পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ৮

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ৮
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

পদ্ম’র সামনে এক গাদা খাবার এনে রাখা হলো। সে যেন অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে। এই ছোট্ট একটা জীবনে এত সমাদর আগে কখনো পায়নি সে। তাই এক সঙ্গে এত সব তার হজম করতে একটু কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
পদ্ম কোনো খাবার ধরছে না দেখে রুবি হোসেন তার মাথায় হাত রেখে বললেন,

‘কী হলো মা, কিছু খাচ্ছো না কেন?’
পদ্ম অস্বস্তি ভরা হাসি দিয়ে একটা আপেলের টুকরো প্লেট থেকে হাতে নিল। রুবি হোসেন পুনরায় তখন বললেন,
‘খাওয়ার পর তোমাকে তোমার রুম দেখাবো। আমি নিজের হাতে তোমার রুম গুছিয়েছি।’
পদ্ম কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। একে তো এত বড়ো বাড়ি, তার উপর সবকিছু অচেনা অজানা। সব মিলিয়ে ভীষণ অস্থির লাগছে তার। ডাক্তারবাবু-কে যাই একটু চেনে কিন্তু সেও যে সেই রুমে গিয়েছে আর আসার নাম গন্ধ’ই নেই।

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রুবি হোসেনের জোরাজুরিতে অনেক কিছুই পদ্ম’কে খেতে হলো। যদিও তার গলা দিয়ে খাবার নামছিল না। তাও না খেয়ে পারলো না।
খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে রুবি হোসেন পদ্ম’কে নিয়ে গেলেন তার রুম দেখাতে। উনি উনার নিজের রুমের পাশের রুমটাতেই পদ্ম’র থাকার ব্যবস্থা করেছেন।
কাঠের কারুকার্য করা দরজাটা খুলে রুবি হোসেন হাসি মুখে বললেন,
‘এটা আজ থেকে তোমার রুম পদ্ম। দেখতো পছন্দ হয় কিনা?’

পদ্ম নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে কেবল। এটা তার রুম? সে আজ থেকে এই রুমে থাকবে? সিরিয়াসলি? মামার বাড়িতে ছোট্ট একটা স্টোর রুমেতে থেকে এসেছে সে। এটা তো তার আগের রুমের চেয়ে তিন গুণ বড়ো হবে। এত বড়ো বিছানা তার জন্য? বিছানার পাশে এডজাস্ট টেবিলটাতে ছোট্ট একটা ল্যাম্পশেড। রুমের একপাশে একটা আলমারি। তার বিপরীত পাশে ছোট একটা স্টাডি টেবিল। ঠিক তার পাশের কর্ণারেই একটা বুক শেলফ। বুক শেলফটাতে চোখ যেতেই তার মনটা লাফিয়ে উঠল। কতদিন বই পড়া হয় না। আহা, নিজের চোখকে যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই এই এত সব তার জন্য করা হয়েছে?

পদ্ম’র বিস্ময় কাটল রুবি হোসেনের কন্ঠে। তিনি তাকে জিগ্যেস করলেন,
‘পছন্দ হয়েছে? নাহলে বলতে পারো, আমি তোমার পছন্দ অনুযায়ী..’
‘খুব পছন্দ হয়েছে। বিশ্বাস করুন, আপনাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা আমার জানা নেই। কিন্তু এত কিছু আমার জন্য? কেন আন্টি? এর বিনিময়ে যে আমার কাছে কিচ্ছু নেই আপনাকে দেয়ার মতো। আমি যে আপনার কাছে আজীবন ঋণী থেকে যাবো।’

রুবি হোসেন হাসলেন। বললেন,
‘চিন্তা করো না, তোমাকে আমি ঋণী করে রাখবো না। এখন আর এসব নিয়ে ভেবো না তো। যাও গিয়ে ফ্রেশ হও। আর শোনো আলমারিতে দেখো, তোমার জন্য কিছু ড্রেস কিনে রেখেছি। ঐগুলো তোমার হয় কিনা পরে দেখো। না হয় চেঞ্জ করে আনতে হবে। ঠিক আছে তাহলে তুমি ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও। আমি তোমার পাশের রুমেই আছি। কোনো অসুবিধা হলে বলো, কেমন?’

‘আচ্ছা আন্টি।’
রুবি হোসেন দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। পদ্ম বিছানায় গিয়ে বসলো। চোখ ঘুরিয়ে রুমের সবকিছু আবার একবার দেখল। বিছানা বরাবর একটা ড্রেসিং টেবিলও আছে। পদ্ম ঘুরে সেই আয়নার দিকে তাকাল। আয়নায় ফুটে উঠা নিজের প্রতিবিম্ব’টা দেখে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হলো তার।

মানুষ ঠিক কতটা অসহায় হলে এইভাবে অন্য একজনের বাসায় এসে থাকতে পারে। পদ্ম ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কেন, কেন রুবি হোসেন তার জন্য এত কিছু করছেন। এই স্বার্থপর পৃথিবীতে কি এখন আর কেউ নিজ স্বার্থ ছাড়া কিছু করে? করে না তো। তাহলে এই মানুষটা কেন করছে? কেন তাকে এতটা ভালোবাসা দিচ্ছে? সত্যিই কি এর পেছনে কোনো স্বার্থ নেই? পদ্ম’র মন কোনো জবাব দিতে পারে না। সে থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থেকে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।

‘মা, মেয়েটাকে তুমি কতদিন এই বাড়িতে রাখবে? একবার না একবার দেখবে ঠিকই তার মামা মামি চলে এসেছে তাকে নেয়ার জন্য।’
‘আসবে না।’
‘তুমি এতটা সিউর কী করে হচ্ছো?’
রুবি হোসেন ছেলের দিকে ব্রু কুঁচকে তাকালেন। বললেন,

‘আমি কথা বলেছি উনাদের সাথে, তাই আমি এতটা সিউর। তোমাকে এসব ব্যাপারে আর ভাবতে হবে না। পদ্ম-কে নিয়ে আমি ভাববো। ওর সমস্ত দায়িত্ব আমার, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।’
আদিদ খানিক বিরক্ত গলায় বললো,

‘মা, বললেই কী আর নিশ্চিন্তে থাকা যায়। এইভাবে একটা অপরিচিত মেয়েকে বাসায় রাখা কতটা রিস্কি তুমি জানো? আজকাল কত কিছু ঘটছে। বাসায় সারাদিন আমি, বাবা কেউই থাকি না। দুই জন কাজের লোক ছাড়া আর কেউই নেই এই বাড়িতে।

বলতে গেলে তুমি পুরো একাই থাকো। এর মধ্যে এইভাবে একটা মেয়ে বাসায় থাকলে কি নিশ্চিন্তে থাকা যায়? মাথার ভেতর কত সব চিন্তা আসে তোমার কোনো ধারণা আছে? মা একটা কথা বলি, উনাকে তো চাইলে আমরা ভালো একটা আশ্রমে দিয়ে আসতে পারি। সেখানে উনিও সেইফ থাকতে পারবে আর আমাকেও অযথা এসব নিয়ে আর ভাবতে হবে না, তাই না?’

‘তোমাকে ভাবতে কে বলেছে? বলেছি আমি? বলেনি তো। তাহলে এত ভাবছো কেন? বললাম তো ঐ মেয়ের দায়িত্ব আমার। আর কিসের এত ভয় পাচ্ছো তুমি? তোমার কি মনে হয়, ঐ মেয়ের দ্বারা আমার কোনো বিপদ হতে পারে? শুনো আদিদ, পৃথিবীতে না কিছু মানুষ আছে, যারা খুব কষ্টে থাকার পর হুট করেই একটু সুখ আর ভালোবাসার দেখা পেলে তারা এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে যায় যে, সেই ভালোবাসা আর সুখ প্রদানকারী-কে তারা তখন মাথায় তুলে রাখে। পদ্মও হলো সেসব মানুষদের মতো। ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার মতো কিছুই নেই, বুঝলে তো।’

আদিদ আর তর্কে জড়ালো না। সে নিজেও জানে না কেন তার মা পদ্ম-কে এত পছন্দ করে ফেলেছে? আপাতত যা হচ্ছে সেটাকে সেইভাবেই চলতে দেওয়া উচিত বলে তার মনে হলো। তাই আদিদ আর কথা বাড়াল না। মায়ের রুম থেকে বেরুতেই পাশের রুমের দিকে চোখ গেল তার। সে তখন ভাবছে, পদ্ম’র রুমে একবার যাবে নাকি যাবে না। তার মন বলছে একবার যাওয়া উচিত। তারা বাসায় এসেছে অনেকক্ষণ হয়েছে, কিন্ত আসার পর থেকে সে একবারও পদ্ম’র খোঁজ নেয়নি। অন্তত ডক্টর হিসেবে তাকে তার পেশেন্টকে একবার দেখা উচিত।
দরজায় টোকা দিয়ে আদিদ বললো,

‘আসবো?’
‘জ্বি, আসুন।’
আদিদ পদ্ম’র রুমে ঢুকতেই পদ্ম বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। আদিদ বললো,
‘দাঁড়াতে হবে না, বসুন।’
পদ্ম বসলো। আদিদ তার রুম’টা ভালো ভাবে দেখে বললো,
‘কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
পদ্ম মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘না না, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আপনারা আমার জন্য অনেক করেছেন, ডাক্তারবাবু। এত কিছুর পরেও কি আমার কোনো অসুবিধা থাকতে পারে, বলুন।’
আদিদ পদ্ম’র সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর সুরে বললো,
‘একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না, আপনি দয়া করে আমাকে ডাক্তারবাবু বলা বন্ধ করুন। আমার এই শব্দ’টা পছন্দ না। আপনি চাইলে আমাকে আমার নাম ধরে ডাকতে পারেন আর নয়তো “ডাক্তার সাহেব” বলে ডাকতে পারেন বাট “ডাক্তারবাবু” না।’

পদ্ম খানিকটা বিব্রত বোধ করলো যেন। হঠাৎ ডাক্তারবাবু আবার এমন কথা কেন বলছেন? আগে তো কিছু বলেননি। তাহলে আজ হঠাৎ কী হলো?
পদ্ম’র চোখমুখ দেখে আদিদ বুঝতে পারে তার কথায় সে অবাক হয়েছে ভীষণ। কিন্তু সে বিষয়টাকে তেমন আওতায় আনেনি। সে মৃদু সুরে বললো,
‘এত ভাবতে হবে না। জাস্ট নরমাল একটা কথা বলেছি। আমি ডাক্তারবাবু শুনতে অভ্যস্ত না। তাই কথাটা বলেছি। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।’

পদ্মফুল পর্ব ৭

আদিদ তার কথা শেষ করে পদ্ম’র রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পদ্ম এখনও আগের মতোই বিস্মিত হয়ে ভাবছে,
“ডাক্তারবাবুর আজ হলো’টা কী? আমার এখানে থাকাটা কি উনি পছন্দ করছেন না? নাকি অন্যকিছু?”

পদ্মফুল পর্ব ৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.