মন গহীনে পর্ব ২৫ বোনাস
দোলন আফরোজ
অনেক বেলা করেই ঘুম ভাংগে কাব্যর। আজ মাথাটা বড্ড বেশি যন্ত্রণা করছে। দুহাতে মাথা চেপে ধরে বুঝার চেষ্টা করছে কোথায় আছে সে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারে ছাদের চিলে কোঠার ঘরটাতে আছে সে। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়েও ব্যার্থ হয়। আবারো বসে পরে খাটে। হুম ছাদের চিলে কোঠার ঘরে একটা খাট আর একটা শেল্ফ আছে।
শেল্ফ এ প্রয়োজনীয় সব কিছুই পাওয়া যায়। ছাদের এই ঘরটা সেলিম সাহেব শখ করেই বানান। মাঝে মাঝে শাহানারা বেগম কে নিয়ে চন্দ্র বিলাস করতে আসতেন উনি। এখন আর সেসব হয়ে উঠে না। সময় টাই হয়না যে।
কাব্য দুহাত খাটে রেখে পা ঝুলিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
পর্ব গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বুকের ভিতর টা এখনো ফাঁকা ফাঁকা ই লাগছে। কাল তিথীকে কফি শপে ছেলেটার সাথে দেখার পর কয়েক ধাপ মদ গিলেছে। তাই বাড়ি ফিরেছে সবাই শুয়ে পড়ার পর।এসে আবারো ছাদে বসে মদ গিলতে থাকে। তখনই ওখানে মেধা আসে। কারণ মেধা দেখেছিলো কাব্য ঢুলতে ঢুলতে বাসায় এসেই ছাদে চলে গেছে। তাই সেই পিছু নেয় কাব্যর। মেধা যখন কাব্যর কাছে যায় তখন সে হুস প্রায় হারিয়েই ফেলে, আর এই সুযোগ টাই নেয় সে।
কিরে ঘুম ভাংলো?
মেধার হাতে লেবু পানি আর কড়া লিকারের রঙ চা।
কথা বলতে ইচ্ছে করছে না কাব্যর।
মেধা এগুলো বিছানায় রেখেই কাব্যর মাথায় হাত দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে এখনো মাথা যন্ত্রণা করছে।?
হাত ধরে ফেলে কাব্য। কি করছিস কি? হুট হাট গায়ে হাত দিস কেনো? রাগত্ব স্বরে।
থমকে যায় মেধা। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তার। ছলছল চোখে শুধু এটুকু বলে, এভাবে বলতে পারলি আমায়?
উঠে দাঁড়িয়ে, তোর বুঝা উচিৎ, নাউ আই এম এ ম্যারিড পার্সন,উই শোড কিপ ম্যান্টেইন আওয়ার ডিসটেন্স। বলেই নিচে চলে যায়।
কাব্য যখন ফ্রেশ হয়ে নিচে ডাইনিং এ যায় তখন দেখে আজ সবাই বাসায়। কায়েস, সেলিম আহমেদ। চুপচাপ নিজের নাস্তা করছে সে। আর মনে মনে তিথীকে খুজছে। আজ তো তিথীর এক্সাম ও নেই, তবে কোথায় গেলো? রুমেও তো ছিলো না। আর আজ তো ফ্রাইডে ও না, ভাইয়া বাবা বাসায় কেনো? এসব ই ভাবছে কাব্য। তখন শেফালী কে জিজ্ঞেস করে, তোর ছোট ভাবি কই রে?
অর্না অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কাব্যর দিকে। হেনা বেগম আর হিয়া ও তাদের বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেলিম সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেন, শাহানা তোমার ছেলেকে ন্যাকামো করতে মানা করো। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে আমার। শাহানারা বেগম এবার কেঁদেই দেন।
কিছুই বুঝতে পারে না কাব্য। সবাই এমন রিএক্ট করছে কেনো।
কি ব্যাপার বলছিস না কেনো?
কাব্যর ধমকে শেফালী প্রায় কেঁদে দিয়ে বলে ভাবি তো চইলা গেছে।
কাব্য শুধু ছোট করে বলে, চলে গেছে? সত্যিই আমার পুতুল বউ চলে গেছে আমাকে ছেড়ে?
সেলিম সাহেব রেগে বলেন, কি নাটক করছিস? তোর মেধাকেই পছন্দ, তুই কেনো শুধু শুধু তিথীর জীবন টা নষ্ট করলি?
পাগল হয়ে গেছো তুমি বাবা?( আজ অনেক বছর পর বাবা ডাকলো কাব্য) মেধাকে আমার কোনোদিন ও বউ হিসেবে পছন্দ না এটা সবাই জানো। তবে কেনো সব আজগুবি কথা বলছো।
তখন শাহানারা বেগম বলেন কাল রাতে তিথী মেধা আর কাব্য কে কি অবস্থায় দেখেছে আর তাদের কথোপকথন, আর কাব্যর তিথীকে বলা সব কথা গুলো।
মেয়েটা কাল শুধু তোর জন্যই সেজেগুজে বসে ছিলো। নিজের ভালোবাসাকে কনফেজ করতে চেয়েছিলো কাল। আর তুই কিনা…
মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে কাব্য।
তখন মেধা বলে কাব্য তিথীকে বিয়ে করা টা ওর জীবনে করা সব চেয়ে বড় ভুল। ও যখন ওর ভুল টা শুধরাতে চাইছে তাতে তো তোমাদের আপত্তি থাকার কথা না।
এবার রেগে যায় কাব্য। এই মেয়ে তোর মাথা ঠিক আছে? আমি তিথীর জন্য কতোটা পাগল সবটা জানার পর ও তুই কি করে এই কথা বলছিস?
রাগিস না প্লিজ, আমি বুঝতে পারছি তোর কষ্ট টা। তিথী তো বাচ্চা মেয়ে, তোর মন বুঝে না। তাই তুই মানিয়ে নিতে পারছিস না। তোর জীবন ম্যাচিউর কাউকে দরকার যে তোকে আগলে রাখবে।
বাহ মেধা বাহ, এগুলা বলেই তুই তিথীর মাথাটাকে বিগড়ে দিয়েছিস। তুই আমাকে ছোট বেলা থেকে জানিস। তোকে আমি বন্ধু হিসেবে সবার উপরে প্রাধান্য দেই কারণ আমাকে ডিপ্রেশন থেকে এক সময় তুই ই বের করেছিলি। আর সেই সুযোগ টাই নিলি তুই।
ভুল বুঝছিস তুই আমাকে। আমি তো তোর কষ্ট দেখেই কথা গুলো বললাম।তুই জানিস আমি তোর ব্যাপারে কতোটা পজেসিব।তোর সামান্য পরিমাণ কষ্ট আমার সহ্য হয় না।
হিয়াঃ প্লিজ মেধা আপু, আর ব্রেইন ওয়াশ করো না ভাইয়ার। এতোদিন কাউকে যা বলিনি, আজ ও যে ছেড়ে দিবো তোমায় তা কিন্তু ভেবো না।ভাবিকে কি বলেছো ভাবি আর কাউকে না বললেও কিন্তু আমাকে ঠিক ই বলেছে।
মেধাঃ চোখ রাংগিয়ে, তুই কিন্তু বেশি করছিস হিয়া।
কাব্য ঃ কি বলতে চাস ঠিক করে বল। কি বকেছে তিথীকে ও? চোখ গরম করে।
হিয়া বলতে যাবে তখনই চিৎকার করে উঠে মেধা।কি বলবি তুই? হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, ভালোবাসি আমি কাব্য কে। একদিনে আমি এই জায়গায় আসিনি। কাব্য আমার অনেক বছরের সাধনা। একটু একটু করে ওর মনে জায়গা করেছি আমি। কেনো ঐ মেয়েটা হুট করে এসে আমার কাব্য জীবনে জুড়ে বসবে। আর তা আমি হতে দিবোই কেনো? দিবো না আমি কাব্যর ভাগ কাউকে। বলে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পরে মেধা।
ওর কথা শুনে নিজের জায়গা থেকে দু কদম পিছিয়ে যায় কাব্য। নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না ও। সব ঘটনায় যেনো স্বপ্নের মতো লাগছে। এতো বছরের চেনা মানুষ টা আজ কি করে এমন অচেনা কথা বলতে পারে বিশ্বাস হচ্ছে না তার।পাশে থাকা চেয়ারটায় বসে পরে কাব্য।
শাহানারা বেগম সেলিম সাহেব কে বলেন, আমি তোমাকে ৬/৭ বছর যাবৎ ই বলে যাচ্ছি এ কথা। কোনোদিন কানে নাউনি আমার কথা। আমি মেয়ে, বুঝি একটা মেয়ের মনে কি চলে। আর তোমার ছেলেকেও চিনি আমি, পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাক তার পুতুল বউ কে সে খুঁজে বের করবেই তাই বলেছিলাম দুজনকে আলাদা রাখতে। শুনলে না আমার কথা।
কাব্য বলে, বিশ্বাস কর, আমি কোনো দিন তোকে সে নজরে দেখিনি, আর তোর সাথে এমন কোনো বিহেইভ ও করিনি যে তুই এসব ভাবতে পারিস। আর সবচেয়ে বড় কথা পুতুল বউ কে নিয়ে প্রতিটা অনুভূতির কথা তোর সাথেই আমি শেয়ার করতাম। তারপর ও কি করে ভাবতে পারলি তুই এসব?
মেধা ছুটে এসে কাব্যর পায়ের কাছে বসে বলে, না তোর কোনো দোষ নেই, আমিই এসব ভেবে নিয়েছি। আজ যখন জানলি প্লিজ আমায় ফিরিয়ে দিস না কাব্য। আমি তোকে সহ্য করতে পারি না ঐ তিথীর সাথে। তুই ও সুখী হবি না ওর সাথে। বিশ্বাস কর, আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো তোকে সুখে রাখার।
ফট করে উঠে মেধার থেকে দূরে সরে গিয়ে,প্লিজ মেধা আমাকে আর ছোট করিস না। আমারি ভুল ছিলো, জীবনে কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত, তবে কেনো তোর সাথে বন্ধুত্ব করতে গেলাম, কেনো তোকে এতো প্রশ্রয় দিতে গেলাম। ছিহঃ
এভাবে বলিস না কাব্য, দেখিস আমরা এক সাথে অনেক সুখি হবো।
তুই এতো বছরে কেনো বুঝতে পারছিস না তিথীতেই আমার সুখ।
এবার ঝাঝালো কন্ঠে বলে মেধা, এই কিসের সুখ রে? বিয়ের প্রায় ১ বছর হতে চল্লো, এতোদিনেও কি ফিজিক্যাল হতে পারছিস তুই তিথীর সাথে? ওই মেয়ে কিচ্ছু বুঝবে না তোর। তোর শক, আহ্লাদ, চাহিদা কিচ্ছুনা।
তুই পাগল হয়ে গেছিস মেধা, তুই পাগল হয়ে গেছিস। কোথায় কি বলছিস কিচ্ছু বুঝতে পারছিস না।
কাব্যর দুহাত চেপে ধরে, হ্যাঁ তুই যেদিন বিয়ে করেছিস সেদিন থেকেই আমি পাগল হয়ে গেছি। তোর জন্য পাগল হয়ে গেছি। তোর এই পাগল টাকে নিজের করে নে না।
লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে কাব্য। মেধার দু বাহুতে হাত রেখে বলে, দেখ আমি ভালোবাসাকে সম্মান করি। আর বন্ধু হিসেবে তোকেও যথেষ্ট সম্মান করি। নিজেকে বেহায়া বানিয়ে ফেলিস না। আর আমার জীবনে ছোট থেকেই একটা নারীর ই অস্তিত্ব। আর আমি নিজেও যদি চাই সেখানে আর কাউকে বসাতে পারবো না। আশা করি বুঝাতে পেরেছি তোকে।
এমন করিস না কাব্য প্লিজ।
বন্ধু হিসেবে যদি আমাকে কোনো দিন এতোটুকুও ভালোবেসে থাকিস, তবে আর কখনো আসিস না আমার সামনে। বলে শাহানারা বেগম কে বলে, মা আমি তিথীকে আনতে যাচ্ছি। বলেই বেড়িয়ে যায় কাব্য।
মেধার জন্য সবার খারাপ লাগলেও এখন মেধাকে কাব্য তিথীর জন্য বিপদজনক ই মনে হচ্ছে সবার।
মন গহীনে পর্ব ২৫
সেলিম সাহেব বলেন, আমিই তোমাকে প্রায় ১৫ বছর আগে এ বাড়িতে এনেছিলাম তাই বের করে দিতে পারবো না এখন। শুধু অনুরোধ করবো আমার ছেলে ছেলে বউ আসার আগে চলে যাও মা।
মেধা বুঝতে পেরে যায় কাব্যর জীবনে কখনো তার জায়গা ছিলো না আর ভবিষ্যতেও হবে না।