শেষ পাতায় তুমি পর্ব ১৬
ফাবিহা নওশীন
ওদের চাহুনি দেখে ফায়াজ মুচকি হাসল। তূর্জকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আরে ভাইয়া আপনি অবাক হচ্ছেন কেন? আপনি জানেন না আমরা পূর্বপরিচিত?”
তূর্জ জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে বলল,
“হয়তো ভুলে গেছি।”
তারপর মাহির দিকে তাকাল।
ফায়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“এক্সকিউজ মি, আমার একটা কল করতে হবে। ইউ গাইস কেরি অন।”
ফায়াজ ফোন টিপতে টিপতে চলে গেল। তূর্জ মাহি আর মেহেরের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে উঠে গেল। এই হাসির মধ্যে অভিমানের সংযোগ রয়েছে।
মাহিও তূর্জের পেছনে পেছনে গেল। তূর্জ মাহিকে রুমে দেখতে পেয়ে বলল,
“ফায়াজ তোমার সম্পর্কে এতকিছু কি করে জানে? ওর সাথে কি সম্পর্ক তোমার?”
তূর্জের কথা শুনে হালকা ঢোক গিলে মাহি আমতা আমতা করে বলল,
“তুমি তো জানো ও আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে। তোমাকে বলেছিলাম।”
“হ্যাঁ জানি। কিন্তু ওর কথার ধরণ তা বলছে না। তোমার ঝাল খাওয়া না খাওয়া সম্পর্কে কি করে জানল?”
মাহি মাথা নিচু করে নিল। তূর্জ মাহির সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“মাহি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি। উত্তর দেও।”
মাহি মাথা তুলে তূর্জের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও আমার ক্লাসমেট। এক সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় অনেকেই অনেক কিছু জানতে পারে।”
তূর্জ বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ক্লাসমেট? কই তুমি তো আমাকে কখনো বলো নি।”
“তুমি কখনো জিজ্ঞেস করো নি।”
তূর্জ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“কিন্তু তোমার আচরণ দেখে মনে হয় তুমি ফায়াজকে অপছন্দ করো৷ তাহলে এতটা সখ্যতা কিভাবে হলো যে এক সাথে মুড়ি খেতে যাও?”
মাহি ওর কথা শুনে কিছুটা দমে গেলেও স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
“তূর্জ ওকে আমার অপছন্দ করার কারণ তুমি জানো। ও কেমন ছেলে তোমাকে বলেছি। আর অপছন্দ হলেও অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়। এখন যেমন মেহেরের খাতিরে ওর সাথে খাচ্ছি, বসছি, গল্প করছি আর এক বাড়িতে থাকছি।”
তূর্জ মাহির গালে হাত রেখে বলল,
“তুমি মেহেরের জন্য আপসেট। কিন্তু ফায়াজ ছেলেটা অতটাও খারাপ না। মেহের ভালো থাকবে। এখন অল্প বয়স,রক্ত গরম তাই মারামারি করে। পড়াশোনা শেষ করে যখন কর্মজীবনে যাবে তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি টেনশন করো না।”
“আমি তো তাই চাই তূর্জ। রোজ প্রার্থনা করি যাতে ফায়াজ ভালো হয়ে যায়। মেহেরকে ভালোবেসে, ভালো রাখে। ওরা ভালো থাকুক এটাই আমার চাওয়া।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। অল্প বৃষ্টি হলেও হিম শীতল বাতাস বইছে। আবহাওয়া যথেষ্ট ঠান্ডা। বাড়ির দরজা-জানালা সব বন্ধ করে রেখেছে। পুরো পরিবার এক সাথে বসে ডিনার করছে। ফায়াজ চুপচাপ খাচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে। মাহির জাস্ট অসহ্য লাগছে। ফায়াজের দৃষ্টি মাহির দিকে না থাকলেও মাহির দৃষ্টি ফায়াজের দিকে। মনে হচ্ছে এই বুঝি কিছু করবে। এখন তো বাবাও আছে। এমন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় খাওয়া যায়? কোথায় এতদিন পর শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছে। পুরো পরিবারের সাথে আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকবে। তা না সব সময় টেনশনে থাকতে হয়। ফায়াজ আশেপাশে থাকলেই বুক ঢিপঢিপ করে।
মেহের মাহির কাছে তরকারির বাটি চাইল। মাহি একবার ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজের পুরো মনোযোগ প্লেটের দিকে। মাহির মাথায় একটা বুদ্ধি এলো ফায়াজকে এখান থেকে সরানোর। মাহি তরকারির বাটি জোরে ধাক্কা মেরে ফায়াজের দিকে দেয় যাতে ফায়াজের উপর পুরো তরকারি শুদ্ধ বাটি পড়ে যায়। বিষয়টি মেহের খেয়াল করে। ফায়াজের উপর তরকারি পড়ে জামা নষ্ট হবে। তাই দ্রুত ফায়াজকে হাত দিয়ে আলতো ধাক্কা মেরে সরাতেই
মেহেরের উপর পুরো তরকারি পড়ে গেল। মেহের চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে নিজের দিকে।
তারপর কাদো কাদো হয়ে বলল,
“ইয়াক! এটা কি হলো? মায়ায়ায়া।”
মেহেরের মা দ্রুত উঠে মেহেরের শরীর থেকে টিস্যু দিয়ে তরকারি মুছতে মুছতে বলল,
“আহারে, কিভাবে পড়ল? মাহি তুই চোখে দেখিস না?”
মাহির মাথায় হাত। কি করতে চাইল আর কি হলো?
মেহের গোসল করে মাত্র বের হলো। এই শীতের রাতে গোসল করতে গিয়ে জান শেষ। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। শরীর থরথর করে কাঁপছে।
ফায়াজ মেহেরকে দেখে বলল,
“এই তুমি কি ভূত দেখেছো? এভাবে কাঁপছো কেন?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকাল। তারপর মনে মনে বলছে,
“সব সময় ফাজলামি। আমারি ভুল হয়েছে। কেন উনাকে ধাক্কা দিলাম? তরকারি উনার উপর পড়লে ভালো হতো। মাখামাখি অবস্থা হতো। শীতের মধ্যে গোসল করে থরথর করে কাঁপত। ব্যাটা আস্ত শয়তান একটা।”
ফায়াজ আলতো হেসে বলল,
“মনে মনে গালাগাল দিচ্ছো?”
মেহের দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,
“না!”
ফায়াজ সোফার উপরে রাখা কোর্ট নিয়ে মেহেরের গায়ে দিয়ে বলল,
“চা – কফি কিছু খাও। শরীর গরম হবে।”
মেহের কোর্টটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আপনি চা-কফি কিছু খাবেন?”
ফায়াজ বিছানায় বসতে বসতে বলল,
“হলে মন্দ হয় না। তবে তুমি নিজে বানিও না।”
তারপর ফায়াজ আবারও মিটমিট করে হাসছে।
মেহের নাক ফুলিয়ে ফায়াজের দিকে তাকাল। সেদিন ভালো কফি বানায় নি তাই আজ মজা করছে৷
মেহের উপর থেকেই “মা” “মা” বলে চিতকার করছে। কিন্তু মায়ের সাড়াশব্দ নেই। মাহি মেহেরের কন্ঠ শুনে রুম থেকে বের হয়ে মেহেরকে দেখল। গায়ে কোর্ট জড়ানো। মেহেরের কাছে হন্তদন্ত হয়ে যেতেই দেখতে পেল মেহের কাঁপছে।
মাহি মেহেরের ডান বাহুতে হাত দিয়ে বলল,
“এই মেহু পাখি তুই কাঁপছিস কেন? ফায়াজ কিছু করেছে?”
মেহের ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি আর কথা বলো না। তোমার জন্য এই ঠান্ডার মধ্যে গোসল করতে হলো। এখন আমি ঠকঠক করে কাঁপছি।”
মাহি ফিসফিস করে বলল,
“তোকে কে বলেছিল আগ বাড়িয়ে তরকারির সামনে যেতে? আমি তো ফায়াজের উপর ফেলতে চেয়েছিলাম।”
মেহের কটাক্ষ করে বলল,
“তুমি ফায়াজের উপর তরকারি কেন ফেলবে? কেন এটা করতে যাচ্ছিলে? তোমার থেকে এটা আশা করি নি।”
মাহি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“বাহ! আমার বোন বরের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে। যাক তাহলে সুবুদ্ধি হয়েছে। বরের প্রতি টান বাড়ছে।”
মেহের ওর কথা শুনে চুপ করে গেল। আসলেই তো ফায়াজের জন্য ওর মাহি আপুর সঙ্গে রাগ করছে? এটা কি করে সম্ভব? ফায়াজের প্রতি কি টান বাড়ছে?
মেহেরকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,
“মাকে ডাকছিলি কেন?”
“ঠান্ডা লাগছে। একটু চা খাবো তাই।”
“চা খেতে হবে না। আমি তোর জন্য গরম দুধ পাঠাচ্ছি। বেশি চা খাওয়া ভালো না।”
মাহি নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মেহের দ্রুত বলল,
“আর ফায়াজের জন্য কফি।”
মাহি পেছনে ঘুরে মেহেরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
ফায়াজ দরজার সামনে থেকে সরে গেল। ফায়াজ মেহেরের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা কেউই জানে না। ফায়াজ সবটা শুনে বুঝতে পারল মাহি ইচ্ছে করে এ-সব করেছে। মেহের ফায়াজকে সরিয়ে দিয়েছে আর সবচেয়ে অবাক করার বিষয় মেহের ফায়াজকে সাপোর্ট করছে।
ফায়াজ শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে আর মেহের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে। সার্ভেন্টকে দিয়ে গরম দুধ আর কফি পাঠানো হয়েছে। ফায়াজ শোয়া থেকে উঠে কফি নিয়ে আধশোয়া হয়ে চুমুক দিল। মেহের কোর্ট ভালো ভাবে গায়ে জড়াতে জড়াতে কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাস তুলে নিতেই ঠাস করে পড়ে গেল। মেহের হা করে তাকিয়ে আছে ফ্লোরে।
ফায়াজ গ্লাস ভাঙার শব্দে বিছানার কিনারে এসে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হায় আল্লাহ!”
মেহেরের রাগ হচ্ছে প্রচুর। গ্লাসটা পড়ে গেল। গ্লাস ভেঙে তিন টুকরো হয়ে গেছে। ভাগ্যিস লাফিয়ে সরে পড়েছিল নয়তো গরম দুধ ওর পায়ের উপর পড়ত।
মেহের ভাঙা কাচের টুকরোতে হাত দিতে গেলে ফায়াজ খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে।
“এই মেয়ে পাগল হয়েছ? কাচে হাত দিচ্ছো কেন? হাত কেটে গেলে? আশ্চর্য।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে ওর দিকে তাকাল। ফায়াজের চোখেমুখে ভয় ও আতংক। মেহের অবাক হচ্ছে ওকে বিচলিত হতে দেখে। ফায়াজ কেন ওর জন্য বিচলিত হবে? কেন ভয় পাবে? আতংকিত হবে?
মেহের হাত মুঠ করে বলল,
“না মানে, বিছানা থেকে নামতে গেলে পায়ে লেগে কেটে যেতে পারে। তাই সরাচ্ছিলাম।”
ফায়াজ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“তোমাকে সরাতে হবে না। সার্ভেন্ট দেখবে।”
মেহের বলল,
“ঠিক আছে। আমি ডেকে আনছি।”
মেহের পা বাড়াতেই ফায়াজ ওর হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল।
“এখন আর কোথাও যেতে হবে না। এভাবে থাকুক। সকালে দেখা যাবে। তুমি এখন কফিটা খাও।”
মেহের ফায়াজের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,
“আপনার মুখেরটা আমি কেন খাব?”
ফায়াজ মুচকি হেসে বলল,
“হাসব্যান্ডের মুখেরটা খেলে কিছু হয় না। তাছাড়া এর আগেও তুমি খেয়েছ।”
মেহের চোখ বড়বড় করে বলল,
“কবে?”
ফায়াজ দুষ্টু হেসে বলল,
“যেদিন তুমি জঘন্য কফি বানিয়েছিলে সেদিন।”
মেহের আবারও নাক ফুলিয়ে ফায়াজের হাত থেকে কফি নিয়ে খাচ্ছে। মেহের মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল ভালো কফি বানানো শিখে ফায়াজকে শিক্ষা দিবে।
মেহের শুয়ে শুয়েও কাঁপছে। কেন জানি কাপুনি থামছে না। ফায়াজ মেহেরের গায়ে জড়ানো চাদরের ভেতরে ঢুকে মেহেরের কোমড় ধরে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরল। আচমকা ফায়াজের এমন কর্মকাণ্ডে মেহের হতবাক। কাপুনি আরো বেড়ে চলেছে। শরীরের কাপুনির সাথে শরীরের কাপুনি যুক্ত হয়েছে। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।
ফায়াজ মেহেরের কাপুনি অনুভব করতে পেরে বলল,
“আমি তোমার কাপুনি কমানোর জন্য জড়িয়ে ধরলাম আর তোমার কাপুনি দেখছি তিনগুণ হয়ে গেল। মাই গড।”
ধীরে ধীরে মেহেরের কাপুনি কমে আসছে। ফায়াজকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। ফায়াজের সাথে মিশে থাকতে সুখানুভব হচ্ছে৷ ভালো লাগছে। মেহের স্নিগ্ধ হাসল। তারপর চোখ বন্ধ করে নিল।
মেহেরের উষ্ণ নিশ্বাসের ছোয়ায় ফায়াজের ঘুম ভাঙলো। মেহের ওর সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে। ফায়াজের কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। যা কখনো হয় নি। ফায়াজ মেহেরের গালে হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে আলতো করে ছুয়ে দিচ্ছে। মেহের নড়ে-চড়ে উঠে। ফায়াজ হাত সরিয়ে দেয়। মেহেরকে ধীরে ধীরে সরিয়ে ফায়াজ উঠে যায়। মেহেরের কথা ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে নামতেই “আহহ” করে উঠে। পায়ে কাচের টুকরো বিঁধে গেছে। শব্দ পেয়ে মেহেরের ঘুম ভেঙে গেল। মেহের আধো আধো করে চোখ মেলে। আড়মোড়া ভেঙে ফায়াজকে দেখে বসে আছে। কি হয়েছে বুঝার জন্য উঠে ফায়াজের কাছে গিয়ে দেখে ফায়াজ পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে আছে৷ সেখান থেকে গাঢ়, ঘন লাল রক্ত বের হচ্ছে।
মেহের ফায়াজের পায়ের আঙুল চেপে ধরে বলল,
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ১৫
“আমি বলেছিলাম রাতেই কাচগুলো পরিস্কার করে ফেলি। আপনি তো জানতেন এখানে কাচের টুকরো আছে। আপনার মন থাকে কই? কতখানি কেটে গেছে। কত রক্ত বের হচ্ছে।”
ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সামান্যই। আমার অভ্যাস আছে।”
মেহের ফায়াজের হাত পায়ের আঙুলের কাছে দিয়ে বলল,
“চেপে ধরুন। আমি মেডিসিন, ব্যান্ডেজ নিয়ে আসছি।”
“এত বিচলিত হচ্ছো কেন আমার জন্য? আমাকে তো তুমি মানুষই মনে করো না। আমার যে যন্ত্রণা হতে পারে সেটা তো তুমি বিশ্বাস করো না।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে থেমে গেল৷ ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ব্যথাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে।