প্রিয় তুই - Romantic Golpo

প্রিয় তুই পর্ব ৮

প্রিয় তুই

প্রিয় তুই পর্ব ৮
নূরজাহান আক্তার আলো

তিতাস যখন শুয়ে শুয়ে বিয়ের ভাবনায় বিভোর তখন ভোর তার রুমে আসল। বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে, তিতাসের মা ও চাচী কোনোভাবেই তাদের আলাদা রুমে থাকতে দিতে রাজি নন। তিতাসের মাও সহমত পোষণ করলেন উনাদের কথায়। তিনজন মায়ের যুক্তির কাছে পরাজিত হয়ে ভোর প্রায় বাধ্য হয়ে তিতাসের রুমে এসেছে। পরণে আছে লাল সুতি শাড়ি। সাজহীন সিগ্ধু মুখ। কান,গলা, আর হাতে বাসায় পরা স্বর্ণের কিছু সংখ্যক গয়না। আর চুলে অতি সাধারণ একটি খোঁপা।
দেখতে অপরুপা না লাগলেও মন্দ লাগছে না। অনেকদিন সে শাড়ি পরেছে, লাল শাড়ি। তিতাসের চাচী জোরপূর্বক এই শাড়িটি পরিয়ে বলেছেন,

-”দোয়া করি, আমাদের ছেলেটা যেন তোমার শাড়ির আঁচলে বাঁধা থাকে। তার সকল চাওয়া -পাওয়া যেন তোমাকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ হয়।”
ভোর একথা শুনে নত মস্তকে নীরবে কেঁদেছে। তিনজন মা তাকে অনেক কিছুই বলেছেন। আকার ইঙ্গিতে নানানভাবে বোঝাতে চেয়েছেন তিতাসকে মন থেকে গ্রহন করার জন্য।

পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তিতাস বয়সে ছোট হলেও তার স্বামী, জীবনসঙ্গী। সে যেন
তাকে তার প্রাপ্য সন্মানটুকু থেকে বঞ্চিত না করে। তিতাসকে যেন সামলে নেয়। ছেলেটা ভীষণ চঞ্চল হলেও খুব ভালো মনের। ভোর জবাবে শুধু সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়েছে। এ ছাড়া বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিল সে। তারপর তিতাসের চাচী নিজে এসে তিতাসের রুম অবধি তাকে দিয়ে গেছেন।

তখন থেকে সে রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তবুও তিতাস তাকে খেয়াল করে নি। মহারাজ বিছানায় শুয়ে হাতজোড়া
টান টান করে রেখে মিটিমিটি হাসছে। যেন সিলিং ফ্যানকে অনুরোধ করছে, উপর থেকে বউ ফেলার জন্য। একটা বউ
টুপ করে তার বুকের উপর পড়বে আর সে জাপটে ধরে বুকে জড়িয়ে নিবে। ভোর নিজের ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলো।
তারপর অবান্তর ভাবনা ছেড়ে শব্দ করে দরজায় বারি দিয়ে বলল,

-”ডাক্তার সাহেব আছেন?”
-”আরে সিনিয়র বউ আপনি? আসুন, আসুন, বসুন।”
-”আপনার এ্যামাজন জ’ঙ্গ’ল’ পরিদর্শন করতে আসলাম।”
-“দেখেই চলে যাবেন, থাকবেন না?”
-”থাকার ইচ্ছে ছিল কিন্তু এখন মত বদলাতে বাধ্য হচ্ছি?”
-”ওমা বলে কি, কেন?”
-”তাহলে ঝটপট রুমটা গুছিয়ে ফেলুন, আমি বসছি।”

ভোরের কথা শুনে তিতাস মুখ কুঁচকে ফেলল। গুছানো রুম তার পছন্দ নয়। মনে হয়, রুম গুছালে প্রয়োজনীয় কিছু সে খুঁজে পায় না। এরচেয়ে হাতের কাছে এটা ওটা পড়ে থাকে সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু বোধহয় তা আর হবে না। বিয়ে করেছে অর্থাৎ বউ এই রুমের অর্ধেক ভাগিদার। তাকে তার জিনিস বুঝিয়ে দেওয়া উচিত।

তাছাড়া অগোছালো রুমের দায়ে বউ চলে গেলে মান-সন্মান থাকবে না। এসব ভেবে সে রুম গুছানোর কাজে লেগে গেল। স্বেচ্ছায় জেনে শুনে বুঝে
সিনিয়র মেয়েকে বিয়ে করছে। এসব জ্বালাতন সহ্য করতেই হবে। কিছু বলতে গেলে উল্টে চড়থাপ্পড় খাওয়ার সম্ভবনাও নিশ্চিত। তিতাস হেলেদুলে নতুন বিছানার চাদর বের করল। তারপর সেটা উল্টে পাল্টে দেখে বলল,

-”আপনি সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে এক রুমে, এক বিছানায় থাকবেন? আমার না বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
-”তোকে বিশ্বাস করতে কে বলেছে? চুপচাপ কাজ কর।”
-” ওকে। ‘
ভোর গালে দিয়ে বসে তিতাসের কাজ দেখে নিজেও কাজে হাত লাগাল। নয়তো সারারাত ওর এখানে বসে থাকতে হবে। তিতাস প্রায় আধা ঘন্টা লাগিয়ে কেবল বিছানার চাদরখানা
পরিবর্তন করল।

বাকি রুমের কথা বাদই দিলাম। ভোরকেও হাত লাগাতে দেখে তিতাস মুখ টিপে হাসল। সে মূলত এমন কিছুই চাচ্ছিল। তারপর সে এদিক ওদিক হেঁটে কাজের ভাণ ধরে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে দৌড় দিলো। ভোর তার চালাকি বুঝতে পেরে চেঁচিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। একে কিছু বলার চেয়ে কলা গাছকে বলা উত্তম। বেশ সময় নিয়ে ভোর
পরিপাটি করে রুমটা গুছিয়ে ফেলল। পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে, ওর ট্রলিটা এনে একে একে জিনিসগুলো বের করে সাজিয়ে রাখল। থাকতে যখন হবেই, পাকাপোক্তভাবে এগুলোর বন্দোবস্ত করাও শ্রেয়। তিতাস ফ্রেশ হয়ে এসে ওর মাথা মুছতে মুছতে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে গালভর্তি হাসল।

রুমটা যেন পুনরায় প্রাণ খুঁজে পেলো। বিয়ে পড়ানোর একটু পরেই সকলের সাথে পেটভর্তি করে খেয়েছিল সে। এজন্যই এখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। পেটে ও মনে দু’টোতেই শান্তি বিরাজ করছে, এজন্য ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ আর পড়া হবে না, বিয়ের প্রথম রাত বলে কথা। ভোর গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা বই নিয়ে বিছানার কোণ ঘেষে শুয়ে পড়ল।
তখন তিতাস পানি খেয়ে বিছানায় বসে বলল,

-”আমার না খুব লজ্জা লাগছে?”
-”কেন?”
-“না মানে জীবনে প্রথমবার বউয়ের পাশে ঘুমাতে যাচ্ছি তাই আর কি।”
-”ঢং করা শেষ নাকি আরো করবি?”
-”আর একটু করি, ভালোই লাগছে।”

-”দূরে গিয়ে কর, তোর ঢং দেখার ইচ্ছে নেই আমার। আচ্ছা, রবিনকে ফোনে পাচ্ছি না কেন, কিছু জানিস তুই?”
-”হুম, সে একটু অসুস্থ তাই ছুটি দিয়েছি। একেবারে দুইমাস পর এসে দেখা করবে।”
একথা বলতে বলতে তিতাস শুয়ে পড়েছে। কারো মুখে কথা নেই। দু’জনেই নিশ্চুপ, নীরব। হয়তোবা যথাসাধ্য স্বাভাবিক থাকার প্রয়াস চালাচ্ছে। ভোরের দৃষ্টি জানালার দিকে আর তিতাসের দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে। চঞ্চল তিতাস এখন কেন জানি কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সে কিঞ্চিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ভোরের দিকে তাকাতেই দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেল। তিতাস ধরা পড়ে বোকামার্কা হাসি দিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। তখন ভোর অতি শান্ত কন্ঠে বলল,

-”তিতাস!”
-”হুম।’
-”পিয়াস কি সত্যিই সু/ই/সা/ই/ড করেছিল?”
-”না।”
-”তাহলে কে এমন করল? কিসের কারণে?’
-”আপনার কারণে।”
-”আমার!”
-‘হুম।”

ভোর বিষ্ময়ে আর কথা বাড়াতে পারল না। স্থির দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর নিজে উঠে বসে তিতাসকে টেনে উঠিয়ে ওর মুখোমুখি বসাল। তার মনে কৌতুহল কাজ করছে।অজানা কিছু প্রশ্নের উত্তর না জেনে নিজেকে দমাতে পারছে না। তিতাসের মুখে ফাজলামির রেশ নেই। অর্থাৎ সে মজা করছে না। ভোর এবার ধারালো দৃষ্টি ছুঁড়ে বলল,

-”তুই কোনোভাবে জড়িত নয় তো?”
-”না।”
-”সত্যি বলছিস নাকি পরে অন্য রুপ বের হবে?”
-“দু’মুখো মানুষ আমি নই।”
-”আর একটা সত্যি কথা বলবি?”
-” মিথ্যা বলার প্রয়োজন দেখছি না, বলুন শুনি।”

-”পিয়াসের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে তুই কি আমাকে পছন্দ করতি? সত্যিটুকু বল, কারণ এর উপরে নির্ভর করবে তোর আর আমার সংসার।”
-”আপনি আমার ভালোলাগা ছিলেন ভালোবাসা নয়।”
-”আর এখন?”

জবাবে তিতাস মুচকি হাসল। সেই সঙ্গে হেসে উঠল তার পুরুষালি গম্ভীর নেত্রজোড়া। ভোর আর জোর করল না,সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তার মস্তিষ্কে একটা কথায় খেলে গেল, ‘এসবের পেছনে কোনোভাবে কি সে দায়ী।’ সঙ্গে সঙ্গেে তার চোখ থেকে গড়িয়ে গেল কয়েকফোঁটা অশ্রুকণা। সেই সঙ্গে পিয়াসের হাসোজ্জল মুখশ্রী ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। তিতাস ওপাশ ওপাশ করেও ঘুমাতে পারল না।

সে ভোরকে একবার দেখে উঠে পড়তে বসল। অযথা সময় নষ্ট করার মানেই হয় না।ঠিক তখনই ওর কাছে হসপিটাল থেকে কল আসল। তাকে এই মুহূর্তে যেতে হবে। তিতাস তার কানে ফোন ধরা অবস্থা ভোরকে বলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। ভোর সাবধানে যেতে বলার আগেই সে দৃষ্টিতে বাইরে চলে গেছে।

রাত পেরিয়ে যখন ভোরের আগমন হলো, তিতাস পিয়াসের কবরের পাশে গিয়ে বসল।ওর প্রিয় ভাইরুপী বন্ধু চিরনিদ্রায় শায়িত।তিতাস মাটিতে বসে শুকনো পাতা পরিষ্কার করে থম মেরে রইল। হঠাৎ তার স্মরণে আসল ভোরের কথা। মেয়েটা না জানি কি করছে এখন।তবে এখন অবধি ভোরকে একটা মিথ্যা কথাও বলে নি সে। আর বলবেও না। কারণ তার সঙ্গে ওর পবিত্র বন্ধনের পাকাপোক্ত সম্পর্ক।

ভোরকে মিথ্যা বলে খুব সহজেই ধরা খাবে। তখন চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে না। ভোরও তার প্রতি বিশ্বাস হারাবে। এরচেয়ে সত্যি জেনে ভেঙে চুরে পুনরায় শক্ত হয়ে গড়ে উঠুক। সে দেখুক, আমাদের কাছের মানুষগুলোর মুখোশধারী রুপ। উপলব্ধিও করুক, একজন আর্দশ স্বামী কাকে বলে। তিতাস এসব ভেবে কবরের হাত বুলিয়ে মলিন হেসে বলল,

-”ভাইয়া, তোর বউকে আজ আমার বউ বানিয়ে নিয়েছি। তাছাড়া উপায় নেই রে। মেয়েটাকে ওরা বাঁচতে দিতো না।
ভোরের চারপাশে এমনভাবে জাল বিছানো ভোর কল্পনাও করতে পারবে না। মেয়েটা ভালো, সরল মনের। কিন্তু তার চারপাশে শত্রুর শেষ নেই।

এমনকি আমাদের বিয়ে পড়িয়ে ওর বাবা- মা যাওয়ার পথে এক্সিডেন্ট করেছে, না করানো হয়েছে। একথা আমি এখনো জানাতে পারি নি ভাইয়া। খুব গোপনে মানুষ দিয়ে হসপিটালের সব সামলাচ্ছি। এই দেখ, আমার শরীরে ওর বাবা মায়ের রক্ত। উনারা বোধহয় বাঁচবে না রে ভাইয়া। উনাদের অবস্থা খুব খারাপ। তোকে তো আমি আগেই জানিয়েছিলাম, ভোর এখন লাল শাড়িকে ভয় পায়।

প্রিয় তুই পর্ব ৭

কারণ পূর্বে লাল শাড়ি পরা অবস্থাতেই তোকে হারিয়েছিল, এবার তার বাবা-মাকে। মেয়েটা হয়তো এবার সত্যি সত্যিই ধরে নিবে, সে অপয়া, অলক্ষী।”

প্রিয় তুই পর্ব ৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.