প্রিয় তুই - Romantic Golpo

প্রিয় তুই পর্ব ৪

প্রিয় তুই

প্রিয় তুই পর্ব ৪
নূরজাহান আক্তার আলো

পরদিন সকালে রোজার হাকডাকে তিতাস সদ্য নেত্রজোড়া খুলে তাকাল। সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে আড়মোড়া ভাঙল। ঘুমে ঢুলঢুলু চোখজোড়া ডলে উঠে বসল। ওর প্রিয় কোলবালিশ খানা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কখন যে পড়ে গেছে খেয়ালই নেই।বিছানার অর্ধেক চাদর মেঝেতে ছুঁইছুঁই।

বিছানা সাজানো কুশনগুলোও ড্রেসিংটেবিলের সামনে জমা করা।পড়ার টেবিলে বই দিয়ে চিপস চানাচুরের প্যাকেট চাপা দেওয়া। গতরাতে পড়তে পড়তে খেয়েছিল সে।খাটের পায়ার কাছে রাখা সবুজ রঙা পাপোসটাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে ধারণা করা যায়, খাটের তলায় নয়তো ড্রেসিংটেবিলের চিপায়। অথবা জমিয়ে রাখা নোংরা জমা কাপড়ের ভেতরে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। একগুচ্ছ কাপড় বিনব্যাগের উপর স্তুপ করে রাখা।

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তিতাস ওর পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে হাসল। একদম মনমতো করে অগোছালো করা, বাহ্ দেখতে ভালোই লাগছে। তারপর অনেক খুঁজে কোণায় রাখা বিনব্যাগের পাশ থেকে স্যান্ডেল উদ্ধার করল। রুমে পরা এ স্যান্ডেলজোড়া পিয়াস কিনে দিয়েছিল। তারপর সময় নিয়ে সে স্যান্ডেল দু’খানা পায়ে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল। কুঁচকানো টি-শার্ট টেনে টুনে ঠিক করল। ততক্ষণে রোজার দরজা থাবড়ানোও বেড়ে গেছে। তিতাস আলসেমি ভরা দেহখানা নিয়ে হেলেদুলে দরজা খুলতেই রোজা মিষ্টি হেসে বলল,

-”ছোট মিয়া, আম্মু তোমাকে ডাকছে।”
-”কেন?”
-”জানিনা।”
-” যাচ্ছি, তা তুই কেঁদেছিস কেন?”
-”কই না তো।”
-”আবার!
-”পাশের বাসার ছোটন আমাকে ল্যাংড়া বলেছে।”
-” ল্যাংড়াকে তো ল্যাংড়াই বলবে এখানে কান্নাকাটির কী আছে?”

রোজা হাসিপূর্ণ মুখখানা নিমিষেই মলিন হয়ে গেল। আদুরে মুখখানাতে জমা হলো একরাশ বিষণ্নতা। ডাগর ডাগর চোখ দুটোতে দেখা দিলো অবাধ্য নোনাজল। মলিন বদন নামিয়ে একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেল মেয়েটা। যেন বাক্‌শক্তিহীন।
পরক্ষণেই সে ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁদতে গিয়েও চেপে গেল। তবে তার আখিঁদ্বয় দিয়ে টপটপ করে গড়িয়ে গেল কয়েকফোঁটা
অশ্রুধারা। সে আর কথা না বাড়িয়ে ওর হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে যেতে গেলে তিতাস তাকে আঁটকে ধরল। হাঁটু গেড়ে বসল রোজার সামনে। তারপর ওর চোখ মুছিয়ে মৃদু হাসল।

রোজা তখনো নির্লিপ্ত, পরিবর্তনশূন্য। তিতাস ওর মুখখানা
তুলে, পিয়াসের বেলকনিতে লাগানো সদ্য ফোটা গোলাপটা দেখিয়ে বলল,
-”বনু বল তো, গাছে গোলাপ না ফুটে যদি সাদা খরগোশের বাচ্চা ফুটত তাহলে কেমন হতো?”
তিতাসের এ কথা শুনে রোজা বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল। এ আবার কেমন কথা? গাছে আবার খরগোশ ফুটে নাকি? তাও আবার সাদা খরগোশ। গাছে না ফুটে এমনিতেই ভালো দেখায়, দেখতে আদুরে লাগে। তাছাড়া গাছে ফুটলে, খরগোশ ঝুলে থাকত, খুব কষ্ট পেতো। তখন মোটেও ভালো দেখাত না। একথা ভেবে রোজা জবাবে বলল,

-”মোটেও ভালো দেখাত না। ফুল গাছেই সুন্দর দেখায়।”
-“সত্যি তো?”
-”হুম।”
-” আমাদের সৃষ্টিকর্তা যাকে যতটুকু প্রয়োজন তাকে ঠিক ততটুকুই সৌন্দর্য দান করেন। ল্যাংড়া বলে কষ্ট পাচ্ছিস, কাঁদছিস, এটা ঠিক না বনু। সব সময় ভাববি তোর সঙ্গে যা হচ্ছে বা হবে সব সৃষ্টিকর্তার মর্জিতে। উনার হুকুম ব্যতীত গাছের একটা পাতাও নড়ে না।”
-” ছোট মিয়া আমি নিজের পায়ে দাঁড়ালে আমাকে কি খুব পঁচা দেখাত? এজন্যই কি আমার আল্লাহ আমাকে এমন বানিয়েছেন?

-”বনু, পৃথিবীতে এমন আরো অনেকক মানুষ আছে। তারাও বেঁচে আছে, নিজেদের পরিচিতি লাভ করছে।এজন্য বলছি,
শরীরের ত্রুটির কাছে নিজেকে গুটিয়ে রাখিস না। কষ্ট পেয়ে বোকার মতো কেঁদে হাল ছাড়িস না। বরং এখন থেকে দশের একজন হয়ে দেখা। সর্বদা মনে রাখবি, যাদের নজর সর্বদা অন্যের দিকে তারা জীবনে কিছু করতে পারে না। হিংসাতে জ্বলতে জ্বলতে জীবনে যায় তাদের। আজ ছোটন বলেছে, কাল অন্য একজন বলবে। এরচেয়ে মেনে নে তুই ল্যাংড়া।
ব্যাপারটা একদম স্বাভাবিকভাবে গ্রহন কর। আশেপাশের মানুষদের কথাকে অগ্রাহ্য করে মনে রাখ, তুই আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ। তখন দেখবি, কষ্ট লাগবে না।”

রোজা কথাগুলো মনে দিয়ে শুনে মাথা নাড়াল, খুশি হলো।
তখন চাচী চেঁচিয়ে বললেন,
-”তিতাস! রোজা! হারিয়ে গেলি নাকি দু’জন? তাড়াতাড়ি এদিকে আয়।”
তিতাস রোজার হুইলচেয়ার ঠেলে ড্রয়িংরুমের দিকে গেল।

ততক্ষণে এটা ওটা বলে রোজার মুখে হাসিও ফুটাল। রোজা এখন খিলখিল করে হাসছে। তিতাস সেখানে পৌঁছে দেখে তার মা সোফায় বসে আছেন। পাশেই ওর বাবা ফোনে কথা বলছেন। কথা শুনে মনে হচ্ছে ফোনের অপর পাশের ব্যক্তি ভোর। কারণ তিনি ভোরের সঙ্গে এভাবে কথা বলেন। একটা কথার আগে পিছে দুইবার করে ‘মা’ শব্দ যুক্ত করেন। আদর যেন ঠিকরে পড়ে। সকালবেলা এসবের মানে তার বোধগম্য হচ্ছে না। আম্মু বাসায় কেন? ডিসচার্জ করাল কে? আসবেই যখন তাকে কেন জানাল না?

এসব ভেবে সে কিছু বলতে গেলে ওর বাবা ইশারায় নিষেধ করলেন। তিতাস ইশারা বুঝে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওর থমথমে মুখশ্রী দেখে ওর আম্মু মৃদু হাসলেন। তিতাস এগিয়ে গিয়ে উনার পাশে বসতেই সেখানে রবিন উপস্থিত হলো। সে
একগাল হেসে হাতের জিনিসগুলো একে একে তার বাবাকে বুঝিয়ে দিলো। তারপর অকারণেই হেসে বিদায় নিলো। এই ছেলেটা ভোরের সহকারী। তিতাস তাকে দু’চক্ষে সহ্য করতে পারে না। ওকে দেখলেই ওর মনে হয় নাক বরাবর লাগাতার
ঘুষি বসিয়ে দিতে। নয়তো গন্ধযুক্ত ডোবার পানিতে গড়াগড়ি খাওয়াতে। তারপর জিজ্ঞাসা করতে, ‘রবিন ভালো আছো?’
তখনো হয়তো সে বরাবরের মতোই হলুদ দাঁত বের একগাল হেসে জবাব দিবে, ‘হ্যাঁ, ভাই।’

একে নিয়েও ভোরের সঙ্গে তার একদফা ঝগড়া হয়ে গেছে।
রবিনের দোষ অকারণেই হাসে। সিরিয়াস পরিস্থিতিতেও সে হাসি থামাতে পারে না। সামান্য কারণে হেসে লুটোপুটি খায়।
যেটা তার একেবারেই পছন্দ নয়। ওর কথা হচ্ছে, সিরিয়াস পরিস্থিতিতে আমি হাসব। তবে আমার সামনে কেউ হাসতে পারবে না। হঠাৎ তিতাসের মাথায় খেলো গেল, রবিন যেহেতু এখানে অর্থাৎ ভোরই ওর মাকে ডিসচার্জ করিয়েছে। নতুবা
তাকে না জানিয়ে উনারা আসতেন না। যদিও ওর মা আগের তুলনায় কিছুটা সুস্থ। এই নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে সোজা রুমে চলে গেল। তারপর ভোরকে কল করল,

-”হ্যাঁ বল তিতাস।”
-‘হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ?”
-‘জানিসই তো কেউ বা কারা তোদের নজরে রাখছে। কী ভাবিস তুই নিজেই চালাক? না বললে জানতেও পারব না?’
তিতাস ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ঠিকঠাক করে মৃদু হাসল। তারপর কথা কাটাতে বলল,

-‘ সবার ভাগ্যে সিনিয়র বুদ্ধিমতী বউ জুটে না। সেই ক্ষেতে আমি কিন্তু খুব সৌভাগ্যবান।’
-‘পেয়েছিস নাকি? বিয়ে হলো কবে?কই দাওয়াত টাওয়াতও তো পেলাম না?’
-‘পাই নি। তবে তাকে আমি জয় করে নিবোই, নিবো। কিন্তু কেন জানি আমার মনে হয়, সে আমাকে ভয় পায়। এজন্যই ধরা দিচ্ছে না।’

ভোর জুসের গ্লাসটা নিঃশব্দে রেখে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-‘কিসের ভয়?’
তিতাস তখন ফিচেল কন্ঠে ফিসফিসিয়ে জবাব দিলো,
-‘আমাকে ভালোবেসে ফেলার ভয়।’
একথা শুনে অপর পাশে তখন পিনপতন নীরাবতা। হঠাৎ কল কেটে গেল। তিতাস কান থেকে ফোন সরিয়ে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল,

-‘ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।’-
তখন রাত সবে সাড়ে আটটা। তিতাস সারাদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে কেবল হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরল। শুভ্র শার্টের বোতাম খুলে শরীর এলিয়ে দিলো নরম তুলতুলে সোফায়।

হাত বাড়িয়ে রিমোর্ট নিয়ে টিভিতে গান চালু করল। পছন্দের গান দেখে নিজেও গেয়েও উঠল দু’টো লাইন। তারপর গলা ছেড়ে চাচীকে ডেকে বলল, ‘চাচী, শরবত বানিয়ে দাও’ তার একটু পরে, ‘চাচী, কফি করে দাও’ মিনিট পাঁচেক পরে,’চাচী ঝাল কিছু বানাও তো’ এমনভাবে একের পর এক আবদার চলতেই থাকল। আর চাচী ব্যস্ত হাতে তার আবদার মিটাতে লাগলেন। কারণ তিতাসের এমন কান্ডে অভ্যস্ত তিনি। বরং সে আবদার না করলেই শূন্য শূন্য লাগে। এর আধা পরেই, কলিংবেল বেজে উঠল।

তিতাস শুনেও অলস ভঙ্গিতে শুয়ে রইল। ঘাড়ত্যাড়া এই ছেলে উঠবে না জেনে ওর বাবা নিজে এসে দরজা খুলে দিলেন। ভোর লাগেজ হাতে ভেতরে ঢুকে
অপর পাশের সোফায় বসল। তিতাস ওকে দেখে উঠে বসে বসল। ততক্ষণে ওর বাবা রান্নাঘরে গিয়ে চাচীকে ভোরকে রুমে দিয়ে আসার কথা বললেন। তিতাস সেদিকে একবার তাকিয়ে এক ভ্রু উঁচু করে বলল,

প্রিয় তুই পর্ব ৩

-‘কাহিনি কি?’
ভোর এবার তিতাসের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
-‘সর্ষের মধ্যে নাকি ভূত লুকিয়ে থাকে। তাই ভূত খুঁজতে সোজা এখানে চলে এলাম। হতেও তো পারে ভূত আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছে। অথচ আমরা বুঝতে পারছি না।’

প্রিয় তুই পর্ব ৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.