পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ৭

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ৭
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

বাইরে ফকফকা রোদ। আরেকটা সুন্দর সকাল। রুমের ভেতরের বা পাশটায় অনেকটা অংশ জুড়ে রোদ পড়ে আছে। পদ্ম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেই রোদ দেখছে। সে কিছুক্ষণ ঐভাবে তাকিয়ে থাকার পর আস্তে করে বেড থেকে নেমে সেই রোদের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল। তাপহীন রোদ। শরীরে আরাম বোধ করছে। কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে সে তার জায়াগায় আবার ফিরে এলো। তখনই কেবিনে নার্স এলো সকালের নাস্তা নিয়ে। নাস্তার প্লেট’টা এগিয়ে দিয়ে নার্স তাকে বললো,

‘স্যার বলেছে নাস্তা করে তাড়াতাড়ি তৈরি হওয়ার জন্য।’
পদ্ম নাস্তা শেষ করে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এলো। সে বেরুতেই নার্স তার দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘এখানে একটা জামা আছে, পরে দেখুন আপনার হয় কিনা?’
পদ্ম বিস্মিত হলো। অবাক কন্ঠে বললো,
‘কে দিয়েছে এই জামা?’

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আমি কিনেছি। আপনি দু দিন ধরে এই এক জামা’ই পরে আছেন। আজ আমার একজনের বাসায় যাবেন, এই ময়লা পুরাতন জামা পরে কি আর যাওয়া যায় বলুন। তাই এটা কিনে আনলাম। যদিও আপনার মাপ জানি না, তবে আপনার মতোই আমার এক ছোট বোন আছে তাই ওর মাপ অনুযায়ী নিয়ে এসেছি। জানি না হবে কিনা, একবার ট্রাই করে দেখলে খুশি হবো।’

নার্স জামার ব্যাগ’টা পদ্ম’র দিকে এগিয়ে দিয়ে কথাটা বললো। পদ্ম এখনো বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে ভীষণ অবাক হয়। সবকিছু কত অদ্ভুত! যাদের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক তারা তাকে নিয়ে এইটুকুও ভাবে না অথচ এই মানুষটা, যার সাথে তার কোনো সম্পর্ক’ই নেই সে তার কথা ভেবে তার জন্য জামা পর্যন্ত কিনে নিয়ে এসেছে। আসলেই, পৃথিবীতে এখন রক্তের চেয়ে আত্মিক সম্পর্কগুলোর মূল্য অনেক বেশি।

পদ্ম ওয়াশরুম থেকে জামা’টা পরে বেরুল। নার্স তাকে দেখে অবাক হলো। কী সুন্দর ফিটিং হয়েছে! আর একটা সামান্য সুতি জামাতেও মেয়েটাকে কী সুন্দর মানিয়েছে! আসলে কথায় আছে না, সুন্দর মানুষকে সবকিছুতেই সুন্দর লাগে। পদ্মও তো তাই, ভীষণ সুন্দর একটা মানুষ।
পদ্ম হেসে বললো,

‘আমাকে কেমন লাগছে, আপু?’
‘খুব সুন্দর।’
‘জামা’টা খুব সুন্দর হয়েছে। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ধন্যবাদ আপু। আমি আপনার ভালোবাসার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো। এইখানে আসার পর থেকেই আপনি আমার অনেক যত্ন নিয়েছেন, আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে পর্যন্ত দিয়েছেন। আমি আপনাকে কখনো ভুলবো না, আপু। আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।’

পদ্ম’র কথা শুনে নার্স মনে যেন প্রশান্তি পেল। কাউকে খুশী করার মাঝেও ভীষণ সুখ পাওয়া। যে সুখ’টা আর অন্যকিছুতে পাওয়া যায় না। নার্স প্রসন্ন হেসে বললো,
‘আমারও আপনার কথা মনে থাকবে। আপনি খুব ভালো একটা মেয়ে। আমি দোয়া করবো আপনার জন্য, দেখবেন আপনার সব কষ্ট একদিন দূর হয়ে যাবে।’

পদ্ম’র অক্ষিযুগল যেন ভিজে উঠল। সে আর কিছু বললো না। নার্সটি তখন বললো,
‘আপনার চুল’টা বেঁধে দেই।’
‘আচ্ছা।’
পদ্ম’র চুলে খুব যত্ন করে বিনুনি করতে করতে নার্স বললো,

‘আপনার চুলগুলোও খুব সুন্দর। জানেন, আপনাকে যখন ও.টি তে নেওয়া হয়েছিল তখন তো প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আপনি মাথার উপরে ব্যাথা পেয়েছেন; হয়তো সেই জায়গার চুল ফেলে তারপর সে/লাই করতে হবে। পরে দেখলাম না মাথায় না কপালে ব্যথা পেয়েছেন, তখন খুব শান্তি লাগছিল এটা ভেবে যে, অন্তত এই সুন্দর চুলগুলো তো আর ফেলতে হবে না।’

পদ্ম আলতো হাসল। তারপর হঠাৎ আবার মুখটা গম্ভীর করে বললো,
‘আচ্ছা, সেলাই কবে খুলবেন?’
‘স্যার বলেছে কালকে খুলবে।’
‘সেলাই খোলার সময় কি ব্যথা পাওয়া যায়?’
‘না, অতটাও না। হালকা।’
‘ওহ।’

আদিদ তার সমস্ত কাজ শেষ করে পদ্ম’র কেবিনে এলো। তারপর সে পদ্ম-কে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘আপনি কি তৈরি?’
পদ্ম ইতস্তত কন্ঠে বললো,
‘জ্বি।’
‘চলুন তাহলে। উমম, আপনি কি হেঁটে গাড়ি পর্যন্ত যেতে পারবেন নাকি হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করবো?’
‘না না, আমি পারবো।’

‘স্যার, আপনি যান আমি উনাকে ধরে নিয়ে আসছি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, আসুন।’

বাইরের খোলা আকাশের নিচে আসতেই পদ্ম’র মন’টা যেন ফুরফুরে হয়ে উঠল। এই দুই দিন নিজেকে জেলখানার এক কয়েদী মনে হয়েছে। হসপিটালের ভেতরের পরিবেশ’টা যেন কেমন। অদ্ভুত নিরব চারপাশ, কোনো হৈ চৈ নেই, নেই কোনো কোলাহল। এই নিরবতা যেন গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। পদ্ম’র এমন পরিবেশ পছন্দ না। তার তো পছন্দ এই এত এত মানুষ, এই এত এত মানুষের ব্যস্ত পদধ্বনি। তাদের হৈ চৈ, কোলাহল। জীবন তো তার এসব দেখেই অভ্যস্ত। সে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিল। এই তো ফট করে নাসারন্ধ্র দিয়ে গাড়ির একটা বিচ্ছিরি গন্ধ ঢুকে পড়ল। কিন্তু সেটাতেও সে যেন শান্তি খুঁজে পেল।

নার্স পদ্ম-কে গাড়িতে বসিয়ে এক সাইডে গিয়ে দাঁড়াল। আদিদ তখন নার্সকে বললো,
‘কোনো অসুবিধে হলে আমাকে কল দিয়েন। আর আমি সন্ধ্যার মধ্যেই ব্যাক করার চেষ্টা করবো। আরেকটা কাজ করবেন, ড. সাদিক-কে বলবেন একটু আমার পেশেন্টগুলোর দিকে খেয়াল রাখার জন্য।’
‘আচ্ছা স্যার, আমি বলে দিব।’
‘ঠিক আছে।’

আদিদ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। পদ্ম তার হাত বের তখন নার্স-কে বিদায় জানাতে ব্যস্ত। আদিদ বললো,
‘হাত’টা ভেতরে আনুন, আমি জানলাগুলো তুলে দিব।’
পদ্ম সঙ্গে সঙ্গে হাত ভেতরে নিয়ে এলো। আদিদ তখন জানলাগুলো তুলে দিয়ে এ.সি অন করে দিল।
পদ্ম সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। আদিদ আড় চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘সিট বেল্ট লাগান’নি কেন?’

পদ্ম নিজের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো,
‘লাগাচ্ছি।’
সিট বেল্ট লাগিয়ে সে আবার সিটে হেলান দিয়ে বসলো। কেন যেন খুব অস্বস্তি হচ্ছে তার। ব্যাপার’টা যেন কেমন দেখাচ্ছে, এইভাবে দুদিনের পরিচয়ে একজনের বাড়িতে থাকতে চলে যাচ্ছে সে। যতই তারা ভালো মানুষ হোক না কেন, তাও তো নিজের কাছে কেমন একটা লাগে।

এইভাবে কারোর বাসায় আশ্রিতা হয়ে থাকা’টা কি ঠিক। ব্যাপার’টা একদমই ভালো দেখায় না। পদ্ম মনে মনে ঠিক করে নেয়, সে ঐ বাড়িতে এমনি এমনি থাকবে না। তার বিনিময়ে সে ঐ বাড়ির সব কাজ করবে। মামার বাড়িতে থাকতে তো এসবই করেছে সে। তাও তো কোনো দিন মামির মন পায়নি। উল্টো কিছু থেকে কিছু হলেই তাকে মা/র খেতে হয়েছে। এখানে তো সে কাজ করার বিনিময়ে একটু ভালোবাসা পাবে। সেটাই তার জন্য অনেক।

অনেক’টা পথ তারা এলো। রাস্তা’টা ভীষণ সুন্দর। তাদের গাড়ি’টা শো শো করে এগিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে পেছনের দিকে ছুটে যাচ্ছে রাস্তার দু পাড়ের গাছগুলো। বাইরে ভীষণ বাতাস। পদ্ম’র খুব ইচ্ছে করছে জানলা’টা খুলে একটু বাইরের হাওয়া খাওয়ার জন্য। কিন্তু সে এই কথাটা কোনোভাবেই আদিদ-কে বলতে পারছে না। সে কেবল বিষন্ন চোখে বাইরের দিকে তাকিয়েই আছে। ইশ, যদি একটু হাওয়া খেতে পারতো!

বলবে বলবে করতে করতেই তারা তাদের গন্তব্যে এসে পৌঁছে গেল। আদিদ পদ্ম’র পাশের দরজা’টা খুলে দিয়ে বললো,
‘নামুন।’

পদ্মফুল পর্ব ৬

পদ্ম গাড়ি থেকে নেমে কৌতুহল নিয়ে এদিক ওদিক তাকাল। সামনেই সে দেখল একটা বিশাল গেইট। যার বাকি চারপাশ বড়ো দেয়াল দিয়ে বাউন্ডারি করা। তাহলে কি এটাই ডাক্তারবাবুর বাড়ি?
পদ্ম’র মনের অস্বস্তি’টা এক লাফে যেন তখন আকাশ ছুঁলো। মনটা ভীষণ খচখচ করছে তার। তার বার বার কেন যেন মনে হচ্ছে, সে এখানেও ভালো থাকতে পারবে না। সত্যিই কি তাই, নাকি পুরোটাই তার দুশ্চিন্তা?

পদ্মফুল পর্ব ৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.