পদ্মফুল পর্ব ৬
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
‘মা, তুমি এসব কী বলছো? তুমি চেনো না জানো না একটা মেয়ে-কে শুধুমাত্র মায়ার খাতিরে আমাদের বাড়িতে রাখতে চাইছো, এটা কি আদৌ ঠিক হবে মা?’
রুবি হোসেন শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘কেন ঠিক হবে না? তুমি তো মেয়েটার ব্যাপারে সবকিছুই জানো, তারপরও কী করে তুমি এই মেয়েটাকে তার মামা মামির হাতে তুলে দিতে চাইছো, আদিদ? তুমি কি চাও মেয়েটা ম/রে যাক? ঐ মেয়েটার চোখ মুখ দেখলে কি তোমার একটুও মায়া হয় না?’
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘মা, তুমি বুঝতে পারছো না। তুমি সবটা যতটা সহজ ভাবে নিচ্ছো, সবকিছু কিন্তু আদৌ এতটা সহজ নয়। উনার মামা মামি ভালো মানুষ না আর তার উপর উনার আবার একজনের সাথে বিয়েও ঠিক হয়ে আছে। কি যেন নাম..ওহ সুলাইমান। ঐ লোকটাকে আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। উনারা জীবনেও পদ্ম-কে আমাদের বাড়িতে থাকতে দিবে না মা। অযথা আমাদের ঝামেলায় ফেলতে চাইবে। দরকার আছে বলো এসব আজাইরা ঝামেলা পোহানোর? উনাকে সাহায্য করতে হলে, আইনানুগ ভাবে করো। কিন্তু এই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার’টা আমার কেন যেন পছন্দ হচ্ছে না মা।’
রুবি হোসেন তপ্ত শ্বাস ফেললন। বললেন,
‘ওর মামা, মামি আর সুলাইমান-কে যদি আমি রাজি করাতে পারি, তাহলে তো আর কোনো সমস্যা থাকবে না আশা করছি।’
‘কিন্তু উনারা রাজি হবেন না। কোনোভাবেই না।’
‘তুমি উনাদের কল দিয়ে এখানে আসতে বলো। উনাদের সাথে আমি কথা বলবো। তুমি এক্ষুণি উনাদের একবার হসপিটালে আসতে বলো।’
‘কিন্তু মা…’
‘আমি আর কোনো কিন্তু শুনতে চাই না আদিদ। যা বলেছি তাই করো।’
আদিদ রাজি না থাকা সত্ত্বেও মায়ের কথা তাকে মানতেই হলো। ব্যাপার’টা তার কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক লাগছে। কিছু সময়ের পরিচয়ের একটা মেয়েকে মা হঠাৎ বাড়িতে রাখার জন্য এত কেন উতলা হয়ে উঠলেন? এটা কী শুধুই মায়া নাকি অন্যকিছু? আদিদের মনটা যেন হঠাৎইম অস্থির হয়ে উঠল। সে গভীর ভাবে মায়ের দিকে তাকাল। অতঃপর নরম সুরে বললো,
‘মা, তুমি কিন্তু সবকিছু জানো। তাই আমি তোমার কাছে শুধু এইটুকুই অনুরোধ করবো, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিও না যেটাতে তোমার ছেলে কষ্ট পাবে। আশা করছি তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি।’
আদিদের কথায় যেন তার মা ভীষণ মজা পেলে। তিনি হেসে উঠলেন। বললেন,
‘তোমার মায়ের উপর কি তোমার এইটুকুও ভরসা নেই। আমি জানি তুমি কী ভাবছো। নিশ্চিন্তে থাকো তেমন কিছুই হবে না।’
আদিদ তখন আলতো হেসে বললো,
‘আমি নিজের থেকেও তোমাকে বেশি বিশ্বাস করি মা। আমি জানি তুমি সেই বিশ্বাস কখনো ভাঙ্গবে না। ঠিক আছে তবে, তুমি যা চাও তাই হবে। আমি পদ্ম’র মামা মামিকে কল দিয়ে এখানে আসতে বলছি।’
মাগরিবের আযান হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। বাইরে এখনো আবছা আলোর রেশ রয়ে গেছে। রুবি হোসেন জায়নামাজ’টা ভাজ করে আদিদ-কে ডাকলেন। আদিদ মায়ের কাছে এলো। রুবি হোসেন তখন শুধালেন,
‘উনারা এসেছেন?’
‘হ্যাঁ মা, তুমি বসো আমি উনাদের ভেতরে ডেকে আনছি।’
পদ্ম’র মামা মামি রুমের ভেতর ঢুকেই রুবি হোসেনের আপাদমস্তক পরখ করতে লাগলেন। তাকে দেখেই তাদের মনে হলো ভীষণ বড়োলোক। পদ্ম’র মামির চোখ তো বারবার উনার গলার মোটা চেইন আর কানের বড়ো ঝুমকোগুলোর দিকে যাচ্ছে। তার সাথে হাতের মোটা বালাগুলো দেখে তো তিনি চোখই সরাতে পারছেন না। তিনি মনে মনে ভীষণ আফসোস করলেন। হা হুতাশ করে বললেন “ইশ! এই জিনিসগুলো যদি তার হতো।”
রুবি হোসেন প্রসন্ন হেসে বললেন,
‘আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন।’
‘নেন বসলাম। এবার বলেন তো আমাদের এত তোড়জোড় করে কেন ডাকাইলেন? আইচ্ছা, আমাদের মাইয়ার আবার কিছু হয় নাই তো? এই ডাক্তার পদ্ম ঠিক আছে তো?’
মামির এই আলগা পিরিত দেখে আদিদ বিরক্ত কন্ঠে বললো,
‘চিন্তা করবেন না, উনি একদম ঠিক আছেন। আসলে আমার মা আপনাদের সাথে কিছু কথা বলতে চাই, তাই আপনাদের এইভাবে ডাকা হয়েছে।’
সুলাইমান তার দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে ব্রু কুঁচকে বললো,
‘আপনার মায়ের আবার আমাদের সাথে কী কথা?’
‘বলছি। আপনারা একটু ধৈর্য ধরে বসুন, আমি সব বলছি। আদিদ, বাবা তুমি একটু বাইরে যাও। আমি উনাদের সাথে একটু একা কথা বলতে চাই।’
মায়ের কথায় আদিদ ভীষণ অবাক হলেও সে কিছু না বলে সেই রুম থেকে বেরিয়ে তার কেবিনে চলে গেল। মায়ের আচরণ’টা এবার তার অনেকটাই অদ্ভুত লাগছে। মা তার সামনে কেন কথা বলতে চাইলো না? কেন? আদিদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বসে অনেক কিছু ভাবছে।
তার মাথায় নানান দুশ্চিন্তা আসছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার মনে হলো সে তার মা-কে সন্দেহ করছে। সে চট করে উঠে বসলো। না না, এটা একদম ঠিক হচ্ছে না। তার মা আজ পর্যন্ত কখনোই কোনো ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আজও নিশ্চয়ই তিনি ভুল কিছু করবেন না। আদিদের চোখে তার মা ভীষণ বিচক্ষণ একজন মানুষ। মা যা করে ভেবেচিন্তেই করে। অযথা তার মা-কে এইভাবে সন্দেহ করা একদম ঠিক হচ্ছে না।
আদিদ তার ওষ্ঠযুগল গোল গোল করে ফুঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর এসি’টা কুল মুডে দিয়ে সে একটা ফাইল নিয়ে বসলো। এসব কিছু থেকে বেরিয়ে আসতে এখন এই ফাইলটাই একমাত্র তাকে সাহায্য করতে পারে..
প্রায় ঘন্টা খানেক পর রুবি হোসেন আদিদের কেবিনে ঢুকলেন। আদিদ খুব মনোযোগ দিয়ে লেপটপে কিছু করছে। রুবি হোসেন হেসে বললেন,
‘কাজ শেষ হয়েছে আমার ছেলের?’
আদিদ চমকে তাকাল।
‘মা, তোমার কথা বলা শেষ? কী বললেন উনারা? রাজি হয়নি নিশ্চয়ই? আমি জানতাম এমন কিছুই হবে। আচ্ছা, উনারা আবার তোমার সাথে কোনপ্রকার অভদ্র আচরণ করেনি তো? আমি তো..’
‘বাবা থামো, আমাকে এবার একটু কিছু বলতে দাও।’
‘আচ্ছা সরি, বলো।’
রুবি হোসেন খুশ মেজাজে বললেন,
‘উনারা রাজি।’
‘রাজি?’
আদিদ যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,
‘এত সহজে সবাই রাজি হয়ে গেল? ঐ লোকটাও? সিরিয়াসলি মা?’
‘হ্যাঁ, উনারা সত্যি সত্যিই রাজি হয়েছেন। কারো কোনো আপত্তি নেই। ইনফেক্ট ঐ সুলাইমান না যেন কী, সে ও রাজি।’
আদিদের মাথায় ঢুকছে না কিছু। ঐ লোকগুলো এত সহজে কী করে রাজি হয়ে গেল? মা এমন কী বলছে উনাদের যে উনারা বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেল? আশ্চর্য! এটা তো ভীষণ আশ্চর্যের ব্যাপার।
‘তোমাকে আর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। এখন আমি নির্দ্বিধায় পদ্ম-কে আমাদের বাড়িতে রাখতে পারবো। আমি বরং পদ্ম’র কেবিনে যাই, ওকেও তো সবকিছু বলতে হবে।’
রুবি হোসেন পদ্ম’র কেবিনের দিকে গেলেন। আর আদিদ এখনো ভাবছে, কিভাবে সম্ভব হলো এসব। ব্যাপার’টা যে এত সহজে সলভ্ হয়ে যাবে সেটা সে চিন্তাও করতে পারেনি। পদ্ম’র মামা মামির মতো মানুষ পদ্ম-কে এত সহজে ছেড়ে দিল? আর ঐ সুলাইমান যার কিনা বিয়ের জন্য তর সইছিল না সেও এত সহজে রাজি হয়ে গেল। হাউ স্ট্রেঞ্জ!
পদ্ম কেবিনে একা। সে এক দৃষ্টিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাও যেন সেই অন্ধকার দেখেই সে মনে অন্যরকম শান্তি অনুভব করছে। তার মনে হচ্ছে এই তো তার জীবন। কুচকুচে কালো, ঠিক এই অন্ধকারের মতো। যেখানে আলোর কোনো ছিটে ফোটাও নেই।
আর যাই একটু আলো আসতে চাইছে তাও এই কুচকুচে অন্ধকারটা গোগ্রাসে গিলে খাচ্ছে। পদ্ম হাসে। কেন হাসে সে জানে না। হাসলে তার গালগুলো রসগোল্লার মতো হয়ে যায়। ছোটবেলায় তার বাবা এই গাল টেনে খুব আদর করতো তাকে। পদ্ম হাসি থামিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকায়। তখন সে পেছন থেকে কারোর গলা শুনতে পায়। পেছনে ফিরে রুবি হোসেন-কে দেখে হঠাৎই খুব আনন্দ লাগে তার। রুবি হোসেন তার কাছে এগিয়ে এলেন। তার পাশে গিয়ে বসলেন। বললেন,
‘একটা অনুরোধ করবো, রাখবে মা?’
পদ্ম বিস্মিত চোখে তাকায়। এত ভালোবেসে কেউ অনুরোধ করলে কি সেই অনুরোধ ফেলা যায়। পদ্মও তখন মিষ্টি হেসে বললো,
‘বলুন, কী অনুরোধ?’
রুবি হোসেন একটু সময় নিয়ে বললেন,
‘আমি চাই তুমি আমার সাথে আমার বাড়িতে থাকো। তুমি তো বলেছো, তুমি তোমার মামা মামির কাছে যেতে যাও না। তাছাড়া আর কোথায় যাবে তুমি? তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তুমি আমার সাথে থাকবে, আমার মেয়ে হয়ে।’
পদ্ম কী বলবে বুঝতে পারছে না। আর এই মানুষটা কী বলছে সেটাও তার বোধগম্য হচ্ছে না। পদ্ম উনার বাড়িতে কী করে গিয়ে থাকবে? এটা কিভাবে সম্ভব? পদ্ম বিস্ময় নিয়ে বললো,
‘এটা কিভাবে সম্ভব আন্টি। আমি আপনার সাথে আপনার বাড়িতে থাকবো? না না এটা কেমন দেখায়। আর তাছাড়া আমার মামা মামি..’
‘তোমার মামা মামির সাথে আমার কথা হয়েছে। সুলাইমানের সাথেও কথা হয়েছে। ওদের কারোরই কোনো আপত্তি নেই। মা, তুমি আমার মেয়ে হয়ে আমার বাড়িতে থাকবে। তুমি জানো আমাকে বাসায় সবসময় একা থাকতে হয়। আদিদ থাকে সারাক্ষণ ওর হসপিটাল নিয়ে আর আদিদের বাবা থাকে তার ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে। আমি বাসায় একা একা কী করবো বলো।
সারাদিন শুয়ে বসে আমার সময় কাটে। গল্প করার মতোও কাউকে পায় না। তোমারও তো মা কেউ নেই। তুমি কি চাও না একটু ভালো থাকতে? নাকি চাও মামা মামির কাছে ফিরে গিয়ে ঐ সুলাইমানকে বিয়ে করতে? কী চাও তুমি, বলো?’
পদ্ম চুপ হয়ে থাকে। রুবি হোসেন মোলায়েম গলায় বললেন,
‘আমি একজন মা। মা হিসেবে তুমি আমার উপর এইটুকু ভরসা তো করতেই পারো। আমি তোমায় জোর করবো না। তবে মা হিসেবে কেবল এই অনুরোধ’টাই করবো, আমার কথাটা ফেলো না প্লীজ।’
রুবি হোসেন পদ্ম’র গালে হাত রেখে ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলেন। পদ্ম’র মনে হলো এই চোখগুলো মিথ্যে না। মানুষটাকে বিশ্বাস করা যায়। হয়তো আল্লাহই তার কষ্টের কথা ভেবে এসব করছেন। হয়তো তিনি এই মানুষটার মাধ্যমেই তার বেঁচে থাকার মাধ্যম উন্মোচন করে দিয়েছেন। যদি সৃষ্টিকর্তা সত্যিই এমন কিছু চায়, তবে সেও তাতে রাজি। অনেক তো কষ্ট ভোগ করেছে, এবার না হয় একটু মানুষের ভালোবাসা পাবে। তার জন্য তো এই একটু ভালোবাসায় বিশাল।
পদ্মফুল পর্ব ৫
পদ্ম’র তাই চাপা নিশ্বাস ফেলে বললো,
‘ঠিক আছে আন্টি, আমি রাজি।’
রুবি হোসেন ভীষণ খুশি হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। একজন মা-কে জড়িয়ে ধরতে পেরে পদ্ম’র সমস্ত কষ্ট যেন তখন নিমিষেই দূর হয়ে গেল।