শেষ পাতায় তুমি পর্ব ১৭
ফাবিহা নওশীন
মেহের ফায়াজের কথার উত্তর না দিয়ে ড্রয়ার খুলে ফার্স্ট এইড বক্স বের করল। ফায়াজ তখনও ওর দিকে চেয়ে আছে। মেহের ফায়াজের পাশে বসে বক্স খুলতে খুলতে বলল,
“আপনার এটা মনে হচ্ছে কেন?”
ফায়াজ ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমার আচরণ তাই বলে। আমার প্রতি তোমার মনোভাব সেটাই। আমি মানুষ নই। আমার কষ্ট হয় না।”
মেহের হাতে তুলা নিয়ে বলল,
“আপনার ধারণা ভুল। আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের একি রকম কষ্ট হয়। তবে কারো সহন শক্তি বেশি, কারো কম। কেউ প্রকাশ করতে পারে আবার কেউ পারে না। তবে কষ্ট সবারই হয়। আপনার মতো পাথর দিলেরও হয়।”
ফায়াজের আঙুলে ওষুধ লাগানো শেষ। মেহের ব্যান্ডেজ পেচিয়ে বলল,
“আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি। কিছু প্রয়োজন হলে বলবেন। আমি ফ্রেশ হয়ে কাচ পরিস্কার করার ব্যবস্থা করছি।”
মেহের ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। ফায়াজ উঠে ধীরে ধীরে ফ্রেশ হতে গেল।
“আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশীনি”
ফায়াজ সুর অনুসরণ করে একটা রুমে গেল। মেহের পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচছে৷ সাথে ঠোঁট মেলাচ্ছে। ফায়াজ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। মেহেরের গান শুনেছে কিন্তু এই প্রথম নাচ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। মেহের দেখার আগেই ফায়াজ সরে যায়।
সবাই নাস্তা করতে বসেছে। মেহের একটা প্লেটে খাবার তুলে নিচ্ছে। গ্লাসে জুশ ঢালছে। কফিটাও দেখে নিয়ে কাপে ঢালছে।
মেহেরের মা জিজ্ঞেস করল,
“কি করছিস? জামাই কই?”
মেহের ট্রেতে খাবার তুলে বলল,
“উনার পা কেটে গেছে। তাই উপরে নাস্তা নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহেরের কথা শুনে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। মেহেরের মা রাগী কন্ঠে বলল,
“মেহের, তোর বোধবুদ্ধি কবে হবে? জামাইয়ের পা কেটে গেছে আর তুই কাউকে বলিস নি?”
মেহের বুঝতে পারছে না এখানে বলাবলির কি আছে। বোকার মতো চেয়ে আছে মায়ের দিকে।
মেহেরের মা টেবিল ছেড়ে উপরে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য মেহেরের রুমে গিয়ে ফায়াজকে দেখা। তূর্জও যাচ্ছে। মাহি থমকে দাঁড়িয়ে আছে ভাবছে যাবে কি না। মেহের ট্রে নিয়ে ধীরে ধীরে নিজের রুমে যাচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
ফায়াজ বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় আছে। মেহেরের মা ভিতরে ঢুকতেই ফায়াজ ঠিক করে বসে।
“দেখেছো আমার মেয়ের কান্ড। তোমার পা কেটেছে আগে বলবে না। দেখি দেখি।” ( ফায়াজের পায়ে হাত দিয়ে)
ফায়াজ পা সরিয়ে নিয়ে বলল,
“আন্টি ঠিক আছি।”
মেহেরের মা বুঝতে পারল ফায়াজ কেন এমন করছে। তাই মুচকি হেসে বলল,
“আমি তোমার মায়ের মতো। মা ছেলের পা ধরলে ছোট হয়ে যায় না। তুমি ইতস্তত বোধ করো না।”
মেহেরের মায়ের কথা শুনে নিজের মায়ের প্রতি ঘৃণাটা এক ধাপ বেড়ে গেল। ওর মা নিজের খুশির জন্য ফায়াজকে ছেড়েছে। আর মেহেরের মা ওর কত খেয়াল রাখছে।
মেহেরের মা যেতেই তূর্জ ফায়াজের পিঠ চাপকে বলল,
“তুমি নাকি শালিকার প্রেমে হুচট খেয়ে পড়েছ?”
ফায়াজ জোরপূর্বক হাসল। মেহের কি বুঝল কি জানি। বোকার মতো বলল,
“না ভাইয়া, উনি হুচট খায় নি। ভাঙা কাচের গ্লাসের টুকরোতে পা কেটে গেছে।”
তূর্জ মেহেরের কথা শুনে হতাশ। হতাশা নিয়ে বলল,
“কার সাথে মজা করতে চাইছি? যে মজার ‘ম’ ও বুঝল না?”
মেহের তূর্জের কথা না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।
ফায়াজ নাস্তা সেড়ে নিয়েছে। মেহেরকে দেখে বলল,
“রেডি হয়ে নেও। আমাদের যেতে হবে।”
যাওয়ার কথা শুনে মেহের প্রচন্ড খুশি হলো। মেহের যত দ্রুত সম্ভব ফায়াজের বাড়িতে ফিরতে চায়। ব্যাপারটা অন্য রকম হলে মেহের কান্নাকাটি জুড়ে দিতো না যাওয়ার জন্য। এখানে আর কিছুদিন থাকবে বলে বায়না করত কিন্তু আজ যাওয়ার কথা শুনে হ্যাপি। যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় ততই চিন্তামুক্ত।
তূর্জের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে কিছু পিক এসেছে। তূর্জ সেই ছবিগুলো দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। অতঃপর তূর্জ অপলক চেয়ে আছে সেই পিকগুলোর দিকে। মাহি আর ফায়াজের এক সাথে হাসোজ্জল কিছু ছবি।।
মাহি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্জ শান্ত দৃষ্টিতে মাহির দিকে চেয়ে আছে। মাহির সম্পূর্ণ দৃষ্টি ফোনের স্কিনে। এই কাজ ফায়াজ ছাড়া অন্য কেউ করেনি, করতে পারে না ১০০% শিওর।
মাহি তূর্জের দিকে অসহায় ফেস করে তাকাল। তূর্জের দৃষ্টি শান্ত। যেখানে যেন কোনো রাগ নেই। আছে কিছু অভিমান আর অভিযোগ।
মাহি তূর্জকে বুঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
“তূর্জ এ-সব কেউ ইচ্ছে করে করছে। দেখতেই পাচ্ছো পিকগুলো ভার্সিটি এরিয়ার। কেউ আমাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির চেষ্টা করছে। বিশ্বাস করো আমাকে।”
তূর্জ হালকা হেসে বলল,
“আই ট্রাস্ট ইউ। আমার এখন অফিসে যেতে হবে। আমি বেরুচ্ছি।”
তূর্জ মাহির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মাহি তখনও ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। তূর্জ ব্যাপারটা নরমাল ভাবে নিতে পারে নি সেটা বুঝতে খুব একটা সমস্যা হয় নি মাহির।
মাহি কি করবে বুঝতে পারছে না। দ্রুত মেহেরকে ফোন করল।
ফায়াজ সকাল বেলায় বেড়িয়েছে। মেহের বাড়িতেই আছে। গার্ডেনে বসে ছিল। তখনই মাহির ফোন। মেহের সবটা শুনে ফোন কেটে গার্ডেনেই বসে আছে।
ফায়াজ বাড়ি ফিরেছে। দূর থেকে মেহের শুধু ফায়াজকে দেখছে। ফায়াজ ফ্রেশ হয়ে বের হতেই মেহের ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
ফায়াজ মেহেরকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে তাচ্ছিল্য করে বলল,
“খবর এসে পড়েছে তাহলে?”
মেহের চোখ বন্ধ করে আবারো চোখ খুলে বলল,
“আপনি এ-সব কেন করছেন? কি পাচ্ছেন এ-সব করে? কিছু কি পাওয়ার উপায় আছে?”
ফায়াজ মেহেরের দিকে চেয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
“কিছু তো অবশ্যই পাচ্ছি। ছোট মানুষ ও তুমি বুঝবে না।”
মেহের ফায়াজের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল। কিন্তু তা ফায়াজের চোখে পড়ল না। ফায়াজ তো ফোন নিয়ে ব্যস্ত। মেহেরকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
“আমি এতটাও অবুঝ নই যে বুঝব না। আর আপনি কি পাচ্ছেন সেটাও বুঝতে পারছি। রিভেঞ্জ নিচ্ছেন তো? আপুর সংসারে অশান্তি করতে চাইছেন। তাকে জাস্ট শান্তিতে থাকতে দিবেন না। এটাই তো?”
ফায়াজ ফোন রেখে মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“হ্যা ঠিক তাই।”
মেহের ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বলল,
“কিসের রিভেঞ্জ? আপনি আপুকে ভালোবাসতেন আর আপু আপনাকে ঠকিয়েছে তাই? না আপনার ইগো হার্ট হয়েছে তাই? আপনি আপুকে ভালোবাসেন না। প্রকৃতপক্ষে কখনো ভালোবাসেন নি। যদি ভালো বাসতেন তাহলে এই রিভেঞ্জ নেওয়ার কথা মাথায় আসত না। আপনার সমস্যাটা হচ্ছে আপনি ভাবছেন আমি ফায়াজ, সবাই আমাকে ভয় পায়। সবাইকে আমি হার্ট করি, কষ্ট দেই। পায়ের তলায় রাখি। কেউ চোখ তুলে কথা বলার সাহস পায় না। সেখানে একটা মেয়ে বাজি ধরে প্রেমের অভিনয় করে জিতে চলে গেল আপনাকে হারিয়ে। আপনি এটা জাস্ট মেনে নিতে পারেন নি। তাই এই নোংরা খেলা খেলছেন। আপুকে পাওয়ার আকাঙ্খা আপনার কখনই ছিল না। আপনার শুধু রিভেঞ্জ চাই। তাই আপনি আমাকে বেছে নিলেন। আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন। আপনি বলেছেন আমি যদি আপনাকে বিয়ে করি তবে আপনি আপুর সঙ্গে কিছু করবেন না। কিন্তু আপনি তাই করে যাচ্ছেন। আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন আপুর পাশাপাশি থাকার জন্য। যাতে করে আপুর ক্ষতি করতে ও আপুর জীবনে অশান্তি করতে আপনার সুবিধা হয়।”
মেহের কথাগুলো বলে থেমে গেল। গলা ভারী হয়ে আসছে। ফায়াজ জানে মেহেরের বলা কথাগুলো শতভাগ সত্য।
ফায়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি এ নিয়ে কথা বলতে চাই না।”
মেহের ধরা গলায় বলল,
“কেন চাইবেন না? এইসবের মধ্যে আমি কোথায়? আমার জীবনটা কেন নষ্ট হলো? আমি কিসের জন্য এতবড় সেক্রিফাইজ করলাম? এ-সব বন্ধ করুন। আপনি আপুকে ভালোবাসেন না আপুও বাসে না। আপনি আপনার মতো থাকুন৷ আর আপুকে আপুর মতো বাচতে দিন। হ্যা আপু একটা অন্যায় করেছে। তার জন্য আমি প্রায়শ্চিত্ত করছি। আর কি চাই আপনার? আর বললেন না আমি ছোট। হ্যা আমি ছোট। তবে একদম অবুঝ নই। আপনি আপুকে ভালোবাসলে আপুর বিয়ে নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পারতেন না। এত হাসিখুশি থাকতে পারতেন না। রাতে নিশ্চিন্তে বেঘোরে ঘুমাতে পারতেন না। ছটফট করতেন, অস্থিরতায় ভুগতেন, কষ্ট পেতেন, যন্ত্রণায় নির্ঘুম রাত কাটাতেন। কিন্তু আপনি তো পুরো ঠিক ছিলেন। একদম ঠিক। আমার অভিজ্ঞতা না থাকলেও এতটুকু তো বুঝতে পারি।”
ফায়াজ চোয়াল শক্ত করে ধমকে বলল,
“শাট আপ। আর একটা কথা বলবে না।”
মেহের শান্ত কন্ঠে বলল,
“ঠিক আছে বলব না। কিন্তু আমি না বলাতে কি সত্যিটা বদলে যাবে? যাবে না। কারণ সত্যিটা আপনি আরো ভালো জানেন। আপনি আপুকে ভালোবাসেন না। যা করছেন আপনার ইগোর জন্য করছেন। স্বীকার করুন।”
ফায়াজের আর সহ্য হচ্ছে না। অনেক সময় সত্য শরীরে কাটার মতো বিঁধে। সামনের মানুষের বলা কথাগুলো তেঁতো লাগে। ফায়াজেরও তেমন লাগছে।
ফায়াজ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলল,
“আমার মাথা খেও না। আমাকে রাগিও না। এখান থেকে যাও।”
মেহের ফায়াজের কথার উত্তর দিল,
“স্বীকার করুন আর না করুন। তবে আমি আমার সেক্রিফাইজ বিফলে যেতে দেব না।”
ফায়াজ মেহেরের হাত শক্ত করে ধরে টানতে টানতে বাইরে বের করে দিয়ে মেহেরের মুখের উপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল।
ফায়াজ একা একা বিরবির করছে,
“মাথা খেয়ে ফেলছে একদম। বিরক্তিকর।”
মেহের দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তূর্জকে ফোন করল।
দু-বারের মাথায় তূর্জ ফোন রিসিভ করল। মেহের করুন সুরে বলল,
“আপু আমাকে ফোন করেছিল। আপনার মতো আমার ফোনেও কেউ আপু আর ফায়াজের কিছু পিক পাঠিয়েছে।”
তূর্জ অবাক হয়ে বলল,
“তোমাকেও পাঠিয়েছে কিন্তু কে পাঠিয়েছে?”
মেহের অসহায় মুখ করে বলল,
“জানি না ভাইয়া। প্রথমে আমার ভিষণ রাগ হয়েছিল। কিন্তু আপু যখন ফোন করে জানাল তখন অন্য কিছু মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন আমাদের দু বোনের ভালো চায় না।”
তূর্জ নিজেও চিন্তায় পড়ে গেল। তূর্জেরও তাই মনে হচ্ছে। নয়তো মেহেরকে কেন কেউ পিক সেন্ড করবে। কে হতে পারে।
তূর্জ বলল,
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ১৬
“মেহের কে হতে পারে? কে এমন করছে?”
মেহের না জানার ভান করে বলল,
“জানি না। আপু খুব কান্নাকাটি করল। আপনি নাকি আপুকে বিশ্বাস করেন নি। আর আমিও ফায়াজের সাথে অযথা রাগারাগি করেছি।”
তূর্জের নিজেরও খারাপ লাগছে।
“মেহের ফায়াজের সাথে রাগারাগি করো না। আর আমি মাহির সাথে কথা বলে নেব।”
“আচ্ছা রাখছি।” মেহের ফোন কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফায়াজ আর মাহির জন্য ওকে মিথ্যা কথা বলতে হলো। কিন্তু এই মিথ্যা দিয়ে কতদিন সম্পর্কেগুলো জোড়া লাগাতে পারবে তা ওর অজানা। ফায়াজ কবে সবটা বুঝবে সেটাও অজানা।