পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ৪১

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ৪১
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

অভি আর নিঝুম চলে যাওয়ার পর পদ্ম বাচ্চাদের কাছে যায়। সে মন থেকে সবকিছু ভুলে যেতে চাইলেও সেটা পারছে না। পদ্ম বেখেয়ালী ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। বাচ্চাগুলোও বুঝতে পারছে না কী হয়েছে। তারা তখন সমস্বরে ডেকে উঠে,
‘আপা!’

পদ্ম’র হুঁশ ফিরে। সে প্রত্যেক দিনের মতোই ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বলে,
‘কেমন আছো, বাচ্চারা।’
সবাই বললো,
‘ভালো আছি।’

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পদ্ম’র বুক চিরে কেন যেন তখন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মনে হলো সে কেন ভালো থাকতে পারছে না। তারপর পদ একটা চক নিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডে কিছু একটা লিখল। আর বললো,
‘বলতো এখানে কী লেখা?’

বাচ্চাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে চেয়ে রইল। যদিও তাদের বয়স একটু বেশি তবে পড়াশোনার ক্ষেত্রে তারা একেবারেই নতুন। সবে মাত্র অ আ শেখা শেষ করেছে। পদ্ম’র তাই ধারণা তারা লেখাটা বুঝতে পারবে না। কিন্ত তার ধারণাকে বদলে দিয়ে সেখান থেকে একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

‘এটা ভালোবাসা।’
পদ্ম অবাক হয়ে বললো,
‘বুঝলে কী করে?’
ছেলেটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
‘আমার বড়ো ভাইয়ের মুখে একবার শুনছিলাম, এই শব্দ টা ভালোবাসা।’
পদ্ম হেসে বললো,

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। এখানে “ভালোবাসা” লেখা। আচ্ছা তোমরা কাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসো?’
একেক জন একেক জবাব দিল। কেউ বললো মা, কেউ বললো বাবা। যার মা বাবা কেউই নেই সে বললো, ভাই। আবার দু এক জন বললো তারা যে বাড়িতে মাঝে মধ্যে কাজ করতে যায় সেই বাড়ির মালিক। সবার জবাব দেওয়া শেষ হলে সেখান থেকে কয়েকজন বলে উঠে,

‘আপা, আপনি কারে সবথেকে বেশি ভালোবাসেন?’
পদ্ম চোখ বুজে মিষ্টি করে হেসে বলে,
‘তোমাদের, তোমাদের আমি অনেক বেশি ভালোবাসি। আর ভালোবাসি আমার মা বাবাকে। আমার একটা ছোট্ট বোন আছে, “রাণী” ওকেও খুব ভালোবাসি। আর..’

বাচ্চাগুলো খুব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে “আর” এরপর আর কার নাম বলবে সেটা শোনার জন্য। কিন্ত পদ্ম আর কিছু বলে না। সে বোর্ড পরিষ্কার করে তাদের পড়ানো শুরু করে দেয়।
পড়ানো শেষ করার পর, পদ্ম কে স্যারের রুমে ডাকা হলো। দরজায় নক করে সে বললো,

‘আসবো স্যার।’
অনিক হেসে বললো,
‘হ্যাঁ, আসুন।’
পদ্ম ভেতরে গেল। অনিক তাকে বসতে বললো। পদ্ম তার কথা মতো বসলো। তারপর অনিক একটা খাম পদ্ম’র দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘আপনার ফি।’

পদ্ম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে খামটা হাতে নিল। অনিক তখন বললো,
‘আপনার কি কিছু হয়েছে? সকাল থেকেই দেখছি মন খারাপ করে আছেন?’
পদ্ম এবার হাসার চেষ্টা করলো। বললো,
‘না না, কিছু হয়নি। আমি একদম ঠিক আছি।’

অনিক কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তাকে দেখে মনে হলো সে কিছু ভাবছে। অনেকটা সময় যাওয়ার পর অনিক বললো,
‘পদ্ম, আমি আপনাকে আমার এই সংস্থার সম্পাদক বানাতে চাই যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।’
পদ্ম বিস্মিত হলো। অবাক কন্ঠে বললো,
‘কেন স্যার?’
অনিক হালকা হেসে জবাবে বললো,
‘কারণ আমার আপনাকে এই পজিশনের জন্য পারফেক্ট মনে হয়েছে, তাই।’
পদ্ম কিছুটা সময় নিয়ে বললো,

‘স্যার, আমার এই বাচ্চাগুলোকে পড়াতেই ভালো লাগে। ওরা আমার পরিবার। ওরা আমার ভালো থাকার একটা মাধ্যম। আমাকে প্লীজ ওদের শিক্ষক হিসেবেই থাকতে দিন।’
পদ্ম’র অনুরোধের কাছে অনিক কে হার মানতে হলো। সে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ঠিক আছে। আপনি রাজি না হলে, আমি আপনাকে জোর করবো না।’
পদ্ম তখন হেসে অনিক কে সালাম দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।

রাস্তার এক পাশ দিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে হেঁটে চলছে সে। হাঁটার মাঝখানেই পদ্ম থামল। সামনে চায়ের একটা স্টল দেখে মনে প্রশান্তি এলো তার। দু’কাপ চা খেলো সে। চায়ের দোকানের মামা খানিকটা অবাক হলো তাতে। পদ্ম’র চোখে মুখে ফুটে উঠা বিষন্ন আর হতাশা যেন সকলেরই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। চায়ের দাম দিয়ে পদ্ম আবার হাঁটতে লাগল। প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর সে তার বাড়িতে এসে পৌঁছাল।

বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখল রাণী মেঝেতে বসে কিছু একটা করছে। পদ্ম তার সামনে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলো সে কী করছে। সে দেখল, রাণী এক গাদা সুতি কাপড় নিয়ে বসেছে। এগুলো মূলত পদ্ম’র অর্ডারের কাজ ছিল। কালকের মধ্যে সবগুলো কমপ্লিট করতে হবে। পদ্ম’র জন্য খুব চাপ হয়ে যাবে দেখে, রাণী এগুলো নিয়ে আগেই বসে পড়েছে। পদ্ম মনে মনে ভীষণ শান্তি পেল। রাণী যেন তার আত্মার সাথে জুড়ে গিয়েছে। সে রাণীর পাশে বসে। রাণী খুব মনোযোগ দিয়ে তার কাজগুলো করছে। পদ্ম মাঝে মধ্যে তাকে এটা ওটা দেখিয়ে দিচ্ছে। কথার প্রসঙ্গেই পদ্ম হঠাৎ বললো,

‘জানিস তো, তোর ডাক্তার সাহেব আসছেন।’
রাণীর হাত সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল। তুলিটা হাত থেকে পড়ে যেতেই কিছুটা রং জামায় ছড়িয়ে গেল। পদ্ম ব্যস্ত হয়ে সেটা মুছতে লাগল। রাণীর বিস্ময় এখনো কাটছে না। সে ঢোক গিলে বললো,

‘এবার আসলে উনাকে সব বলবে তো?’
পদ্ম বিষন্ন চোখে তাকিয়ে বললো,
‘কী বলবো?’
‘তুমি যে উনাকে ভালোবাসো, সেটা?’
পদ্ম সেই কথার জবাব দিল না। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,
‘দেখ রং’টা ছড়িয়ে ফেলেছিস। এইদিক টা ঠিক কর।’

রাণী বিরক্ত হলো। বললো,
‘আমার কথার জবাব দাও আগে।’
পদ্ম কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
‘সব কথার জবাব হয় না। আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি, তুই এটা ঠিক কর।’
রাণী থ মেরে বসে থাকে। পদ্ম তাকে উপেক্ষা করে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে যায়।

অভির নাম্বারে তখন থেকে কল আসছে। ফোন’টা তার মেয়ের কাছে থাকায় সে সেটা নিতেও পারছে না। এইদিকে অনিক তাকে অনেকগুলো কল দিয়ে ফেলেছে। আর সে অনেক চেষ্টা করেও ফোনটা তার মেয়ের কাছ থেকে নিতে পারছে না। সে শেষে আর না পেরে নিঝুম কে ডাকে। ঐটুকু মেয়ে মা’কে প্রচন্ড ভয় পায়। নিঝুম এসে দাঁড়াতেই সে ভদ্র মেয়ের মতো ফোনটা রেখে তার অন্য খেলনা দিয়ে খেলতে আরম্ভ করে। তা দেখে অভি হেসে ফেলে। আর নিঝুম তখন ভাব নিয়ে বলে,

‘দেখেছো, মাদার’স পাওয়ার।’
অভি হেসে অনিক কে আবার কল দেয়। রিসিভ হলে কিছুক্ষণ তারা আনুষঙ্গিক কথা বার্তা বলে। কথার এক পর্যায়ে অনিক বললো,
‘অভি, আমার তোকে কিছু বলার আছে?’
অভি বললো,
‘কী বলবি, বল।’
অনিকের অস্বস্তি হচ্ছিল। সে কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,

‘আম-আমি আসলে…আসলে আমি পদ্মকে ভালোবাসি অভি। আর ওকে আমি বিয়ে করতে চাই।’
অভি নির্বাক হয়ে পড়ল। তার এই মুহূর্তে কী বলা উচিত সেটাই সে বুঝতে পারছে না। অভির কাছ থেকে কোনোরূপ রেসপন্স না পেয়ে অনিক আবার বললো,
‘কী হয়েছে অভি, তুই কিছু বলছিস না কেন?’
অভি জোরে নিশ্বাস ফেলল। গম্ভীর সুরে বললো,

‘কিন্তু, পদ্ম তো তোকে বিয়ে করতে রাজি হবে না।’
‘কেন হবে না? ও কি অন্য কাউকে পছন্দ করে?’
‘না, তবে ও বিয়ে করতে চায় না। আর তুই কীভাবে পদ্ম কে…আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘তুই তো বলেছিস পদ্ম এতিম। ওর দায়িত্ব তুই নিয়েছিস। সেই ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে তোকে জানানোর দরকার তাই জানিয়েছি। এখন আমি পদ্ম’র সাথেই সরাসরি কথা বলবো। রাখছি তাহলে।’

অনিক কল কেটে দিল। অভি নিঝুম কে সব বললে সে বললো,
‘সমস্যা কোথায়? অনিক ভাইয়া তো অনেক ভালো ছেলে। উনি যদি পদ্ম কে ভালোবাসেন তাতে সমস্যা টা কোথায়। পদ্ম তো আর সারাজীবন একা থাকতে পারবে না। ওর তো কাউকে প্রয়োজন, তাই না? আর আমার মনে হয় ওর জন্য অনিক ভাইয়া’ই ঠিক আছে।’

পদ্মফুল পর্ব ৪০

অভি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘কী জানি, কে ঠিক কে বেঠিক। এখন পদ্ম’র জীবনের সিদ্ধান্ত পদ্ম নিজেই নিবে।’

পদ্মফুল পর্ব ৪২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.