়াজে পেছন ফিরে তাকাল। পদ্ম-কে দেখে অভি আর নিঝুম ভীষণ খুশি হলো। পদ্ম এগিয়ে গেল তাদের কাছে। বাচ্চা মেয়েটাকে প্রথমে কোলে নিয়ে তারপর সে সবার সাথে সৌজন্য বিনিময় করলো। অনেকক্ষণ কথা বললো সবাই। আর কথার এক পর্যায়েই অভি হঠাৎ বলে উঠল,
‘আগামী সপ্তাহে তো আদিদ আসছে।’
কথাটা পদ্ম’র কানে যাওয়া মাত্রই থমকে গেল সে। বুকের ভেতরের পুরোনো ব্যাথাটা আবারও তীব্র হলো তার। সে হয়তো ভুলে যেতে চেয়েছিল, নিজেকে নিজের মতো করে বাঁচিয়ে রেখেছিল কিন্তু এখন আবার সে হয়তো দুর্বল হয়ে পড়বে। মনের মায়ার কাছে আবার হয়তো হেরে যেতে হবে তাকে। কিন্তু সেটা সে চায় না। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। আর কোনোভাবেই কোনো মায়ায় নিজেকে জড়ানো যাবে না। কারণ সে এতদিনে এইটুকু বুঝতে পেরেছে যে, মায়াহীন মানুষরাই এই পৃথিবীতে সব থেকে বেশি সুখী।
(অনেকে বলছেন, নিঝুম এখানে হুট করেই চলে এসেছে। অভির বিয়েটাও হুট করেই হয়ে গিয়েছে। আবার অনেকে বলছেন, অভি তো পদ্ম-কে পছন্দ করতো তাহলে সে নিঝুম কে কেন বিয়ে করলো। আচ্ছা, অভি কী কখনো বলেছিল সে পদ্ম-কে পছন্দ করে কিংবা ভালোবাসে বলে সে তাকে বিয়ে করতে চায়?
পদ্মফুল পর্ব ৩৯
বরং পদ্ম যখন বিয়ের কথা শুনে রিয়েক্ট করে তখন অভিও বলে সে পদ্ম-কে বিয়ে করবে না তার মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করবে। আর নিঝুম সেখান থেকেই এসেছে। এখানে অভির বিয়েটা গল্পের একটা সাইট বিষয় ছিল বলে এটাকে এত হাইলাইট করা হয়নি। আশা করি আপনারা বুঝতে পারবেন। তবে কনফিউশন কিন্তু এখানেই শেষ না। অপেক্ষা করুন, আরো অনেক কিছু বাকি😁)