শেষ পাতায় তুমি পর্ব ১৮
ফাবিহা নওশীন
হাতে তালি দেওয়ার শব্দে মেহের পেছনে ঘুরে ঘাবড়ে যায়। ফায়াজ ঠোঁটের কোনে অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে হাতে তালি দিচ্ছে।
“বাহ! তোমাকে তো আমি অবুঝ, ইনোসেন্ট একটা মেয়ে ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমিও যে এত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারো, গল্প বানাতে পারো সেটা তো জানতাম না। ইম্প্রেসিভ ব্যাপার স্যাপার। আমি কেন বারবার ভুলে যাই? কেন ভুলে যাই? তুমি মাহির বোন। মাহির বোন কি করে এতটা সরল হতে পারে? তুমি নেকা আর ড্রামাবাজ মেয়ে। এমন ভান করে থাকো যে কিছুই বুঝো না। কিন্তু তুমি সব বুঝো, সব।”
মেহের মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। ভয় লাগছে খুব। ফায়াজ যে চলে আসবে বুঝতে পারে নি। মেহেরের পেছনে আঠার মতো লেগে থাকে। কিছু করতে গেলেই ধরা খায়।
মেহের দু’হাতে জামা খামছে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
ফায়াজ আবারো বলল,
“কি বলেছিলে তুমি? ওহ হ্যা, মনে পড়েছে। তুমি তোমার আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দিবে না। তুমি মাহির অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করছো। ওকে তাহলে তাই হোক। তুমিই প্রায়শ্চিত্ত করো।”
ফায়াজ খপ করে মেহেরের হাত ধরতেই মেহের ভয়ে আঁতকে উঠল। সারা শরীরে কাপুনি অনুভব করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে টানতে টানতে কিচেনে নিয়ে গেল। কিচেনে কেউ সবজি কাটছে, কেউ পেয়াজ কাটছে, কেউ বিফ কাটছে, কেউ মিক্সার করছে।
ফায়াজ যেতেই সবাই কাজ রেখে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ চুটকি বাজিয়ে বলল,
“আউট। আজ মেহের রান্না করবে। সব কাজ মেহের করবে। কাউকে যেন কিচেনের আশেপাশে না দেখি। নাও আউট।”
সবাই জি স্যার বলে দ্রুত বেড়িয়ে গেল।
মেহের হা করে ফায়াজের দিকে চেয়ে আছে।
আমতা আমতা করে বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
“কি বলছেন? আমি কি করে রান্না করব? আমি তো কোনো কাজ পারি না। আমি কি করে…?”
ফায়াজ ধমক দিয়ে বলল,
“যা বলেছি তাই করো। নয়তো খারাপ হয়ে যাবে।”
মেহের আবার কিছু বলতে যাবে তখনই ফায়াজ বের হয়ে গেল।
মেহের ফায়াজের এমন বিহেভিয়ার দেখে কাদঁতে ইচ্ছে করছে। কি করে রান্না করবে,কোনো দিন তো রান্না করে নি। অর্ধকাটা পেয়াজ,সবজি,বিফ দেখে কান্না এসে পড়েছে অলরেডি।
ফায়াজ কিচেনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। মেহেরের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। পেয়াজ কাটছে। পেয়াজের কি ধক। পেয়াজ কাটছে কিন্তু কুচি হচ্ছে না ঠিক করে। এবড়োথেবড়ো হয়ে আছে।মেহেরের বিরক্ত লাগছে। এত চেষ্টা করার পরেও ঠিক করে কেন কাটতে পারছে না। ফায়াজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আর হাসছে।
মেহের ইউটিউব দেখে রান্না করছে কিন্তু খাওয়ার যোগ্য হচ্ছে কি না জানা নেই। দীর্ঘ ৪ ঘন্টা পরে মেহের কিচেন থেকে বের হলো। কি রান্না করেছে জানা নেই।
ক্লান্ত শরীরে রুমে গিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। পুরো রুম এলোমেলো। মনে হচ্ছে ঝড়-তুফান বয়ে গেছে ঘরের উপর। মেহের মেঝেতে বসে পড়ল। ফায়াজ ইচ্ছে করে খাটানোর জন্য করেছে বুঝতে বাকি নেই। মেহের কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে উঠে ঘর গোছালো।
ফায়াজ জানে মেহেরের রান্না খাওয়ার যোগ্য হবে না। তাই নিজে বাইরে থেকে খেয়ে নিয়েছে। মেহের নিজের রান্না করা খাবার মুখে তুলতে পারছে না। তাই না খেয়েই উঠে গেল। সারাদিন না খেয়ে থাকার পর রাতে ডিমের অমলেট বানিয়ে খেয়ে নিল। মেহেরের ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে বাড়িতে চলে যেতে। ফায়াজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সারাদিন একটু খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না।
মাহি বই খোলে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। পেছনে থেকে তূর্জ ওর ঘাড়ে ঠোঁট ছুয়ালো। মাহি আচমকা যেন ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত পেছনে ঘুরে তূর্জকে দেখে বলল,
“তুমি? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
তূর্জ মাহির গাল টেনে বলল,
“আমি ছাড়া আমার বউয়ের আশেপাশে আসার সাহস কারো আছে?”
মাহি শুকনো হাসল। তূর্জ মাহির কাঁধে হাত রেখে বলল,
“সরি। আমার ওভাবে চলে যাওয়া ঠিক হয় নি। আসলে ওর সাথে তোমার ছবি দেখে খারাপ লেগেছিল। কিন্তু মেহেরের সাথে কথা বলার পর সব ঠিক লাগছে।”
মেহেরের সাথে কথা হয়েছে শুনে মাহি ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মেহের কি বলেছে?”
তূর্জ মেহেরের বলা সব কথা বলল। সবটা শুনে মাহি মুচকি হাসল।
“বোনটা আমার বড় হয়ে গেছে।”
ফাইজা ভার্সিটি থেকে বাড়িতে ফিরেছে। ওর মা ওর রুমে মন খারাপ করে বসে আছে।
ফাইজা ব্যাগ রেখে মায়ের পাশে গিয়ে বসে বলল,
“মম, কি হয়েছে? এভাবে মন খারাপ করে বসে আছো কেন?”
“ফায়াজের কথা মনে পড়ছে। ওকে কতদিন দেখি না। আর ওর বউয়ের সাথেও তো কথা হলো না। ফায়াজের সাথে কথা হলে বলিস আমি মেহেরের সাথে কথা বলতে চাই।”
“আচ্ছা বলব। তুমি মন খারাপ করো না। ভাইয়ার রাগ একদিন কমে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ে করেছে এখন আস্তে আস্তে পালটে যাবে। চিন্তা করো না।”
ওর মা ওর দিকে তাকিয়ে আলতো হাসল।
ফায়াজ ভার্সিটিতে যাবে কিন্তু ওর পছন্দের পারফিউম খুঁজে পাচ্ছে না। সব জায়গায় খোঁজেও পেল না। তারপর চিতকার করে মেহেরকে ডাকল।
মেহের ফায়াজের চিতকার চেচামেচি শুনে নিচ থেকে দৌড়ে এল। ফায়াজের সামনে এসে হাপাতে লাগত। ফায়াজ ফ্লোরে এটা সেটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে।
মেহেরকে দেখতেই চোয়াল শক্ত করে বলল,
“তুমি আমার জিনিসে হাত দিয়েছো কেন? আমার পারফিউম কই?”
গতকাল যখন ফায়াজ সব এলোমেলো করে রেখেছিল তখন মেহের সব গুছিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কোথায় রেখেছিল মনে করতে পারছে না। নিজের চুল নিজেরই ছিড়তে ইচ্ছে করছে।
ফায়াজ মেহেরকে চুপ থাকতে দেখে ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ করে আছো কেন?”
মেহের কেঁপে উঠল। তারপর মনে করার ভঙ্গিতে বলল,
“আমি আসলে মনে করতে পারছি না।”
ফায়াজ মেহেরের হাত মুচড়ে ধরে বলল,
“তোমাকে আমার জিনিসপত্র ধরতে কে বলেছে? আমি নিষেধ করি নি? তোমার জন্য আমার দেরি হয়ে গেল।”
মেহের ব্যথায় কুকড়ে উঠছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
“হাতে ব্যথা পাচ্ছি। হাত ছাড়ুন প্লিজ।”
ফায়াজ আরো জোরে চেপে ধরল। মেহের ফায়াজের হাত থেকে নিজের হাত সরানোর চেষ্টা করছে। কান্নার গতি বেড়ে গেল। ফায়াজ ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“নিচে চটপট আসো। আমি নাস্তা করব।”
মেহের নিজের হাত ডলছে আর কাঁদছে। ফায়াজ অমানুষের মতো আচরণ করছে। আগে তো এমন করে নি। করলেও কিছুটা রহম করেছে।
মেহের ফায়াজের চায়ের কাপে চা ঢালছে। কিন্তু ডান হাতে কাপ তুলতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে কাপ তুললেও ফায়াজের উপর কাপ পড়ে গেল। ফায়াজ দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে জামা ঝাড়ছে।
মেহের আরো ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে ঢোক গিলছে।
ফায়াজ রেগে গিয়ে বলল,
“আর ইউ ব্লাইন্ড? কি করলে এটা?”
মেহের প্রতি উত্তরে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিল।
মেহের ডান হাত ধরে কেঁদেই যাচ্ছে আর কি যেন বলছে। কান্নার জন্য ফায়াজ কিছুই বুঝতে পারছে না মেহেরের কথা।
ফায়াজ ধমক দিয়ে বলল,
“ভ্যা ভ্যা বন্ধ করো। তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।”
মেহের কান্না কিছুটা থামিয়ে বলল,
“আমি ইচ্ছে করে ফেলি নি। আমার হাতে ব্যথা। তাই কাপ ধরে উঠাতে পারছিলাম না।”
ফায়াজ ভ্রু কুচকে বলল,
“তোমার হাতে আবার কি হলো? কাপ তুলতে পারবে না কেন?”
মেহের অভিমানী কন্ঠে বলল,
“আপনি আমার হাত ভেঙে ফেলেছেন। আমি হাত নাড়াতে পারছি না।”
তারপর ফায়াজের মনে পড়ল ওর হাত মুচড়ে ধরেছিল কিছুক্ষণ আগে। তাতেই হয়তো ব্যথা পেয়েছে।
ফায়াজ মেহেরের হাতের দিকে হাত বাড়াতেই মেহের চিতকার করে হাত সরিয়ে বলল,
“আমার হাতে আর কিছু করবেন না প্লিজ। অনেক ব্যথা করছে।”
ফায়াজ মেহেরকে বলল,
“আমি কিছু করব না। শুধু দেখব ট্রাস্ট মি।”
মেহের তবুও ভয়ে ভয়ে হাত বাড়িয়ে দিল ফায়াজের দিকে। ফায়াজ মেহেরের হাত ধরতেই মেহের চিতকার করল। ফায়াজ সার্ভেন্টকে পেইন কিলার স্পে
আনতে পাঠাল।
ফায়াজ মেহেরকে সোফায় নিয়ে বসাল। মেহের যেন হটাৎ আহ্লাদী হয়ে উঠল।
ফায়াজ আস্তে আস্তে অতি সাবধানে মেহেরের হাত ধরে স্পে করে দিল। কিন্তু মেহেরের ব্যথা কমছে না৷
ফায়াজ গিলটি ফিল করছে। বুঝতে পারে নি এতটা ব্যথা পাবে।
“মেহের কান্না থামাও।”
মেহের ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার হাত হয়তো ভেঙে গেছে।”
ফায়াজেরও কেমন লাগছে৷ যদি তাই হয় তাহলে?
ফায়াজ মেহেরকে আস্বস্ত করে বলল,
“কিছু হয়নি। রেডি হয়ে নেও। আমরা হসপিটালে যাব।”
ফায়াজের কথা শুনে মেহেরের মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই হাত ভেঙে গেছে।
মেহের রেডি হয়ে এলো। এক মহিলা সার্ভেন্টের সাহায্য নিয়ে হিজাব পড়ে নিল।
বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মেডিসিন নিয়ে মেহের আর ফায়াজ ফিরছে। বিকেলে রিপোর্ট আসবে। এখনকার মতো কিছু মেডিসিন দিয়েছে। মেহের আগে আগে হাটছে। আর ফায়াজ পেছনে মেডিসিনগুলো দেখছে।
হটাৎ ফায়াজের চোখ গেল সামনে। মেহের গাড়ির কাছে যাচ্ছে। আর পার্ক করা একটা গাড়িতে হেলান দিয়ে একটা ছেলে শিষ বাজাচ্ছে মেহেরের দিকে চেয়ে। মেহের কিছুই খেয়াল করে নি। বেচারি তো হাতের চিন্তায় পাগল। শিষ বাজানো দেখে ফায়াজের মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। ফায়াজ মেহেরের কাছে গিয়ে ওষুধ ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটার কলার চেপে ধরে বলল,
“বিবাহিত মেয়েদেরও ছাড় দিস না? ওর পোশাক যথেষ্ট মার্জিত। হিজাব পরা। তবুও? তোর মতো কিছু ছেলের জন্য সব ছেলের বদনাম হয়।”
ওই ছেলেটা কটাক্ষ করে বলল,
“কে রে তুই? আমার কলার ছাড়।”
ফায়াজ কলার আরো চেপে ধরে বলল,
“ফায়াজ নওয়াজ খান। লিখে রাখিস।”
বলেই ছেলেটাকে মারতে লাগল। মেহেরের হাত-পা কাপছে। ফায়াজের সামনে গিয়ে ছাড়ানোর সাহসও নেই। কেউ আসছেও না ছাড়াতে।
ফায়াজ মারামারির এক পর্যায়ে ছেলেটাকে গাড়ির উপর ধাক্কা মারল। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। মাথাও ফেটে গেছে।
ফায়াজ ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ১৭
“আমার সাথে গুন্ডামী করতে আসিস না। আমি তোর এক ধাপ উপরে। আর কোনো দিন কোনো মেয়েকে দেখে শিষ বাজানোর আগে দশবার ভাববি। যা হসপিটাল থেকে ট্রিটমেন্ট করে নিস।”
(ওর হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে)
মেহের পুরো রাস্তা চুপ করে ছিল। বাড়িতে গিয়েও ভয়ে কথা বলে নি। বিকেল দিকে ফায়াজ রিপোর্ট আনতে যাবে তখনই মেহের কাঁদতে কাঁদতে ফায়াজের সামনে দৌড়ে এল। ফায়াজ মেহেরের কান্নার কারণ উদঘাটন করতে পারছে না।
“এই আবার ভ্যা ভ্যা শুরু করলে? আবার কি হলো? আমি তো তোমাকে কিছু বলি নি তাহলে কাঁদছ কেন?”
মেহেরের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“পুলিশ এসেছে। আপনাকে খুজছে। বলছে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে আপনার নামে।”
মেহের আবার কাঁদতে লাগল।
ফায়াজ হটাৎ চোখ মুখ শক্ত করে নিল।