পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ৪২

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ৪২
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

ব্যস্ত আরেকটি সকাল। আজ পদ্ম’র পাঠশালা নেই। শনিবার পাঠশালা বন্ধ থাকে। তাই আজকের দিনটা অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই ব্যস্ত কাটে তার। সকাল সকাল সে একগাদা কাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। এগুলো ডেলিভারি দিতে হবে। রাণীকেও তার সাথে নিয়েছে। সবগুলো ডেলিভারি দিয়ে তারা যখন লাস্ট একটা বাড়িতে গেল তখনই বাঁধল বিপদ। সেই বাড়ির গেইটের সামনের কুকুর তাদের দেখে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো। আর তা দেখে রাণীর পুরো কাঁদো কাঁদো অবস্থা। পদ্ম রাণীর হাত ধরে বললো,

‘ভয় পাচ্ছিস কেন? চল, আস্তে করে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে যাবো।’
কে শুনে কার কথা। রাণী ভয়ে ভয়ে বললো,
‘পাগল হয়েছো তুমি! দেখছো না কুকুরটা কী করছে, কাছে গেলেই কামড় দিবে।’
‘আরে বাবা, এগুলো পোষা কুকুর কামড় দিবে না।’
কিন্তু রাণী তো আর বুঝবে না। সে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে রইল। পদ্ম তার হাত ধরে অনেক টানাটানি করলো, এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললো,

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ঠিক আছে তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাক, আমি একাই যাচ্ছি।’
রাণী ঝাপটে পদ্ম’র হাত ধরে ফেলল। উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
‘আরে না, তুমি চলে গেলে কুকুর টা আমাকে খেয়ে ফেলবে তো।’
পদ্ম পড়ছে মহা ফ্যাসাদে। সে চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
‘তাহলে করবো টা কী? তোর সাথে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব?’
রাণী অসহায় ভাবে তাকাল। বললো,

‘এই কুকুর টা সরে না কেন? এই বাড়ির মালিক কই? এসে এটাকে নিয়ে যেতে পারছে না।’
পদ্ম’র রাগ হচ্ছে। সে রাণীর হাত ছাড়িয়ে বললো,
‘তুই দাঁড়া, আমি দেখছি।’
পদ্ম গেইটের কিছুটা কাছে যেতেই কুকুর টা আরো বেশি গর্জে উঠল। রাণী তা দেখে চিৎকার দিয়ে বললো,
‘আপু, আর যেও না তোমাকে খেয়ে ফেলবে।’

পদ্ম দাঁত কিড়মিড়িয়ে রাণীর দিকে চাইল। রাণী ঢোক গিলে বললো,
‘তুমি বুঝো না কেন আপু, কুকুর টা তোমাকে খেয়ে ফেললে আমার কী হবে?’
পদ্ম নাকের পাল্লা ফুলিয়ে রাগে রাণীকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে কেউ একজন উপস্থিত হয়।
‘দুঃখিত, আমার কুকুর হয়তো আপনাদের বিরক্ত করছিল। আসলে ও…’
ছেলেটির কথার মাঝখানেই রাণী বজ্র কন্ঠে বলে উঠল,

‘এমন বেয়াদ্দপ কেন কুকুর টা? আপনি বোধ হয় ভালো ভাবে ট্রেনিং দিতে পারেনি। আমার কাছে দিয়েন, একদিনে সোজা করে দিব।’
পদ্ম খেয়াল করলো ছেলেটা রাণীর কথা শুনে ভীষণ অস্বস্তি তে পড়ে গিয়েছে। তাই সে রাণীর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে তাকে থামতে বলে। ছেলেটা তখন ইতস্তত কন্ঠে বললো,
‘আমি সত্যিই দুঃখিত।’

‘না ভাইয়া, আপনার কুকুর যা করেছে একদম ঠিক করেছে। আমরা অপরিচিত মানুষ, তাই সে আমাদের দেখে এমন করেছে। আর এটা সে তার প্রভু প্রীতি থেকেই করেছে, আমরা তাতে কিছু মনে করেনি।’
পদ্ম’র কথা শুনে যেন ছেলেটা কিছুটা আশ্বস্ত হলো। সে প্রসন্ন হেসে বললো,
‘আপনাদের পরিচয় টা কি জানতে পারি?’

‘আসলে আমরা একটা পার্সেল নিয়ে এসেছিলাম। এই যে এড্রেস, এখান থেকেই অর্ডার টা করা হয়েছিল।’
ছেলে টা এড্রেস টা দেখে বললো,
‘ওহ, আমার আম্মু অর্ডার টা করেছে। দিন, পার্সেল টা আমাকে দিন।’

পদ্ম রাণীকে বললো পার্সেল টা ছেলেটা কে দেওয়ার জন্য। রাণী দু কদম এগিয়ে পার্সেল টা ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিল। ছেলেটা সেটা হাতে নিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানাল। তারপর পদ্ম আর রাণী সেখান থেকে চলে এলো।
ফেরার পথে রাণী ফুচকা খাওয়ার বায়না ধরলো। পদ্ম তাকে নিয়ে গেল ফুচকা খেতে। পদ্ম’র ফুচকা পছন্দ না। এই নিয়ে রাণী তাকে অনেক কথা শোনায়। কারণ তার ভাষ্যমতে যে মেয়ে ফুচকা খায় না সে মেয়ে তো মেয়েই না। কিন্তু তাতে পদ্ম’র কিছু যায় আসে না। ছোটবেলায় একবার ফুচকা খেয়ে সে যে পরিমাণ বমি করেছিল তারপর থেকে তার ফুচকা খাওয়ার একেবারের জন্য স্বাদ চলে গিয়েছে।

রাণীকে নিয়ে পদ্ম অনেকদিন পর মায়া আশ্রমে এল। কত স্মৃতি, কত আনন্দ, কত মুহূর্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই আশ্রমের প্রাঙ্গণে। এখানেই আসতেই যেন পুরনো সেই মুহুর্তগুলো আবারও তাজা হয়ে উঠল। রাণী আর পদ্ম ভেতরে গেল। তারা দেখল সেখানে অনেক নতুন মেয়ে এসেছে। মেয়েগুলো বিস্মিত চোখে তাদের দেখছে। রাণী হেসে হেসে মেয়েগুলোকে বললো,

‘আমরাও এই আশ্রমের মেয়ে। একসময় তোমাদের মতো আমরাও এখানে ছিলাম।’
তারপর দু’জন গেল মহিলা পরিচালিকা দু’জনের রুমে। আর তাদের দেখেই পরিচালিকা দু’জন এসে জড়িয়ে ধরলেন। খুশিতে চোখ ভিজে উঠল যেন। রাণী তো কেঁদেই ফেলল। সে এই দু’জন কে খুব জ্বালিয়েছে। আর বকাও খেয়েছে খুব। কিন্তু তাদের কাছ থেকে পাওয়া সেই অফুরন্ত ভালোবাসা সে কখনোই ভুলতে পারবে না।

পদ্ম আর রাণী আশ্রমে অনেক সময় কাটাল। দুপুরের খাওয়া দাওয়া টা সেখানেই করলো। বিকেলের দিকে বেরিয়ে এল তারা। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল দু’জন। পথিমধ্যে পদ্ম’র একটা কল এল। সে ফোন টা হাতে নিয়ে দেখল, অনিক কল করছে। পদ্ম কল টা রিসিভ করে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে অনিক বললো,

‘আপনি এখন কোথায় আছেন, পদ্ম?’
‘আমি একটু বাইরে আছি স্যার, কেন?’
অনিক ধীর গলায় বললো,
‘আমার সাথে এখন একটু দেখা করতে পারবেন?’
হঠাৎ দেখার করার কথা শুনে পদ্ম কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল। সে চিন্তিত কন্ঠে বললো,
‘কিছু কি হয়েছে, স্যার? হঠাৎ এই সময় দেখা করার কথা বলছেন?’

‘আপনার সাথে আমার একটু জরুরি কথা ছিল। আপনি যদি ফ্রি থাকেন তাহলে আমি একটা এড্রেস দিচ্ছি সেখানে চলে আসুন।’
পদ্ম’র চিন্তা এবার দুশ্চিন্তার রূপ নিল। ফোন টা কাটতেই সে দেখল অনিক তাকে ঠিকানা টেক্সট করে পাঠিয়েছে। পদ্ম’র চোখ মুখ দেখে রাণী জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছে আপু, কোনো সমস্যা?’
পদ্ম উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
‘অনিক স্যার আমাকে ডেকেছেন। কী জরুরি কথা নাকি বলবেন। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে উনি আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিবেন। আমি কাল যে উনার অফার রিজেক্ট করেছি, তাই হয়তো উনি আমার উপর রেগে আছেন। নির্ঘাত আমার চাকরি টা এবার যাবে।’

পদ্ম অস্থির হয়ে উঠল। রাণী তার হাতে হাত রেখে বললো,
‘এত অস্থির হচ্ছো কেন? অন্য কিছুর জন্যও তো ডাকতে পারেন। আগে থেকেই এত হাইপার হইও না। আগে গিয়ে দেখোই না, উনি কী বলে।’

রাণীকে নিয়েই পদ্ম অনিকের পাঠানো ঠিকানা তে গেল। রিক্সা থেকে নেমে রাণী বললো,
‘জায়গা টা কিন্তু বেশ সুন্দর। আমার কী মনে হয় বলতো আপু, এই সুন্দর জায়গায় দাঁড়িয়ে তোমার স্যার তোমাকে কখনো অসুন্দর কথা বলতেই পারবেন না। দেখবে, নিশ্চয়ই উনি সুন্দর কিছু বলার জন্যই তোমাকে ডেকেছেন।’
রাণীর কথায় পাত্তা না দিয়ে পদ্ম অনিক কে কল করলো।

‘চলে এসেছেন?’
‘জ্বি স্যার, আমরা গেইটের সামনে।’
‘আমরা মানে? আপনার সাথে কি অন্য কেউ আছেন?’
‘আসলে স্যার আমার বোনও এসেছে।’
‘ওহ আচ্ছা। আপনারা সেখানেই দাঁড়ান, আমি আসছি।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই অনিক সেখানে চলে এলো। তাকে দেখেই রাণী পদ্ম’র কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘ওয়াও! তোমার স্যার কী হ্যান্ডসাম আপু।’

পদ্ম তার হাতে চিমটি কেটে চুপ করতে বললো। অনিক হেসে রাণীর সাথে পরিচয় হলো। তারপর তারা গিয়ে একটা টেবিলে বসলো। মূলত এটা একটা ক্যাফে যেটা একটা সুন্দর লেকের পাশে অবস্থিত। সন্ধ্যার সময় বলে বেশ বাতাস এই দিকটাই। পদ্ম’র টেনশন কোনোভাবেই কমছিল না। তাই সে আর থাকতে না পেরে অনিক কে জিজ্ঞেস করে,
‘স্যার, আপনি কী বলার জন্য এত জরুরি তলবে আমাকে ডেকেছেন?’

অনিক মৃদু হেসে বললো,
‘এত অস্থির হচ্ছেন কেন? আগে খাবারের অর্ডার তো দিন তারপর সব বলছি।’
অনিক একটা ওয়েটার কে ডাকল। তারপর রাণী আর পদ্ম কে বললো অর্ডার দেওয়ার জন্য। তারা কেবল দু কাপ কফি অর্ডার দিল। অনিক তাদের আরো কিছু অর্ডার দিতে বললেও তারা দিল না। তাই তাদের সাথে সে ও একটা কফিই অর্ডার দিল।

ওয়েটার চলে যাওয়ার পর অনিক রাণীর সাথে কিছুক্ষণ খোশগল্প করলো। রাণী তো তাতে বেজাই খুশি। ওদিকে পদ্ম টেনশনে ম*রছে। কফিও চলে এলো। কফির কাপে চুমুক দিয়ে অনিক জোরে নিশ্বাস ছাড়ল। অতঃপর বললো,
‘এবার তাহলে বলি, আপনাকে এখানে ডাকার কারণ।’
পদ্ম নড়েচড়ে বসলো। কফির মগটা টেবিলের উপর রেখে ভয়ে ভয়ে বললো,
‘জ্বি, বলুন।’

কোনোপ্রকার দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়া, একেবারে সোজা সাপ্টা ভাষাই অনিক বলে উঠল,
‘আমি আপনাকে ভালোবাসি পদ্ম। উইল ইউ মেরি মি?’
আকস্মিক ভাবে কথাটা কর্ণকুহুরে পৌঁছাতেই পদ্ম যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। রাণীও আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল। কিন্তু অনিক বেশ স্বাভাবিক। সে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পদ্ম’র মুখের দিকে। পদ্ম নিরব, নিস্তব্ধ। সে ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর মলিন কন্ঠে বললো,

পদ্মফুল পর্ব ৪১

‘আমাকে ক্ষমা করবেন, স্যার। রাণী চল।’
রাণীকে নিয়ে পদ্ম সেখান থেকে চলে গেল। বিস্ময় নিয়ে সে যাওয়া দেখল অনিক। আটকালো না। সে বসে বসে কফি টা শেষ করলো। তারপর বিল দিয়ে সেখান থেকে চলে এলো।

পদ্মফুল পর্ব ৪৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.