পদ্মফুল পর্ব ৫৪
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
সকাল থেকেই আজ পদ্ম আর রাণী ভীষণ ব্যস্ত। অনেক গোছগাছ করে সবেই দুজন একটু গা এলিয়ে বসেছে। একটু পর গাড়ি আসবে। আজ পদ্ম প্রথম বারের মতো বউ হিসেবে আদিদের বাড়িতে পা রাখতে চলেছে। এই কয়টা দিন যেন চোখের পলকে চলে গিয়েছে। আর তার সাথে তৈরি করে গিয়েছে আদিদ আর পদ্ম’র মাঝে একটা সুন্দর সম্পর্ক।
আদিদ আজকাল পদ্ম’র খুব খেয়াল রাখছে। আর তারই সুযোগ নিচ্ছে রাণী। যেমন সেদিন সে আদিদ কে কল দিয়ে বলে যে, “পদ্ম হঠাৎ করে অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে, সকাল থেকে নাকি সে খুব বমি করছে, কিচ্ছু মুখে তুলছে না।” আর তা শুনে আদিদ অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সে সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে পদ্ম’র বাড়িতে আসে। এসে দেখে পদ্ম একদম ঠিক আছে। আদিদ কে দেখে পদ্ম অবাক হয়। পরে জানতে পারে এসব কিছু রাণীর কাজ। খুব বকাও খায় রাণী সেদিন। তবে তার প্রতি আদিদের এত উত্তেজনা দেখে ভীষণ ভালোও লাগে।
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিছুক্ষণের মধ্যেই আদিদ চলে আসে। আদিদ কে দেখে রাণী ছুটে গিয়ে ব্যাগ থেকে পদ্ম’র জন্য একটা শাড়ি নিয়ে আসে। সেটা সে পদ্ম’র হাতে দিয়ে বলে,
‘ডাক্তার সাহেব চলে এসেছেন। জলদি শাড়ি টা পরে এসো।’
পদ্ম ব্র কুঁচকে বিরক্ত গলায় বলে,
‘এখন আবার শাড়ি কেন পরবো?’
‘ওমা! তুমি প্রথম বারের মতো তোমার শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছো, আর শাড়ি পরবে না? এভাবে কেউ যায় নাকি। যাও তাড়াতাড়ি শাড়ি টা পরে এসো।’
পদ্ম শাড়ি টা রেখে দিয়ে বললো,
‘এখন আমি শাড়ি পরতে পারবো না, এত এনার্জি নেই।’
রাণী চোখ মুখ শক্ত করে নিল। বললো,
‘উফফ, সবসময়ই তুমি এমন করো। তুমি বোঝোনা, ডাক্তার সাহেবের যে তোমাকে শাড়িতে দেখতে ভালো লাগে? উনার জন্য একটু পরলে কী হয়?’
আদিদ তখন সেখানে উপস্থিত হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘কোনো অসুবিধা?’
পদ্ম তাকে বলে,
‘আমাকে কি শাড়ি পরে আপনাদের বাড়িতে যেতে হবে?’
আদিদ বললো,
‘না, আপনার যা খুশি পরতে পারেন।’
রাণী রেগে গেল। বললো,
‘না, শাড়িই পরতে হবে। না হলে তুমি যেতে পারবে না।’
আদিদ তখন বললো,
‘রাণী যখন চাইছেন, তখন পরুন শাড়ি। এমনিতেও শাড়িতে আপনাকে ভালো মানায়।’
পদ্ম মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ঠিক আছে তাহলে, পরছি।’
পদ্ম শাড়ি টা নিয়ে ভেতরের রুমে গেল। আদিদ রাণীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘এভাবেই সবসময় আমার হয়ে বোনকে জ্বালাবেন, বুঝেছেন?’
রাণী দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘আচ্ছা।’
পদ্ম’র বাড়িতে যে অল্প সংখ্যক ফার্ণিচার ছিল তা সে বিক্রি করে দিয়েছে। আর বাকি তার দৈনন্দিন জিনিস পত্র যা ছিল সেগুলো আদিদ তার গাড়িতে তুলে নিয়েছে। সব কাজ শেষ করে আদিদ আর রাণী বাইরে দাঁড়িয়ে পদ্ম’র জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পদ্ম বাসা তালা দিয়ে চাবি টা মালিকের কাছে দিয়ে এলো। তারপর সে বাইরে বের হয়ে আদিদের গাড়ির কাছে গেল।
আদিদ পদ্ম’র দিকে তাকাতেই সে আলতো হাসল। আদিদের চোখে আটকে গেল পদ্ম’র গায়ে মিশে থাকা বেগুনী রঙের সুতি শাড়ি টা। পদ্ম কে আদিদ বিয়ের আগেও শাড়ি পরা দেখেছিল। কিন্তু আগে কখনো তাকে এত সুন্দর লাগেনি। আজকাল তাকে যতটা সুন্দর লাগে, মনে হয় সৌন্দর্য যেন দিন দিন তার বাড়ছেই কেবল। হয়তো আগে কখনো আদিদ পদ্ম’কে ওভাবে খেয়াল করেনি। তাই হয়তো পদ্ম’র সৌন্দর্য তার চোখে ধরা পড়েনি। কিন্তু এখন পড়ছে, পদ্ম’র সৌন্দর্যে একটা পবিত্রতা আছে, একটা শুভ্রতা আছে। এই সৌন্দর্য দেখলেই যেন মনে প্রশান্তি জাগে। পদ্ম এগিয়ে যেতেই রাণী বলে,
‘মাশাল্লাহ, কী সুন্দর লাগছে তোমাকে আপু!’
পদ্ম মুচকি হাসল। বললো,
‘হয়েছে হয়েছে, এবার গাড়িতে উঠ।’
রাণী দরজা খুলে গাড়িতে বসে আবার দরজা আটকে দিল। পদ্ম ব্রু কুঁচকে তাকাতেই তাকে সে বললো,
‘ডাক্তার সাহেবের সাথে সামনে বসো।’
আদিদ তখন ড্রাইভিং সিটে বসে পদ্ম’র জন্য পাশের দরজা টা খুলে দিল।
রুবি হোসেন বেশ সাদরে তার ছেলের বউকে বরণ করে নিলেন। সেই পুরোনো বাড়িতে নতুন করে পা রাখতেই পদ্ম’র বুকের ভেতর মুচড়ে উঠল। মনে পড়ে গেল সেই ভয়ানক দিনগুলোর কথা। চোখে মুখে বিষন্নতা আর এক অজানা ভয় ঝেঁকে বসলো তার। আদিদ হয়তো বুঝতে পারলো ব্যাপার টা। পদ্ম’র নিরবতা দেখে আদিদ তার হাতটা চেপে ধরলো। পদ্ম বিস্মিত চোখে তাকালে আদিদ বললো,
‘আর ভয় নেই, এখন আমি আছি আপনার পাশে।’
পদ্ম’র মন টা তখন হালকা হলো।
বাড়ির অন্যান্য জিনিস পত্র গুলো খুব একটা না পাল্টালেও আদিদের রুমে বেশ কিছু বদল ঘটেছে। আদিদের রুমে যেই দেয়ালে সুজানার অনেকগুলো ছবি রাখা ছিল সেখানে আজ সুজানার কেবল একটি ছবি আর তার পাশেই আদিদ আর পদ্ম’র একটি ছবি বেশ বড়ো ফ্রেম করে টানানো। তাছাড়া তার বিছানাটাও বদলানো হয়েছে। দুই পার্টের একটা আলমারি ছিল, এখন সেখানে তিন পার্টের আলমারি রাখা।
ড্রেসিং টেবিলের উপর কিছু মেয়েলী জিনিসপত্র দেখে পদ্ম এবার অনেক বেশিই অবাক হয়। এসব কিছু নিশ্চয়ই আদিদ কিনেনি। কিন্তু সে যে তার ড্রেসিং টেবিল টা এভাবে সাজাতে দিয়েছে সেটাই তো বেশি। তাকে ঘিরে এত আয়োজন দেখে পদ্ম’র মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠে।তার নতুন জীবন, নতুন সংসার। নিজের সবটুকু দিয়ে সে এই সংসার টা আগলে রাখবে। আর আদিদের প্রতি ভালোবাসারও এইটুকু কমতি রাখবে না সে।
তার আর আদিদের ছবিটা ছুঁয়ে দিয়ে পদ্ম মনে মনে ভাবল, এই দেয়ালে যদি সুজানার পাশে তার জায়গা হয়ে থাকে তবে আদিদের মনেও নিশ্চয়ই হবে।
সে এতটাই নিজের ভাবনায় বিভোর ছিল যে, আদিদ কখন এসে তার পেছনে দাঁড়িয়েছে সেই খেয়ালই তার নেই। হঠাৎ পেছন ফিরতেই সে চমকে যায়। আদিদ হেসে বলে,
‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই রুমে আমি ছাড়া আর কেউ আসবে না।’
পদ্ম হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘না না, ভয় পাইনি।’
আদিদ তখন এক পা এগিয়ে পদ্ম’র খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নরম গলায় বললো,
‘এখানে আসার পর থেকেই আপনার চোখ মুখ অন্যরকম হয়ে আছে। আমি জানি, আপনার পুরোনো কথা মনে পড়ছে। হয়তো মনের এক কোণে এখনও কিছু ভয় রয়ে গিয়েছে। আমারও আছে। একবার হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়েছি, আরেকবার হারালে নিঃস্ব হয়ে যাবো। আমি আর হারাতে চাই না পদ্ম। ঠিক যতটা শক্ত করে একজনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হয়, আমি ঠিক ততটাই শক্ত করে আপনাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই, পদ্ম।’
আদিদ আরো এক পা এগিয়ে গেল। পদ্ম’র স্পন্দন তখন ক্রমে ক্রমে বাড়ছিল। আদিদ তার কপাল টা পদ্ম’র কপালে ঠেকায়। তারপর চোখ বুজে। বলে,
‘আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো, পদ্ম?’
পদ্ম’র ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠে। গলা দিয়ে স্বর আসে না। আদিদ পদ্ম’র কোমরে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে নেয়। মিহি কন্ঠে বলে,
‘ভয় পাচ্ছেন? ভাবছেন, আবার কিছু খারাপ হবে না তো? হবে না পদ্ম। আমি আপনার সাথে আর কিছু খারাপ হতে দেব না। সুজানা কে আগলে রাখতে পারেনি। কিন্ত আপনাকে নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবো। এইটুকু আঁচড়ও লাগতে দিব না, প্রমিস।’
পদ্ম’র নিশ্বাস ভারি হয়ে উঠে। আদিদ কপাল সরিয়ে তার ওষ্ঠ্য যুগল পদ্ম’র লালটের কাছে নিতেই সেখানে রাণী চলে আসে। ওদের দুজন কে ঐভাবে দেখে রাণী চেঁচিয়ে উঠে। বলে,
‘সরি সরি, আমি কিছু দেখিনি।’
রাণীর চিৎকারে দুজনেই এক ঝটকায় দূরে সরে যায়। অস্বস্তিতে দুজনেই কাঁচুমাচু করছে। রাণী তখন মিটমিট করে হেসে বললো,
‘একটু তো দরজা টা আটকাতে পারো।’
পদ্ম দাঁতে দাঁত চেপে রাণীর দিকে তাকাতে সে ভেংচি কেটে বলে,
‘পরের বার থেকে দরজা টা আটকে তারপরই…’
‘রাণীইইইই!’
পদ্ম’র চিৎকারে রাণী এবার এক ছুটে নিচে নেমে যায়। আদিদের দিকে ফিরে তাকাতেই আরো বেশি লজ্জা লাগে পদ্ম’র। আদিদ কিছু বলবে তার আগেই সে বলে উঠে,
‘আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি, আপনার কথা পরে শুনবো।’
এই বলে সে বড়ো বড়ো পা ফেলে ওয়াশরুমে চলে যায়। আর তা দেখে আদিদ হাসে আর মনে মনে ভাবে,
“আহারে, মেয়েদের লজ্জা লুকাতে কত কিছুই না করতে হয়।”
(আমার মনে হচ্ছে, গল্পের কাহিনী আর বাড়ালে গল্পের প্রবাহমানতা নষ্ট হবে। আমি যতটুকু ভেবে রেখেছিলাম ততটুকু লিখেছি। কতটুকু গুছিয়ে সম্পন্ন করতে পেরেছি জানা নেই। তবে চেষ্টা করছি অনেক টা সময়। এখন আর পর্ব বাড়ালে সেখানে কাহিনী আগাবে না। কারণ আমি আর গল্পের মোড় ঘোরাতে চাইছি না। হেতে বিপরীত হয়ে গল্প টা নষ্ট হতে পারে। তাই ভাবছি শেষ করে দিব। এখন আপনাদের কী মতামত?
পদ্মফুল পর্ব ৫৩
আমি কি আদৌ পাঠকমন কে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি? যদি না পেরে থাকি তবে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত😥। আগামীকাল গল্পের শেষ পর্ব দিব। অনেকগুলো দিন আপনারা আমার পাশে ছিলেন। অনেক ভালোবাসাও দিয়েছেন। এতটা হয়তো সত্যিই আমার প্রাপ্য ছিল না। আমি কৃতজ্ঞ। এটা শেষ হলে আবারও হয়তো কোনো নতুন গল্প নিয়ে ফিরবো। তবে আমিও মিস করবো, এই গল্পের প্রতি আপনাদের এত এত ভালোবাসা কে। এইভাবেই পাশে থাকবেন। আপনারা আমার অনুপ্রেরণা। আমি আমার পাঠকদের ভীষণ ভালোবাসি❤)