শেষ পাতায় তুমি পর্ব - Golpo bazar

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২০ || romantic story

শেষ পাতায় তুমি

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২০
ফাবিহা নওশীন

মেহের কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে। কিন্তু নিজেকে হালকা অনুভব করছে না। মেহের চোখ ভালো করে খুলে নড়তে গিয়ে নিজেকে ফায়াজের বাঁধনে আবদ্ধ হিসেবে দেখতে পায়। ফায়াজ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। মেহের নিজেকে ফায়াজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়। হাত-মুখ ধুয়ে নিচে যায়। সিড়ি দিয়ে নামতেই মাহিকে কারো সাথে কথা বলতে দেখে। মেহেরের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। খুশিতে চোখ চকচক করছে। ওর বাবা-মা এসেছে। তিন মাসে এই প্রথম তারা ওর বাড়িতে এসেছে।

কিন্তু সবার চোখ মুখ কেমন লাগছে। মনে হচ্ছে তারা কিছু নিয়ে বিরক্ত, কেউ আপসেট, কেউ চিন্তিত।
মেহের চিন্তায় পড়ে গেল। শরীরটা দূর্বল লাগছে খুব। তাই ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে নেমে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“মা! বাবা! তোমরা কখন এসেছো?”
মেহেরের মা ওকে দেখে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু ওর বাবার চোখে মুখে বিরক্ত,রাগ দেখা যাচ্ছে। আর মাহিকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।
মেহেরের মা ওর গালে হাত দিয়ে বলল,
“কেমন আছিস তুই? শরীর ঠিক আছে তো?”
মেহের বাবার দিকে তাকিয়ে মায়ের কথার উত্তর দিল,
“হ্যাঁ আমি ঠিক আছি। মাহি আপু আমাকে ডাকো নি কেন?”
মাহি কিছু বলতে যাবে তখনই মেহেরের বাবা উঠে দাঁড়িয়ে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

“আমি এখানে শুধুমাত্র তোমার মায়ের জন্য এসেছি। নয়তো এখানে আসার বিন্দুমাত্র রুচি আমার নেই। এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করেছো? ছিহ। আমাদের পরিবারের কেউ এর আগে পুলিশ স্টেশনে গিয়েছে? যায় নি। কিন্তু এই ছেলের তো যাওয়া আসার অভ্যাস আছে। এমন একটা ছেলে আমার মেয়ের জামাই? লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।”
মেহের মাথা নিচু করে চুপ করে আছে।
মেহেরের বাবা মেহেরের মাকে কটাক্ষ করে বলল,
“হয়েছে মেয়ে দেখা? যদি না হয় এখানেই থেকে যাও৷ আমি যাচ্ছি। এই বাড়িতে আমি আর এক মুহুর্ত দাঁড়াতে চাই না।”
মেহেরের মা আকুতি নিয়ে বলল,
“একটু কথা বলতে দেও।”
মেহেরের বাবা রাগ দেখিয়ে বলল,

“কি কথা বলবে? ও ভালো আছে। এই গুন্ডাটার সাথে বেশ ভালো আছে। আর মাহি? তুই এখন বাড়িতে যা। তোর নিজের সংসার আছে৷ ভদ্র বাড়ির বউ তুই। চল আমার সাথে। আমি তোকে বাড়িতে দিয়ে আসব।”
মাহি আমতা আমতা করে বলল,
“তূর্জ আমাকে নিতে আসবে। আমি তূর্জের সাথে চলে যাব। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না।”
মেহের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা, আমার সাথে এমন করছো কেন? এই প্রথম আমার বাড়িতে এসেছো। এভাবে চলে যাবে? ফায়াজ যেমনই হোক আমার শ্বশুর একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি একজন উঁচু শ্রেণির বিজনেসম্যান। তুমি এভাবে অপমান করছো কেন?”
“লাগছে খুব না? শ্বশুরের সম্মান নিয়ে এত ভাবছো তার ছিটেফোঁটা যদি আমার সম্মান নিয়ে ভাবতে তবে এই দিন দেখতে হতো না।”
তারপর মেহেরের মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।”

মেহেরের মা চোখের পানি ফেলে মেহেরের গালে হাত রেখে বলল,
“বাবার কথায় মন খারাপ করিস না। নিজের খেয়াল রাখিস। আর ফায়াজকে একটু ভালো করে বুঝিয়ে বলিস। ও যেন মাথা গরম করে এমন ঘটনা না ঘটায়।”
মেহেরের মা-ও চলে গেল।
মেহের সোফায় বসে পড়ল। মাহি ওর পাশে বসে শান্তনা দিয়ে বলল,
“ভাবিস না। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন খেয়ে নে। নয়তো শরীর আরো খারাপ হয়ে যাবে।”
মাহি এক গ্লাস পানি ঢেলে এনে মেহেরকে দিল। মেহের পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছে। বাবা-মা এভাবে চলে গেল? বাবা এত কথা শুনিয়ে গেল?
মেহের বাবার বলে যাওয়া কথাগুলো ভাবছে৷ তখনই গ্লাস নড়ে উঠল। মেহের চমকে গেল। তারপর দেখল ফায়াজ গ্লাস ওর মুখের সামনে ধরে আছে। মেহের গ্লাসটা নিয়ে পানি খেয়ে নিল।
“চলো খুব ক্ষুধা লেগেছে। খেয়ে নেই।”
ফায়াজ ডাইনিংয়ে গিয়ে বসল। মেহেরও মুখ ভার করে গেল। ফায়াজ নিজের মতো খাচ্ছে। মাহি মেহেরকে খাইয়ে দিচ্ছে। মেহেরের হাত এখনো ব্যথা।
মাহি মেহেরের মুখে খাবার পুরে দিয়ে বলল,
“মেহু আমাকে বাড়িতে যেতে হবে। তূর্জ আমাকে নিতে আসবে কিছুক্ষণ পরে।”
মেহের করুন চোখে মাহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপু, তুমিও চলে যাবে? বাবার জন্য?”
মাহি স্মিত হেসে বলল,

“আরে না। আমি বিবাহিত। তূর্জ যদি আমাকে থাকতে বাঁধা না দেয় তবে অন্য কথা। বাবার কথায় আমি চলে যাব কেন?”
“তাহলে তূর্জ ভাই তোমাকে চলে যেতে বলেছে?”
মাহি ফায়াজের দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল,
“না, কিন্তু আমার যেতে হবে। তুই ম্যানেজ করে নিতে পারবি না?”
ফায়াজ প্লেট থেকে চোখ সরিয়ে মাহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“অবশ্যই পারবে। তোমার সমস্যা হলে তুমি যেতে পারো। মেহেরকে দেখার জন্য লোকের অভাব নেই।”
মাহি আর মেহের দুজনেই ভেবেছিল ফায়াজ থাকতে বলবে মেহেরের জন্য কিন্তু না ফায়াজ সুন্দর ভাবে চলে যেতে বলল।
মাহি মেহেরের দিকে তাকাল। মেহের মুখ ভার করে রাখল। আজ বাবা-মা এভাবে চলে গেল এখন আবার মাহিও চলে যাবে।
🌸🌸
মাহি চলে যাওয়ার পর ফায়াজ মেহেরের খেয়াল রেখেছে,যত্ন নিয়েছে। মেহের কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে গেছে। তারপর ফায়াজ ওকে ভার্সিটিতে যাওয়ার পারমিশনও দিয়েছে।

এভাবে কেটে গেছে আরো অনেকগুলো দিন। ফায়াজ আর মেহেরের একে অপরের প্রতি অনুভূতিগুলো প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। একটা মায়া, একটা টান দু-জনেই অনুভব করতে পারছে৷ তবে এই অনুভূতির নাম দিতে পারছে না। আর না একে অপরের প্রতি সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে। মনের গহীনে জন্ম নেওয়া এই সম্মোহন, এই অনুভূতির বিকাশ খুব গোপনে প্রসারিত হচ্ছে। ফায়াজ আর মেহেরের সাথে আগের মতো খারাপ ব্যবহার করে না। মাঝেমধ্যে রাগারাগি করে, চেচামেচি করে, পরে আবার আগের মতো হয়ে যায়। তবে কোনোটাই মাহিকে নিয়ে নয়। নিজেদের সাংসারিক কিংবা ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে সংগঠিত হয়। ফায়াজ আর মাহিকে নিয়ে মাথা ঘামায় নি। ওরা ওদের মতো আছে নিজেদের নিয়ে।
🍂🍂
মেহের একদিন দুপুর বেলা একা একা বোর হচ্ছিল৷ ক্লাস নেই, কাজ নেই। একা ফাঁকা বাড়িতে ভালো লাগছে না। মেহের একটা ডিভিডি অনেক দিন ধরে দেখছে। আজ হাতে পড়ায় সেটা নিয়ে ভাবছে। এই ডিভিডিতে কি থাকতে পারে৷ বাড়িতে আর ডিভিডি নেই। এই একটা ডিভিডি কিসের?
মেহেরের হটাৎ করে কৌতূহল জাগে। আর সেই অবাধ্য কৌতূহল মেটাতে ডিভিডিটি প্লে করে চমকে যায়।
ডিভিডিতে রেকর্ডিং করা গান বাজছে আর ভয়েস আর কারো নয় ওর নিজের। মেহেরের নিজেকে কনফিউজড লাগছে। তাই একের পর এক রেকর্ডিং শুনছে কিন্তু না ভুল না। ও ঠিক শুনছে। এগুলো ওর রেকর্ডিং করা গান৷ কিন্তু ফায়াজ এগুলো কোথাও থেকে পেল? মেহের ঘরজুড়ে পাইচারি করেও কোনো কারণ উদঘাটন করতে পারল না।
এর উত্তর তো একমাত্র ফায়াজই দিতে পারবে। ফায়াজ কোথায় পেল এ-সব?

বিকেল বেলায় বৃষ্টি পড়ছে। ফায়াজ বাড়িতে নেই। মেহের ফায়াজের আসার অপেক্ষা করছে। এক বার ফোন করতে চাইছে কিন্তু ফোন করছে না। যদি ফায়াজ ব্যস্ত থাকে? তারপর যদি আবার রাগ করে? তাই মেহেরের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
ফায়াজ বাড়িতে ঢুকতেই মেহের ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“আপনার সাথে কথা আছে। ঘরে চলুন।”
ফায়াজ ভ্রু কুচকে মেহেরের দিকে তাকাল। কি এমন হয়েছে যে কারণে আসতে না আসতেই মেহের ওকে ঘরে আসতে বলবে? তাছাড়া ফায়াজ তো এখন ঘরেই যাবে। ফ্রেশ হবে।
“কি কথা? কিসের জন্য এত উৎকন্ঠা?”
মেহের অস্থির হয়ে বলল,
“চলুন প্লিজ।”
ফায়াজ রুমে যাচ্ছে। পেছনে পেছনে মেহেরও গেল। ফায়াজ জগ থেকে পানি ঢেলে খেতেই কানে গানের কিছু কথা ভেসে এল৷ ফায়াজ চমকে গিয়ে পেছনে তাকাল।

মেহের ফায়াজের দিকে আর ফায়াজ মেহেরের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ফায়াজের কপাল কুচকে আসছে।
মেহের একের পর এক গান পালটে ফায়াজের সামনে এলো। ফায়াজ চোয়াল শক্ত করে বলল,
“এই তোমার প্রয়োজন? এগুলো ধরেছো কেন?”
মেহের বুঝতে পারছে না কি এমন করেছে যে ফায়াজ এমন রেগে যাচ্ছে। মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“জানতে ইচ্ছে করছিল এইগুলো কোথায় পেলেন? আপনার কাছে এলো কি করে? ”
ফায়াজ গান বন্ধ করে বলল,
“কেন চিনতে পারছো না? এগুলো মাহির রেকর্ডিং করা গান যা আমাকে দিয়েছিল।”
মেহের হতভম্ব হয়ে বলল,
”মাহি আপুর গান? এগুলো মাহি আপু গেয়েছে?”
ফায়াজ ছোট্ট করে বলল,”হ্যা।”
মেহের হালকা হেসে বলল,
“মাহি আপু তো কখনো গান শিখে নি। গানের তাল, লয় কিছুই আপু জানে না। আপু আর দশজনের মতো সাধারণ গান গাইতে পারে। এগুলো তো আমার রেকর্ডিং।”

মেহের সরল মনে সব বলে দিল। ফায়াজ স্তব্ধ হয়ে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মেহেরকে দেখছে।
“কি বললে তুমি? এগুলো তোমার কন্ঠে গাওয়া গান?”
মেহের ফায়াজের অস্থিরতা আর অশান্ত মনের অবস্থা না বুঝে বলল,
“হ্যাঁ, আমার। এটা যে আপুর কন্ঠ না সেটা তো বুঝাই যাচ্ছে। আমার আর আপুর ভয়েস আপনি চিনেন না?”
ফায়াজের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এই জন্যই কি মেহেরের কন্ঠস্বর, গানের স্বর এত পরিচিত লাগতো? মাহি ওকে এতভাবে এতবার ঠকিয়েছে। সব তো ভুলেই গিয়েছিল কিন্তু আবারো নতুন করে আরো একটা সত্যের মুখোমুখি হতে হলো? আর কত সত্যের মুখোমুখি হতে হবে?
ফায়াজ অস্থির অস্থির করছে। রুম থেকে বের হয়ে গেল। মেহের বুঝতে পারল না কি হলো। মেহের ফায়াজকে ডাকছে কিন্তু ফায়াজ শুনছে না।
ফায়াজ বাড়ির বাইরে চলে গেল। মেহের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। কারণ বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ফায়াজ বাগানে বৃষ্টির মধ্যে বসে পড়ল। ফায়াজকে ডাকছে,
“ফায়াজ,, বৃষ্টিতে কেন ভিজছেন? অসুস্থ হয়ে পড়বেন। জ্বর এসে পড়বে।”
ফায়াজ ওর কথা কানেই নিচ্ছে না। চুপ করে বেঞ্চিতে বসে আছে। এত বড় প্রতারণা কি করে একটা মানুষ করতে
পারে? বিবেকে বাঁধে না?

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ১৯

মেহের আর না পেরে বৃষ্টিতে ভিজে ফায়াজের কাছে যায়।
“কি হয়েছে আপনার? এভাবে চলে এলেন কেন? আর এই বৃষ্টিতে বসে আছেন কেন?”
ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল। ফায়াজের চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে। চুল বেয়ে পানি পড়ছে।
“তোমার বোন আমাকে আবারও ঠকিয়েছে। একটা মানুষ এত বড় প্রতারণা কি করে করতে পারে?”
“আপু কি করেছে?”
“তোমার আপু তোমার গান দিয়ে আমাকে বলেছিল এটা ওর ভয়েস, ও আমার জন্য এগুলো গেয়েছে। আর আমি বোকার মতো ওর এই গান শুনে ওর প্রতি দিন দিন দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম। এই গান দিয়েই আমাকে ইমপ্রেস করেছে। আমি ওর গান শুনেই ওর জন্য কিছু অনুভব করেছিলাম। কি করে করল এটা মাহি? যেদিন মাহি বলেছে

ও আমাকে ভালো বাসে না সেদিনও এত কষ্ট পাই নি আজ যতটা কষ্ট পেলাম।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে নিজের হাতে নিজের মুখ চেপে ধরল।
“আপু আমার গান দিয়ে অন্যকে ঠকিয়েছে? আমার অজান্তেই আমাকে এই জঘন্য কাজে জড়িয়েছে? কি করে করল আপু এটা? আমাকে না জানিয়ে আপু,, আমাকেও ঠকিয়েছে আপু।”
মেহেরের আজ প্রথম নিজের বোনের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে।

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.