শেষ পাতায় তুমি পর্ব ১২
ফাবিহা নওশীন
মাহি আজ চলে যাচ্ছে। মেহেরের বুক ফেটে যাচ্ছে। এমনিতে দূরেই থাকে কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ওর আপু পর হয়ে যাচ্ছে। অন্যের অধীনে চলে যাচ্ছে। যেমনটা ওর হয়েছে। বিয়ে নামক শব্দটা ওর নিজের থেকে নিজেকেই কেড়ে নিয়েছে।
মাহি আর মেহের একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তূর্জ দু-বোনের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে মাহিকে কোলে তুলে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার বউকে আর কাদাস না। বইন এইবার নিয়ে যেতে দে।”
মেহের এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাদছে। ফায়াজ ওর সামনে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি দেখছি কান্নাকাটি করে মেকাপ নষ্ট করে ফেলছ। মনে হচ্ছে তোমার বিয়ে। কনে বিদায় বেলায় কাঁদতে কাঁদতে মেকাপ খারাপ করে ফেলছে। অদ্ভুৎ।”
মেহের ভ্রু কুচকে ফায়াজের দিকে তাকাল। এমন সিচুয়েশনে কি করে মজা করতে পারে। এটা মজা করার সময়। ইচ্ছে করছে মাথা ফাটিয়ে ফেলতে।
মাহি বিদায় নিয়ে চলে গেল। পুরো বাড়ি ধীরে ধীরে মানুষ শূণ্য হতে লাগল।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
আলোক বাতি নিভে গেছে। বাড়িতে দু’চার জন আত্মীয় ছাড়া সবাই চলে গেছে। তাই বাড়িটাও নীরবতায় ছেয়ে গেছে। সবাই হয়তো গভীর ঘুমে বিভোর। সারাদিন খুব ধকল গেছে। তাই ক্লান্তি নিয়ে দু চোখের পাতা বন্ধ করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই।
মেহের জেগে আছে। মাহির জন্য মন খারাপ কিন্তু এটা ভেবে ভালো লাগছে বিয়েতে ফায়াজ কোনো ঝামেলা করে নি। কিন্তু কেন করে নি এটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ফায়াজ কি চায় এটা তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মেহের ভেবে কূল-কিনারা করতে পারছে না। কিন্তু ফায়াজ এটাও বলেছে মেহের ওকে বিয়ে করলে মাহির বিয়েতে ঝামেলা করবে না ঠিক তাই হয়েছে। কিন্তু ফায়াজ ওর কাছে কি চায়? ওকে কেন বিয়ে নামক সম্পর্কে বেঁধে রেখেছে? ওর মাথায় কি চলছে?
মেহেরের ছোট্ট মাথায় কিছুই ধরছে না।
মেহের ফায়াজের দিকে ঘুরল। ফায়াজ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মেহের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করল। তারপর ভাবতে লাগল,
“ফায়াজ এভাবে ঘুমাচ্ছে কিভাবে? এত প্রশান্তি মাখা ঘুম। ফায়াজ না আপুকে ভালোবাসে? আজ আপুর বিয়ে হয়ে গেল। বাসর হবে। উনার তো ছটফট করার কথা, নির্ঘুম রাত কাটানোর কথা কিন্তু উনি এতটা শান্ত কিভাবে?”
মাহি মুখ ভার করে বাসর ঘরে বসে আছে। তূর্জ ওর মন ভালো করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মাহি গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তূর্জ মাহিকে বলল,
“দেখো আমি কত ভাগ্যবান। আমিই হয়তো প্রথম যে আটা-ময়দা মাখানো বউ নয় একদম সলিড পিচ বিয়ে করে এনেছি। ভবিষ্যতে গর্ব করে বলতে পারব কোনো আটা ময়দাকে বিয়ে করি নি।”
মাহি মৃদু হেসে বলল,
“তোমার খারাপ লাগছে না?”
“আমার কেন খারাপ লাগবে?”
“দেখো সব ছেলেই বিয়ের প্রথম দিনে বউসাজে বউকে দেখতে চায়। দুচোখ ভরে দেখতে চায় কিন্তু তুমি তো তার কিছুই পেলে না। খারাপ লাগছে না?”
তূর্জ মাহির হাত ধরে বলল,
“সত্যি বলতে একটু লাগছে কিন্তু ভালো লাগছে এটা ভেবে আমার মাহিরাকে আমি সারা জীবনের জন্য পেয়ে গেছি। বউ যখন হয়েছে তখন বউরুপে সারাজীবন দেখতে পারব।”
মাহি মৃদু হেসে তূর্জকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কোনো দিন ভুল করলে ভুল বুঝে দূরে চলে যেও না। জেনে রাখবে মাহিরা তোমাকে অনেক ভালোবাসে।”
রিসিপশনে ফায়াজ-মেহের হাজির। আজ মেহের নিজেকে ব্ল্যাকে সাজিয়েছে। ব্ল্যাক শাড়ির সাথে গর্জিয়াছ সাজে নিজেকে সাজিয়েছে। গলায় ডায়মন্ডের নেকলেস। কেন জানি নিজেকে এখন বড় বড় মনে হয় আর খুব সাজগোজ করতে ইচ্ছে করে। বিয়ে হয়েছে তাই কি?
মাহি আজো সাজতে পারে নি। কিন্তু মেহমান আসবে বিধায় রিসিপশনে আসতে বাধ্য হয়েছে। চোখে কাজল টেনে, ঠোঁটে লিপস্টিপ লাগিয়ে তূর্জের পাশাপাশি বসে আছে।
মেহের এক প্রকার দৌড়েই মাহির কাছে যেতে চাইলে ফায়াজ ওর হাত ধরে চোখ পাকিয়ে তাকাল।
মেহের দাঁড়িয়ে গেল। তারপর ফায়াজ আর মেহের হাতে হাত রেখে ওদের সঙ্গে কথা বলতে গেল। ফায়াজ কিছুক্ষণ থেকে অন্য দিকে গেল। মেহের ফায়াজকে খোঁজছে। ফায়াজকে চোখে চোখে রাখতে চায়। এই বাড়িতে কোনো রুপ সিনক্রিয়েট চায় না।
তূর্জের কাজিনদের সঙ্গে মেহেরের দেখা হয়ে গেল। তূর্জের চাচাতো ও মামাতো বোনেরা। ওরা এটা সেটা বলছে। মেহের ভদ্রতার খাতিরে দাঁড়িয়ে কথার উত্তর দিচ্ছে কিন্তু ওর চোখ ফায়াজকে খুজে বেড়াচ্ছে।
“আরে মেহের যে তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে গেছো। বিউটিফুল।”
তূর্জের চাচাতো ভাই মেহেরকে কথাটা বলল।
মেহের ছেলের কন্ঠ পেয়ে চমকে তাকাল।
মেহের কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। ধন্যবাদ দিবে? না চুপ করে থাকবে?
ফায়াজ কোথ থেকে এসে বলল,
“বিয়ের পর সব মেয়েরাই সুন্দর হয়ে যায়। এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। আর ভাই বিবাহিত মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করা মানে সময় নষ্ট। এই সময়টা অবিবাহিত কারো সাথে করলে যদি সিঙ্গেল থাকেন তো মিঙ্গেল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।”
বাকা হেসে মেহেরের হাত ধরে অন্যদিকে নিয়ে গেল।
“তুমি কি এক জায়গায় স্থির থাকতে পারো না? যেই না একটু একা ছেড়েছি প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছো? এই জন্য এত সাজগোজ করেছো তাই না?”
ফায়াজ চোখ মুখ শক্ত করে বলল।
মেহের ফায়াজের কথা শুনে হা হয়ে গেল।
তারপর আমতা আমতা করে বলল,
“আমার বোনের বিয়ে আমি সাজবো না তো প্রতিবেশিরা সাজবে?”
ফায়াজ মেহেরের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই মেহের চুপসে গেল। ফায়াজ বাকিটা সময় মেহেরের সাথে আঠার মতো লেগে ছিল। একা ছাড়ে নি। এমনকি ওয়াশরুমের বাইরেও দাঁড়িয়ে ছিল মেহেরের জন্য।
বিয়ে শেষ। আড়ম্বরও শেষ। ফায়াজ এখন বাড়িতে যেতে চায়। এখানে থেকে আর কি লাভ? নিজের লাইফস্টাইলের নিয়মের ব্যাঘাত ঘটছে।
ফায়াজ তরিঘটি করে রুমে ঢুকে দেখে মেহের বিছানার উপর বসে ফোন টিপছে।
“মেহের ব্যাগপত্র গুছাও। আমরা বাড়ি ফিরে যাব। এখানে সব চুকিয়ে গেছে। সো থাকার আর কারণ দেখছি না।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে ফায়াজের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ভাবতে লাগল,
“মাহি আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আমার সাথে উনার কিসের লেনদেন?”
ফায়াজ মেহেরকে চুপ দেখে বলল,
“কিছু বলেছি কিন্তু উত্তর পাই নি। আমি অপেক্ষা করে থাকা একদম পছন্দ করি না।”
মেহের বলবে কি না বুঝতে পারছে না। অতঃপর মুখ খুলল,
“আপনার আমাকে দিয়ে কি কাজ? আমার সাথে আপনার কি লেনাদেনা? আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। তবুও আমাকে আপনার বাড়িতে নিতে চাইছেন কেন? আমি গিয়ে কি করব?”
ফায়াজ মেহেরের কথার সারমর্ম বুঝতে পারল।
“তুমি যদি ভেবে থাকো তুমি যাবে না তাহলে বলব তুমি ভুল ভাবছো। তোমাকে আমার সাথে ফিরতে হবে। আর তোমাকে দিয়ে আমি কি করব সেটা তোমার না জানলেও হবে। মাহির জন্য আমাকে বিয়ে করেছো তো? তাহলে শোনো মাহির খুশি এখনো তোমার হাতে। তুমি যতদিন আমার সাথে থাকবে মাহি নিরাপদ। কিন্তু তুমি যদি আমার কাছে না থাকো তবে কি হবে বলতে পারছি না। শুধু জানি ভয়ানক কিছু হবে। আচ্ছা একটা প্রশ্নের জবাব দেও কোনো সম্পর্ক গড়ার আগে ভাঙার কষ্ট বেশি না সম্পর্ক গড়ার পরে ভাঙার কষ্ট বেশি?”
মেহের ফায়াজের দিকে অসহায় ফেস করে চেয়ে আছে উত্তর না দিয়ে।
ফায়াজ বাকা হেসে বলল,
“ডিভোর্স নামে একটা শব্দ আছে ভুলে গেছো?”
মেহেরের বুক কেঁপে উঠল ডিভোর্সের কথা শুনে। মেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। যার মানে মেহেরকে ফিরতে হবে ফায়াজের সাথে। ফায়াজ ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে নিজের জামা কাপড় লাগেজে রাখছে।
মেহের যাওয়ার সময় মেহেরের মা খুব কাঁদল। দুটো মেয়েই বাড়িটা শূন্য করে চলে গেল। যে বাড়িটা মেয়েদের পদচারণায় বিমোহিত থাকতো সেখানে এখন নীরবতা বিরাজ করবে। কিন্তু মেহের কাঁদল না। জীবন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে কান্নার স্থান নেই।
ওরা রাতেই রওয়ানা দিল। সকালে ভার্সিটিতে ক্লাস এটেন্ড করতে হবে। ফায়াজ ড্রাইভ করছে।মেহের চুপ করে আছে। কোনো শব্দ করছে না। ফায়াজ গাড়ি থামাল। গলা শুকিয়ে গেছে কিন্তু গাড়িতে কোনো পানীয় সামগ্রী নেই। ফায়াজ গাড়ি এক সাইডে পার্ক করে মেহেরকে বলল,
“আমি আসছি। চুপচাপ বসে থাকবে। একদম বের হবে না। আমি এখুনি চলে আসব।”
মেহের মাথা নাড়িয়ে ঠিক আছে বলল।
ফায়াজ গিয়েছে অনেকক্ষণ এখনো আসার নাম নেই। এমনিতেই মেহেরের অন্ধকারে একা থাকতে ভয় লাগে। আর অনেকক্ষণ হলো ফায়াজ গেছে। মেহেরের এখন ভয় লাগছে। ফায়াজ আবার ওকে এই রাস্তায় ফেলে চলে গেল না তো?
মেহের ফায়াজকে ফোন করছে কিন্তু নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না। তাই মেহের বাধ্য হয়েই বের হলো। ভয়ে ভয়ে গাড়ি থেকে বাইরে পা রাখল। দুয়েক পা সামনে এগুতেই নেটওয়ার্ক পেল কিন্তু ফায়াজ ফোন রিসিভ করছে না। মেহের বারবার ট্রাই করে যাচ্ছে কিন্তু ফায়াজের রিসিভ করার নামগন্ধ নেই। মেহের ভাবছে এখন কি করবে? ফায়াজ কি সত্যিই ফেলে চলে গেল? কোন দিকে গেল? মেহের এখন কোন দিকে যাবে? আশেপাশে তেমন মানুষও নেই। নিজে ড্রাইভও করতে পারে না।
মেহের তখনই গাছের আড়ালে ঝোপের পাশে হাসির শব্দ পেল। একটা লোক অদ্ভুৎ শব্দ করে হাসছে চোখগুলো রসগোল্লার মতো বড় বড় করে। আর চোখগুলো মনে হচ্ছে জ্বলছে। মেহের ভয়ে জোরে চিতকার করে উঠল।
ফায়াজ দু’হাতে দুটো পেপসি নিয়ে ফিরছিল মেহেরের চিতকার শুনে এক প্রকার দৌড়ে এল।
মেহের কাছে এসে বিচলিত হয়ে বলল,
“কি হয়েছে? চিতকার করলে কেন?”
মেহের ফায়াজকে দেখে কিছুটা সাহস পেল। ফায়াজকে ঝাপটে ধরল। তারপর কাঁদতে লাগল। ওর সারা শরীর ভয়ের চোটে কাঁপছে। ফায়াজ মেহেরের কাপুনি অনুভব করতে পারছে। ফায়াজের দু হাতে বোতল থাকায় মেহেরকে সরাতে পারছে না।
“কি হয়েছে? ভয় পেয়েছ? বের হয়েছ কেন?”
মেহের কান্না আর ভয়ের কারণে কিছুই বলতে পারছে না। কিছু বলছে কিন্তু ফায়াজের বোধগম্য হচ্ছে না।
“মেহের এখানে কিছু নেই। তুমি সোজা হয়ে দাঁড়াও তারপর বলো কি হয়েছে?”
ফায়াজ দু’টো বোতল এক হাতে নেওয়ার চেষ্টা করে মেহেরকে সরাচ্ছে। মেহের ফায়াজকে ছেড়ে একটু সরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ওখানে….! ”
“ওখানে কি? আর কোথায়? আমি বুঝতে পারছি না।”
মেহের ফুপাতে ফুপাতে আঙুল দিয়ে লোকটাকে দেখাল। ফায়াজ একজন মধ্যবয়সী লোককে দেখতে পেল। ফায়াজ গাড়ির উপর বোতল রেখে লোকটাকে রেগেমেগে কিছু বলতে যাবে তখনই লোকটার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখল উনার গায়ে ছেড়া- ময়লা জামাকাপড়, একটা চাদর গায়ে জড়ানো। চুলগুলো এলোমেলো উসকোখুসকো। সারা শরীরেই ময়লা। ফায়াজ বিহেভিয়ার দেখে বুঝল লোকটা পাগল।
ফায়াজ চোখ উল্টিয়ে মুখ দিয়ে শব্দ করে বলল,
“আরে ইনি পাগল। দেখছো না?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে আরো ভয় পেয়ে গেল। কান্না থামিয়ে বলল,
“উনি কিভাবে হাসছিল? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছি।”
ফায়াজ তারপর ধমক দিয়ে বলল,
“বের হতে নিষেধ করি নি? বের হয়েছো কেন?”
“আমার একা একা ভয় লাগছিল। তাই আপনাকে ফোন করার জন্য বের হয়েছি। কিন্তু আপনি ফোন রিসিভ করেন নি।”(অভিমানী কন্ঠে)
পাগল লোকটা ওদের সামনে এসে আবারো হাসল। তবে আগের মতো নয়। একটা রুটি ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে।
ওদের দিকে রুটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
” নে খা, খা,।”
মেহের ভয়ে ফায়াজের পেছনে গিয়ে লুকালো। ফায়াজ মৃদুভাবে হেসে বলল,
“না চাচা খাবো না। আপনি খান।”
লোকটার গলা শুকনো রুটি খেয়ে খুশ খুশ করছে। সেটা দেখে ফায়াজ একটা পেপসির বোতল খুলে উনাকে দিল। উনি সেটা নিয়ে খুশি মনে গলা ভিজিয়ে নিল।
লোকটা মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই মাইয়া, যাবি? যাবি তুই আমার সাথে?”
মেহের যাওয়ার কথা শুনে আরো ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজের শার্ট খামচে ধরে আছে।
ফায়াজ মজা করে বলল,
“জি চাচা নিয়ে যান। এই মেয়ে আমার কাছে থাকতে চায় না। আপনি নিয়ে যান।”
ফায়াজের কথা শুনে মেহের আবারো কেদে দিল।
ফায়াজ মেহেরকে বলল,
“উনি তোমাকে খুব আদরে রাখবে। ভালোবাসবে। যাও উনার সাথে।”
পাগল লোকটা ভিষণ খুশি।
মেহের কাদতে কাদতে বলল,
“আমি যাব না। আমি কোথাও যাব না। আমি আপনার সাথে যাব। আমাকে উনার কাছে রেখে যাবেন না প্লিজ।”
ফায়াজ বলল,
“আরে ভালো লোক। ভয় পাও কেন? থাকো উনার সাথে।”
মেহের রাজ্যের কান্না জুড়ে দিল। ফায়াজের শার্ট খামচে ধরে আছে। ওর একি কথা যাবে না।
ফায়াজ মেহেরের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসছে৷ মেয়েটা এত বোকা।
“আচ্ছা, আচ্ছা। কান্না থামাও।”
“চাচা যাবে না ও। আমার কাছেই থাকবে। তুমি কিছু খাবে? চলো কিনে দেই।”
ফায়াজ মেহেরকে গাড়িতে রেখে যেতে চাইলে মেহের ফায়াজের সাথে যায়৷ একা থাকবে না।
ফায়াজ একটা দোকান থেকে বিভিন্ন খাবার কিনে দিল। দোকানের লোকের কাছে শুনল উনি ১২ বছর ধরে এখানেই থাকে। মেয়ে হারিয়ে পাগল হয়ে গেছে। এলাকার ছেলেরা রাস্তার ধারে একটা খুপরি বানিয়ে দিয়েছে সেখানেই থাকে। ফায়াজ সেই খুপরিতে খাবার গুলো দিয়ে এলো।
মেহের ফায়াজকে দেখে অবাক হচ্ছে। একটা পাগলকে নিয়ে তার কত মাথাব্যথা, কত চিন্তা। তার প্রতি কি সুন্দর ব্যবহার। তারপর মনে মনে বলল সবার জন্য দরদ আছে আমি বাদে।
ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,
“আমার মনে হয় এই পৃথিবীতে সব চেয়ে সুখী পাগলেরা।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“কিভাবে? ওরা রাস্তায় ময়লা জামাকাপড় পড়ে থাকে। খাবার পায় না। ঘরবাড়ি নেই।”
ফায়াজ মুচকি হেসে বলল,
” তাই তো সুখী। ওদের কোনো বোধবুদ্ধি নেই। আমাদের মতো অনুভব ক্ষমতা নেই। দেখোনা ওরা গরমের মধ্যে গায়ে কত সুয়েটার,জ্যাকেট পড়ে থাকে। আবার শীতের মধ্যে একটা পাতলা জামা কিংবা উলঙ্গ থাকে। ওদের মারলে ব্যথা পায়,কাদে। কিন্তু তুমি এক টুকরো রুটি দিবে তাতেই খুশি। থাকার জন্য একটু ভাঙাচোরা জায়গা দিবে তাতেই থাকবে। ওরা খুব সরল তাই তো সুখী। কেউ কটু কথা বললে আমাদের মতো কেদে ভাসায় না। উড়িয়ে দেয়। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু ভয় পায় না। আমাদের মতো মানসিক যন্ত্রণা নেই।”
মেহের ভেবে দেখল ঠিক বলেছে ফায়াজ। নিজেরা কত আরামে থেকেও দুঃখ দুঃখ বলে বুক ভাসায়।
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ১১
ফায়াজ ফাইজার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে। মেহের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেদিকে দেখছে। হটাৎ করে ফায়াজের মা সামনে এলে ফায়াজ হুট করে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিল। রাগে ফুসফুস করছে। মেহের ব্যাপারটা কিছুই ধরতে পারল না। সাথে সাথে কল। ফায়াজ কল রিসিভ করে উচ্চস্বরে বলল,
“তোকে কতদিন বলেছি আমি উনার সাথে কথা বলতে চাই না। এমনকি তার চেহেরাও দেখতে চাই না। তুই আবার একি কাজ করলি। আমাকে আর ফোন করবি না।”
সাথে সাথে ফোন কেটে দিল। মেহের এতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলেও সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। বইয়ে মন দেয়। তারপর দেখা গেল ফায়াজ নিজের রাগ ওর উপর ঝাড়ল।
ফায়াজ রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেল।