পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ৫

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ৫
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

‘ডাক্তারবাবু, প্লীজ। আমি জানি আপনি আপনার পেশেন্টের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। কিন্তু আমার কথাটাও একবার চিন্তা করুন। আমি পারবো না এখানে থাকতে। দুদিন তো দূরে থাক, আর এক মুহুর্তও আমি এখানে শান্তিতে থাকতে পারবো না। ঐ সুলাইমান খুব খারাপ লোক। লোকটা আমাকে এত সহজে ছাড়বে না। ও কিছু না কিছু একটা করবে, আমার মন বলছে ডাক্তারবাবু। প্লীজ, আমায় আপনি আজই যেতে দিন। আমি এখন অনেকটা সুস্থ, আমি পারবো যেতে।’

পদ্ম’র আকুতি ভরা কন্ঠও আদিদের মধ্যে কোনোরূপ ভাবান্তর আনতে পারলো না। সে সামনের চেয়ারটায় বেশ আরাম করে কিছুক্ষণ বসে রইল। পদ্ম চেয়ে রইল লোকটার মুখের দিকে। আদিদ অনেকক্ষণ সময় পর হালকা করে গলা ঝাড়লো। তারপর গম্ভীর গলায় বললো,

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আপনার কি ধারণা আছে, এই বাইরের জগত একটা মেয়ের জন্য ঠিক কতটা ভয়ানক? ধারণা নেই। আপনাকে আটকে রাখার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। কিন্তু মানবতার খাতিরেও আপনার জন্য আমাকে ভাবতে হচ্ছে। আপনি বাইরে সেইফ নন। বাইরে একা পা রাখলেই হাজারটা বিপদের মুখে পড়তে হবে আপনাকে।

যতই বলুক সমাজ দিন দিন সভ্য হচ্ছে, কিন্তু এখনও এই সমাজে এমন অনেক অসভ্য লোক আছে যাদের হাত থেকে আপনি বা আপনার মতো অসহায় মেয়েরা কখনোই রেহাই পাবে না। আপনি বাইরে একা গেলেই সেই অসভ্য লোকগুলো তাদের অসভ্য দৃষ্টি দিয়ে আপনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে। বাঁচতে দিবে না আপনাকে তারা। আর যদি বলেন সাহায্য করার কথা, তবে আমি আপনার হয়ে পুলিশের সাথে কথা বলবো।

এছাড়া আমার পক্ষে আর কিছু করার সম্ভব না। আপনার অভিভাবক উপস্থিত থাকা অবস্থায় তাদের অনুমতি না নিয়ে আমি আপনাকে অন্য কোথাও পাঠাতে পারবো না। সেই অধিকার আমার নেই। আর আপনাকে এখন এইভাবে ছেড়ে দিলেও পরে আমাকে এর জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে। তাই আমি দুঃখিত, আমার পক্ষে আপনার কথা রাখা সম্ভব না।’

আদিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর সে পদ্ম’র কিছুটা কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
‘আল্লাহ-কে বিশ্বাস করেন?’
পদ্ম মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বলে।
আদিদ বলে,

‘আমিও খুব বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি উনি যা করেন ভেবে চিন্তে করেন। তাই আপাতত এইটুকুই বলবো, আল্লাহ্‌র উপয ভরসা রাখুন।’
কথাটা বলে আদিদ সেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। পদ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হ্যাঁ সত্যিই, আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখা ছাড়া তার আর এখন কিছুই করার নেই। পদ্ম বেডে হেলান দিয়ে বসে উপরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

আদিদ মাত্রই একটা অপারেশন শেষে ও.টি থেকে বেরিয়েছে। সে হাত থেকে গ্লাবসগুলো খুলতে খুলতে নিজের কেবিনে ঢুকতেই চমকে গিয়ে বললো,
‘মা, তুমি এখানে?’

তার সামনে থাকা পঞ্চাশোর্ধ মহিলাটি ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হাসলেন। তার চোখগুলোও যেন তখন হেসে উঠল। বয়স বাড়লেও সৌন্দর্যের এইটুকুও কমতি নেই তার মাঝে। হাসলে এখনও যেকোনো ছেলে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকাতে বাধ্য। মুখের চামড়া এখনো যেন যুবতীদের মতো চকচক করছে।
রুবি হোসেন হেসে জবাব দিলেন,

‘তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এলাম।’
আদিদ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
‘তাই বলে একবার আমাকে বলে আসবে না?’
‘বলে আসলে কি আর সারপ্রাইজ হতো?’
আদিদ হাসল। বললো,

‘আচ্ছা বাবা, বুঝেছি। তা হঠাৎ এখানে চলে এলে যে, বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?’
‘আরে না। তুমি দুদিন ধরে বাসায় যাচ্ছো না। আমার বুঝি তোমার জন্য দুশ্চিন্তা হয় না? তাই আর থাকতে না পেরে চলে এলাম।’

‘আসলে মা, এইদিকে খুব চাপ। আর অনেকেই ছুটিতে গিয়েছে তো তাই ডক্টর কম থাকায় একটু প্রেশারে পড়ে গিয়েছি আর কী। আমার জন্য তোমাকে কষ্ট করে এখানে আসতে হলো। আমি যেতাম আজকে। কিন্তু…আচ্ছা বাদ দাও সেসব। কী খাবে বলো? চা, কফি নাকি ভারি কোনো খাবার?’
রুবি হোসেন তার হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘পাঁচটা বাজে, নিশ্চয়ই এখনো তুমি দুপুরের খাবার খাওনি?’
আদিদ ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘না মানে আসলে মা, ও.টি তে ছিলাম তাই..’
‘আচ্ছা থাক, আর বাহানা দিতে হবে না। আমি বাসা থেকে খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি খাবার দিচ্ছি।’

আদিদ প্রসন্ন হাসল। পৃথিবীর সব মা’ই কি এমন? এত ভালো? তার হঠাৎ তখন পদ্ম’র কথা মনে পড়ল। মেয়েটা নিশ্চয়ই প্রতি মুহুর্তে মায়ের এই ভালোবাসাটাকে মিস করে? সৃষ্টিকর্তার কত অদ্ভুত মহিমা! কাউকে দুহাত ভর্তি ভালোবাসা দিচ্ছেন তো কাউকে আবার কাউকে সেই ভালোবাসার’ই কাঙ্গাল বানিয়ে রেখেছেন।
আদিদ ভীষণ মজা করে খাবার খেল। মায়ের হাতের রান্না তার বরাবরই প্রিয়। সে তার খাবারের মাঝ থেকে কিছু খাবার রেখে দিল। রুবি হোসেন সেটা খেয়াল করে বললেন,

‘এই খাবারগুলো আবার আলাদা করে রাখছো কেন? সব তো তোমার জন্যই।’
‘মা, আসলে হয়েছে কী আমার একজন পেশেন্ট আছে, তাকে যত্ন বা তিন বেলা খাবার দেওয়ার মতো তার পরিবারের কেউ নেই। মামা মামির কাছে বড়ো হয়েছে, অনাদর আর অবহেলায়। মেয়েটা খুব অসুস্থ। বলতে পারো মানসিক, শারীরিক দুই ভাবেই। ভাবছি মেয়েটাকে খাবারগুলো দিব। তোমার হাতের রান্না খেলে শরীর মন দুইটাই সুস্থ হয়ে যাবে, দেখো।’

রুবি বেগম ব্রু কুঁচকালেন সঙ্গে সঙ্গে। চিকন ফ্রেমের চশমাটা চোখ থেকে খুলে বললেন,
‘আমাকে দেখা করাবে মেয়েটার সাথে?’
আদিদ বললো,
‘আচ্ছা করাবো।’
‘চল, তাহলে এখনই যাই।’
আদিদ খাবারগুলো প্যাক করে তার মা’কে নিয়ে পদ্ম’র কেবিনের দিকে গেল। পদ্ম চোখ বুজে শুয়ে আছে। আদিদ কেবিনের ভেতর প্রবেশ করে নার্সকে জিগ্যেস করলো,

‘উনি কি ঘুমাচ্ছেন?’
‘না স্যার, এক্ষুণি তো আমার সাথে কথা বললো।’
‘ওহ আচ্ছা। আপনি এই খাবারগুলো একটা প্লেটে বেড়ে আনুন।’
নার্সকে খাবারের প্যাকেট’টা দিয়ে আদিদ পদ্ম’র কাছে গেল। রুবি হোসেনও তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী নিখুঁত মেয়েটার চোখ মুখ। মায়া যেন উপচে পড়ছে তার।
আদিদ তখন পদ্ম-কে ডাকল। পদ্ম চোখ খুলে আদিদ-কে দেখে আস্তে করে উঠে বসলো। তার পাশের মহিলাটিকে চিনতে না পেরে সে গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। আদিদ তখন হালকা হেসে বললো,

‘উনি আমার মা।’
“মা” কথাটা শুনেই পদ্ম অস্থির হয়ে সঙ্গে সঙ্গে সালাম দিল। রুমি হোসেন তখন সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
‘ভালো আছো মা?’
‘জ্বি। আপনি ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ মা। আমিও আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। আদিদ আমাকে তোমার কথা বলেছে। তোমার নাকি পরিবারে তেমন কেউ নেই। আর তোমার মামা মামিও তোমাকে খুব একটা পছন্দ করেন না, তাই তো?’
পদ্ম কিছু বলে না। সে মাথা নিচু করে বসে থাকে। নার্স তখন সেখানে খাবারের প্লেট নিয়ে উপস্থিত হলে তিনি নার্সের হাত থেকে খাবারের প্লেট’টা নিয়ে বললেন,

‘আমি তোমাকে খাইয়ে দেই?’
পদ্ম অবাক হয়ে উনার দিকে তাকাল। এই মানুষটা তাকে খাইয়ে দিতে চাইছে? চেনে না জানে না একটা মেয়েকে কেবল মায়ার তাড়নায় নিজ হাতে খাইয়ে দিতে চাইছে? পদ্ম তখন মনে মনে ভাবল, ডাক্তারবাবু এইজন্যই এত ভালো। গাছ ভালো হলে তো ফল ভালো হবেই। পদ্ম’র জবাব না পেয়ে রুবি হোসেন বললেন,

‘খাবে না তুমি আমার হাতে?’
পদ্ম মাথা কাত করে বললো,
‘খাবো।’
রুমি হোসেন খুব খুশি হলেন। তিনি ভাত মাখিয়ে পদ্ম’র মুখে লোকমা তুলে দিলেন। পদ্ম অবিশ্বাস্য চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটা কত ভালো। কত সুন্দর করে একটা মানুষকে আপন করে নিতে পারে। এতটা যত্ন আর ভালোবাসা নিয়ে কেউ তাকে কখনো খাইয়ে দেইনি। সেই লাস্ট মায়ের হাতে খেয়েছিল। আর তারপর থেকে অধিকাংশ দিনই না খেয়ে পার করে দিত সে। মামা মামির এত এত অপমান সহ্য করে দিন শেষে তার গলা দিয়ে খাবার নামতো না। আজ আবার অনেকদিন পর সে পেট ভরে খেয়েছে। পদ্ম আবেগে আপ্লুত হয়ে বললো,

‘খাবারগুলো খুব মজা হয়েছে।’
আদিদ বলে,
‘আমার মায়ের হাতের রান্না, মজা না হয়ে উপায় আছে।’

রুবি হোসেন হাত ধুয়ে এসে আদিদকে বললেন,
‘তোর কোনো কাজ থাকলে করতে পারিস। আমি এখন ওর সাথে বসে একটু গল্প করি। কি, গল্প করবে তো আমার সাথে?’
পদ্ম খুশি হয়ে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। আদিদ বললো,
‘আচ্ছা, তোমরা গল্প করো আমি মিটিং রুমে আছি।’

পদ্মফুল পর্ব ৪

রুবি হোসেন পদ্ম’র কাছ থেকে তার জীবনের সব কথা শুনলেন। এইভাবে তো আর একটা মানুষ বাঁচতে পারে না। কিন্তু এই মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পদ্ম-কে তার কাছে রেখে দিবেন। এমন একটা মেয়ে, দেখলেই তো মায়া হয়। এমনিতেও তার একজন সঙ্গীর খুব প্রয়োজন ছিল। আর পদ্ম-কে দেখার পর তার মনে হচ্ছে ওর চেয়ে ভালো সঙ্গী আর কোথাও পাবেন না তিনি। তাই এই সুযোগ তিনি আর হাতছাড়া করবেন না…

পদ্মফুল পর্ব ৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.