পদ্মফুল - Golpo bazar

পদ্মফুল পর্ব ৯

পদ্মফুল

পদ্মফুল পর্ব ৯
লেখিকা জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

পদ্ম ক্যালেন্ডারের পাতার দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে? সাত’টা দিন এত তাড়াতাড়ি কী করে চলে গেল? তার তো মনে হচ্ছে এই তো দু’দিন আগে সে এই বাড়িতে এসেছে এর মাঝেই এক সপ্তাহ শেষ। আশ্চর্য!
পদ্ম বারান্দায় যায়। দুপুরের উষ্ণ গরম।

এইখান থেকে দাঁড়িয়ে দেয়ালের ওপারের দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না। পদ্ম গেইটের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা বৃদ্ধ দারোয়ান গেইটের একপাশে একটা কাঠের টুলে বসে ঝিমাচ্ছে। এই ভর দুপুরে কেউ এইভাবে ঝিমায়? পদ্ম তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। ডানদিকের বাগান’টার দিকে তাকিয়ে দেখে লাল রঙের যে নয়নতারা গাছ’টা নতুন লাগানো হয়েছিল সেটাতে ফুল ধরেছে। টকটকে লাল নয়নতারা।

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পদ্ম ফুলগুলোকে গভীরভাবে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিজের রুমে ফিরে এলো। কী ভেবে সে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এক সপ্তাহ আগে এই বাড়িতে আসার পর প্রথম যে প্রতিচ্ছবি’টা এই আয়নায় ফুটে উঠেছিল তা আজকের প্রতিচ্ছবি থেকে ভিন্ন। পদ্ম নিজেকে দেখে খুব অবাক হলো। এই এক সপ্তাহেই কেমন নাদুসনুদুস হয়েছে। গালের মাংস বেড়েছে তার।

গায়ের রঙ’টাও যেন খানিক উজ্জ্বল হয়েছে। হবে না, এত ভালোবাসা আর যত্ন পেলে তো সবাই এমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। বাবা মা মা/রা যাওয়ার জীবনের এই সাত’টা দিন’ই কেবল সে এত বেশি ভালো থাকতে পেরেছে। রুবি হোসেনের এই অগাধ ভালোবাসা তাকে ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ করেছে।

তার সাথে করেছে লজ্জিত। এমন একটা মানুষকে সে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অথচ এই মানুষ’টাই তাকে মায়ের মতো করে আগলে রেখেছে। এতটা যত্ন আর এতটা ভালোবাসা আগে কখনো পায়নি সে। হয়তো ধৈর্য ধরেছিল বলেই আজকের এই দিনটি তার জীবনে এসেছে। সে তাই খুব করে চায় বাকি দিনগুলোতেও এইভাবেই ভালো থাকার জন্য..বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।

‘পদ্ম, আসবো?’
রুবি হোসেনের কন্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকায় পদ্ম। ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হেসে বলে,
‘এসো বড়ো মা।’
রুবি হোসেন রুমের ভেতর গিয়ে বিছানায় বসলেন। পদ্ম-কে ডেকে বললেন,
‘বসো এখানে।’

পদ্ম তার পাশে বসলো। রুবি হোসেন মোলায়েম তখন তাকে কন্ঠে জিগ্যেস করলেন,
‘তোমার এখানে থাকতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
পদ্ম সরব গলায় বললো,

‘বড়ো মা, এত এত ভালোবাসার পাওয়ার পরও কি কোনো অসুবিধা হতে পারে? তুমি আমাকে নিজের মেয়ের জায়গা দিয়েছো, এতটা তো আমার প্রাপ্য ছিল না। কিন্তু আমি পেয়েছি, তুমি দিয়েছো আমায়। এই এক সপ্তাহেই দেখো না, তোমার এত এত ভালোবাসা পেয়ে আমি কিভাবে ফুলে গিয়েছি। দুদিন পর দেখবে ফুলতে ফুলতে বেলুন হয়ে গিয়েছি। এখন থেকে একটু কম কম খাওয়াবে, বুঝলে?’
রুবি হোসেন হেসে ফেললেন। বললেন,

‘হুম, খুব পাজি হয়েছো। না বললে তো কিচ্ছু খাও না, আমার বলে ফুলে নাকি বেলুন হয়ে গিয়েছে। ওহ আচ্ছা, যেটা বলতে এসেছিলাম: আদিদের বাবা আসছে। এতদিন সিলেট তিনি ছিল ব্যবসার কাজে। মাত্রই রওনা দিয়েছে। আসলে ওকে আমি তোমার কথা কিছু বলেনি। তবে চিন্তা করো না, প্রথমে হয়তো একটু রিয়েক্ট করবে কিন্তু পরে আমি ঠিক ওকে ম্যানেজ করে নিব।’

পদ্ম’র মুখটা কালো হয়ে গেল। মানে এতসব ঘটনা কিছুই ডাক্তারবাবুর বাবা জানেন না। এখন যদি উনি এসে বড়ো মা’র উপর খুব রাগ দেখান? রাগ দেখাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পদ্ম’র খারাপ লাগছে, তার জন্যই তো এখন আবার বড়ো মা’কে এসব সহ্য করতে হবে। পদ্ম মাথা নুইয়ে আস্তে করে বললো,
‘আমি চলে যাই, বড়ো মা?’

‘একদম না। তোমার চলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। আরে বোকা মেয়ে, তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? আদিদের বাবা কিচ্ছু বলবেন না, আর আমি আছি তো, একদম টেনশন নিও না।’
পদ্ম মাথা তুলে ভয়ে ভয়ে বললো,
‘আংকেল যদি রেগে গিয়ে আপনাকে কিছু বলে?’
রুবি হোসেন হেসে বলেন,

‘তোমার আংকেল রাগ দেখাবে তাও আমার সাথে? আমি উল্টো ওর সাথে রাগ দেখায়। আমি চোখ গরম করে তাকালে তো বেচারা একেবারে ভেজা বেড়াল হয়ে যায়।’
পদ্ম হেসে ফেলল। রুবি হোসেনও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসলেন। তারপর বললেন,
‘গোসল সেরে নিচে এসো। একসাথে খাবো।’
রুবি হোসেন কথা’টা বলে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন পদ্ম তখন তাকে হঠাৎ ডেকে উঠল,

‘বড়ো মা!’
রুবি হোসেন ঘুরে তাকিয়ে বললেন,
‘কিছু বলবে?’
পদ্ম আমতা আমতা করে বললো,
‘না মানে, ডাক্তারবাবু কি আজকে আসবেন? আ-আংকেল না আসবেন, তাই বলছিলাম আর কী।’
‘হ্যাঁ, বলেছে তো আসবে। এখন বাকিটা ওর মর্জি।’
‘ওহহ।’
‘ঠিক আছে, তাহলে তুমি গোসল করে নাও। আমি আমার রুমে যাচ্ছি।’

সেই যে ডাক্তারবাবু তাকে এই বাড়িতে রেখে গিয়েছে তারপর আর তার কোনো দেখা মেলেনি। উনি কি রাত দিন ঐ হসপিটালেই কাটান? কী করে থাকেন ঐখানে? অবশ্য উনার তো অভ্যাস হয়ে গিয়েছে তাই হয়তো সমস্যা হয় না। কিন্তু তাও সপ্তাহে দু থেকে তিন বার অন্তত উনার বাড়িতে আসা উচিত।

বাড়ি তো আর বেশি দূর না, এক ঘন্টার পথ। চাইলেই তো আসতে পারেন। পদ্ম তখন পরক্ষণেই আবার মনে হলো, উনি উনার রোগীদের প্রতি যে সিরিয়াস, উনার কাছে হয়তো এই এক ঘন্টায় অনেক কিছু। এই ব্যাপার’টা অবশ্য পদ্ম’রও ভীষণ ভালো লাগে। যদিও তিনি বাড়িতে আসেন না কিন্তু মায়ের সাথে কথা বলার সময় পদ্ম’র খোঁজ ঠিকই নেয়। ভাবতে ভাবতেই তার হঠাৎ করেই হাসি পেয়ে গেল।

সে কী ভেবে যেন তখন তার কপালে হাত দেয়। সেইদিন কী করেছিল সে। সামান্য সেলাই খোলার সময় সেকি কান্না। পদ্ম’র বাচ্চাদের মতো কান্না দেখে এক পর্যায়ে ডাক্তারবাবু হেসে ফেলেছিলেন। আর সেদিনই প্রথমবারের মতো ডাক্তারবাবুর উপর চোখ আটাকেছিল তার।

এর আগে কখনো কোনো পুরুষ মানুষের হাসি এতটা ভালো লাগেনি যতটা সেদিন ডাক্তারবাবুর হাসি তার ভালো লেগেছিল। যদিও সেই হাসির স্থায়িত্ব কেবল কয়েক সেকেন্ড ছিল কিন্তু ঐ কয়েক সেকেন্ড’ই পদ্ম’র মনে কয়েক যুগের তীব্র যন্ত্রণা ধরিয়ে দিয়েছিল। পদ্ম জানে না এটা কিসের যন্ত্রণা। কিন্তু প্রায়’ই সে এটা টের পায়। অল্প কিছুক্ষণ থেকে আবার ভালো হয়ে যায়। আর কিছু জানুক বা না জানুক এইটুকু সে ঠিকই জানে, এই যন্ত্রণাকে তাকে বাড়তে দেওয়া যাবে না। নয়তো এই ফলে একদিন তার হৃৎপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে।

বাইরে গরম কিছুটা কমেছে। আকাশের পশ্চিম পাশটা এখন একটু বেশিই লালিমা হয়ে আছে। দুপুরে ক্লান্তি ক্ষণের পর প্রকৃতি এখন হয়তো কিছুটা বিশ্রাম নিচ্ছে। এই সময়টা বিশ্রামের সময়। এক গাদা কাজ শেষে খেয়ে দেয়ে সকলে বিছানায় যায় একটু আরামের উদ্দেশ্যে।

পদ্মফুল পর্ব ৮

কেউ কেউ আবার আরাম খুঁজতে খুঁজতে ঘুমিয়েও যায়। ক্লান্তি শরীরে সেই একটু ঘুম পরবর্তীতে মনকে চাঙা করে তোলে। কি জানি আদৌ তুলে কিনা। পদ্ম’র এই সময় ঘুম পায় না, তাই সে জানে না। তবে হসপিটালে থাকা অবস্থায় বিকেলে হয়তো একবার ঘুমিয়েছিল সে, যদিও তার মনে পড়ছে না এতকিছু। তার আবার এত ক্লান্তি আসে না। সে এখন বসে বসে বই পড়ছে। বই পড়ছে বললে ভুল হবে। বইয়ের মাঝে কাউকে একটা দেখছে সে। একটা মেয়েকে। চমৎকার দেখতে মেয়েটা। কিন্তু কে এই মেয়েটা? আর এই বইয়ের মাঝেই বা এই মেয়েটার ছবি কী করে এলো?

পদ্মফুল পর্ব ১০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.