পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ৪৬

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ৪৬
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

পদ্ম তীব্র কন্ঠে বললো,
‘এটা কখনোই সম্ভব না।’
আদিদ অবাক হয়ে তাকাল পদ্ম’র দিকে। সে তো ভেবেছিল, পদ্ম বিনা বাক্যে রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু পদ্ম মুখের উপর বারণ করে দিল!
রুবি হোসেন অসহায় কন্ঠে বললেন,

‘কেন সম্ভব না, মা? আমি জানি, আমার উপর হয়তো তুমি আর বিশ্বাস রাখতে পারছো না, কিন্তু আদিদ, ওর উপর তো তোমার বিশ্বাস আছে তাই না?’
‘আমি বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা বলছি না। আমি..আ..আসলে আমার পক্ষে সম্ভব না।’
‘কী সম্ভব না?’

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাণী চায়ের স্ট্রে টা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললো। পদ্ম কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে আছে। আদিদের ও চোখ মুখ কুঁচকানো। রাণী বুঝতে পারছে না এখানে কী হয়েছে। তাই সে রুবি হোসেনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আন্টি, কী হয়েছে বলুন তো? সবার মুখ এমন বাংলার পাঁচ হয়ে আছে কেন?’
রুবি হোসেন তখন ফিচেল গলায় বললেন,

‘আমি আদিদের সাথে পদ্ম’র বিয়ের কথা ভাবছিলাম। কিন্তু পদ্ম তাতে রাজি হচ্ছে না।’
কথাটা রাণীর বোধগম্য হওয়া মাত্রই সে চেঁচিয়ে উঠল,
‘কী! ডাক্তার সাহেব আর আপুর বিয়ে? এই আপু, তুমি রাজি না এই বিয়েতে?’
পদ্ম কাট কাট গলায় বললো,
‘না।’

রাণী সঙ্গে সঙ্গে রেগে গেল। পদ্ম’র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
‘আপু, তোমার কি মাথা ঠিক আছে? তুমি তোমার ডাক্তারবাবু কে বিয়ে করতে চাও না? কেন?’
পদ্ম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,
‘এমনি।’
রাণী আরো বেশি রেগে গেল,

‘কিসের এমনি? তুমি না ডাক্তার সাহেব কে ভালোবাসো? জানেন আন্টি, যেদিন ডাক্তার সাহেব চলে যাচ্ছিলেন সেদিন আপু খুব কেঁদেছিল, খুব। আপু বলেছিল সেদিন, আপু তার ডাক্তারবাবু কে ভালোবাসে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত, আপু তার ডাক্তারবাবুর স্মৃতি আকড়ে ধরেই বেঁচে আছে। আপু ডাক্তার সাহেব কে ভালোবাসে, অনেক বেশি ভালোবাসে। এত ভালোবাসার পরও তুমি কেন এই বিয়েতে রাজি হচ্ছো না আপু?’

পদ্ম ঠাস করে রাণীর গালে চ’ড় মেরে বসলো। সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। রাণী গালে হাত দিয়ে বিস্মিত চোখে পদ্ম’র দিকে তাকাল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
‘তুমি আমাকে মারলে আপু?’
পদ্ম তার সমস্ত রাগ এবার উগ্রে দিল। চেঁচিয়ে বলতে লাগল,

‘কী শুরু করেছিস তোরা? আমাকে কেন বাঁচতে দিচ্ছিস না? আমার জীবন, আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে দে। অন্যের সামনে আমাকে ছোট করতে ভালোলাগে তাই না? আমি আর পারছি না। সেই শুরু থেকেই আমার সাথে সবাই এমন করছে। আমার মামা মামী টাকার লোভে আমাকে এই মানুষটার হাতে তুলে দিয়েছিল। তারপর এই মানুষটা আমার জীবনটাকে একেবারে শেষ করে দিয়েছিল।

জানিস, আমি একটা অসহায় মেয়ে ছিলাম, যাকে সবাই যার যার প্রয়োজনে ব্যবহার করতো কেবল। কেউ কেউ দয়া দেখাতো। কিন্তু, কখনো কেউ ভালোবাসেনি। সবসময়ই সবাই কেবল দয়া দেখিয়েছে। আর সেই রকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও আমার মনে আবেগ এসেছিল.. এই ডাক্তারবাবুর প্রতি। বলেও ছিলাম উনাকে। কিন্তু, কোথায় উনি আর কোথায় আমি!

ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের মধ্যকার পার্থক্য টা। কিন্তু, ডাক্তারবাবুর মনে ছিল, উনি গুরুত্ব দিলেন না আমায়..চলে গেলেন। তারপর আর কোনো খোঁজ নেননি। কিন্তু, আমি কি তার শোকে বেঁচে থাকতে ভুলে গিয়েছিলাম? ভুলিনি তো। এই যে বেঁচে আছি। সুন্দর ভাবে বেঁচে আছি। এখন আর আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। যখন আমার ভালোবাসার প্রয়োজন ছিল, তখন আমি সবার কাছ থেকে শুধু ধোঁকা পেয়েছি। আর এখন যখন আমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই, তখন উনি আবার আমার জীবনে কেন আসতে চাইছেন? আমি নিজেকে আর দুর্বল করতে পারবো না। উনাদের চলে যেতে বল….প্লিজ।’

পদ্ম আর ঐ রুমে দাঁড়াতে পারলো না। সে অন্য রুমে চলে গেল। পদ্ম চলে যাওয়ার পর রাণী তার গাল থেকে হাত সরালো। বিরক্ত হয়ে বললো,
‘ঢং দেখলে বাঁচি না। ওর কথা কিছু বিশ্বাস করবেন না তো, ডাক্তার সাহেব। ও সব মিথ্যা বলছে। ও এখনও আপনাকে আগের মতোই ভালোবাসে। আসলে মেয়ে মানুষ তো, তাই হয়তো অভিমান জমেছে। সেই অভিমান কিন্তু আপনাকেই ভাঙাতে হবে, ডাক্তার সাহেব।’

আদিদ অনেকক্ষণ পর এবার গলা ঝারল। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘রাণী, তুমি অনেক কিছুই জানো না। পদ্ম’র জীবন সহজ ছিল না। অল্প বয়সে তাকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। ওর সাথে আমার পরিচয়টা ক্ষণিকের। আমাদের সম্পর্ক টা ওরকম ছিল না যে, আমাদের মধ্যে কখনো মান অভিমান হবে। কোনোকিছুই তখন স্বাভাবিক ছিল না।

একের পর এক অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটেই যাচ্ছিল। ও যেমন ভেঙে পড়েছিল, তেমন ভেঙে পড়েছিলাম আমিও। ঐ সময়টা আমাদের দু জনের জন্যই খুব কঠিন ছিল। তাও আজ আমরা দু জন নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি। পদ্ম আজ অনেক বড়ো হয়েছে, অনেক স্ট্রং হয়েছে। কিন্তু সেদিন যদি আমি না যেতাম তাহলে ও এতটা স্ট্রং হতে পারতো না। ও নিজের আবেগের কাছে দুর্বল হয়ে পড়ছিল।

আর সে সময় আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি মানসিক ভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। সুজা…(বলতে গিয়েও থেমে গেল, তারপর বললো) পদ্ম’র জীবনে এখন আর কাউকে প্রয়োজন নেই। ও হয়তো একাই ভালো থাকতে পারবে। ও যেমনটা চায়, তেমনটাই হোক। আর আমিও তাই চাই।’
রাণী মুখ কালো করে বললো,

‘কিন্তু ডাক্তার সাহেব, আপনি আপুর জীবনে না এলে অন্য কেউ চলে আসবে তো।’
‘পদ্ম যদি চান, অন্য কাউকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতেই পারেন, এটা উনার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
রাণী বিরক্ত হয়ে বসলো। দূর সে তো কিছুই ঠিক করতে পারছে না। কিন্তু এভাবে চুপ করে তো বসেও থাকা যায় না। কিছু তো একটা করতেই হবে। মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে রাণী বুদ্ধি বের করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর সে বললো,

‘জানেন তো, অনিক নামের একটা ছেলে আপু কে প্রচন্ড ভালোবাসে। আর আপুও হয়তো ঐ ছেলেটাকে একটু একটু পছন্দ করে। তাই বোধ হয় ও এখন আর আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে না।’
দু ব্রু’র মাঝখানে অল্প খানিক ভাজ ফেলে আদিদ বললো,
‘অনিক কে?’

‘আপু যে পাঠশালায় বাচ্চাদের পড়ায় ওখানকার স্যার। আপুকে সেদিন আমার সামনে প্রপোস করেছিল। আর আপু তো লজ্জায় পুরো লাল হয়ে যাচ্ছিল। আমার কী মনে হয় বলুন তো, আপু বোধ হয় ঐ অনিকের প্রপোস টা একসেপ্ট করে ফেলবে।’
আদিদ নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
‘করতেই পারে। এটা সম্পূর্ণ উনার ব্যাপার। আর অবশ্যই আপনার আপুকে বলে দিবেন, বিয়ের দাওয়াত টা যেন দেয়।(তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে) মা, চলো।’

মা’কে বলেই আদিদ বেড়িয়ে গেল। রাণী মনে মনে খুশি হলো। যতই উপর দিয়ে স্বাভাবিক থাকুক না কেন, ভেতর দিয়ে যে সে একটু হলেও জ্বলছে সেটা রাণী ঠিকই আন্দাজ করতে পারল।
রুবি হোসেন একরাশ হতাশা নিয়ে দরজার কাছে যান। রাণী তখন তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আন্টি, আপনি আমার উপর ভরসা রাখুন। আপনার ছেলের বউ পদ্মই হবে।’

রুবি হোসেন জবাবে আলতো হাসলেন। তারপর তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন।
বাড়িতে ফিরে গিয়ে আদিদ মায়ের সাথে খুব রাগ দেখাল। তার ইগোতে আজ খুব লেগেছে। পদ্ম ইচ্ছে করে এমন করেছে, সেদিনের শোধ তুলতে। পদ্ম’র যদি তাকে প্রয়োজন না হয়, তার তো আরো আগে পদ্ম কে প্রয়োজন নেই। কিন্তু পদ্ম এভাবে রিয়েক্ট করতে পারেনা। তারা চলে আসার সময়ও একটা বার এলো না। এত কিসের রাগ ওর? আদিদ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মা’কে বললো,

‘কিসের ভিত্তিতে সেখানে গিয়ে তুমি বিয়ের কথা তুলে দিয়েছ, মা? বললেই কি বিয়ে হয়ে যায় নাকি? তুমি জানো না আমার মনের অবস্থা? তুমি জানো না আমি সুজানা কে ভালোবাসি, যাকে তোমরা…’

রুবি হোসেন টলমল চোখে আদিদের দিকে তাকাতেই সে থেমে যায়। আর বলতে পারে না কিছু। এসব আর ভাবতে চায় না সে, তবুও ভুলতে পারছে না। সুজানাকে ভুলা সম্ভব না। আর তাকে ভুলতে না পারলে তার খু*নিদের ও সে ভুলতে পারবে না। আদিদ উঠে নিজের রুমে চলে যায়।

রুবি হোসেন তখন বসে বসে কাঁদেন, আর মনে মনে ভাবেন, কেন যে সেদিন তারা সুজানাকে মেরেছিল। সেই তো তাদের কৃতকর্মের ফল আজ সবাই জানল। না হয় সুজানা সেটা আগেই জানিয়ে দিত সবাইকে। তাও তো আজ ছেলেটা সুজানাকে নিয়ে একটু ভালো থাকতে পারতো। তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। ছেলের এত কষ্ট সব তার জন্য। আর এর জন্য হয়তো উনার ছেলে উনাকে কখনোই ক্ষমা করবে না..

পদ্ম রুমে দোর দিয়ে বসে আছে। রাণী সেসবে পাত্তা দিচ্ছে না। সে তার বাটন মোবাইল টা দিয়ে অভি কে কল করলো। অভি কল রিসিভ করতেই রাণী খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
‘জানো অভি ভাই, আজ আমাদের বাসায় ডাক্তার সাহেব এসেছিলেন।’
অভি ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,

‘নিশ্চয়ই খুব জ্বালিয়েছিস ওকে?’
‘আরে না, একদমই জ্বালাইনি। তবে এখানে এক অন্য ঘটনা ঘটেছে। জানো তো, এখানে ডাক্তার সাহেব আর পদ্ম আপুর বিয়ের কথা উঠেছিল।’
‘কী!’

পদ্মফুল পর্ব ৪৫

অভি চেঁচিয়ে উঠল। তার কাছে কথাটা বিশ্বাস যোগ্য মনে হলো না। রাণী বাধ্য হয়ে অভিকে প্রথম থেকে সবকিছু বললো। আর সবকিছু শুনে অভি হতভম্ব। তার কাছে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। মানে ব্যাপার টা কেমন না, অনিক পদ্ম কে ভালোবাসে, পদ্ম ভালোবাসে আদিদ কে আর আদিদ আবার গিয়ে ভালোবাসে সুজানা কে…. আশ্চর্য তো!

পদ্মফুল পর্ব ৪৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.