শেষ পাতায় তুমি পর্ব - Golpo bazar

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২২ || না বলা কিছু কথা

শেষ পাতায় তুমি

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২২
ফাবিহা নওশীন

পাখিরা কিচিরমিচির করে ভোরের জানান দিচ্ছে। অন্ধকার কাটিয়ে আলো ফুটছে। জানালা ভেদ করে স্নিগ্ধ বাতাস আসছে। মেহের গ্রিলে হাত দিয়ে শুভ্র নির্মল আকাশ দেখতে। মাঝেমাঝে হালকা বাতাস এসে ওর চুলগুলো ছুয়ে দিচ্ছে।
প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষ করে জানালার পাশে এসে ১০-১৫মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অন্ধকার কাটিয়ে আলো ফুটে তবেই আবার বিছানায় ফেরত যায়। কিন্তু আজ যাচ্ছে না। আজ আলো ফোটার পর সূর্য্যি মামা রোদের প্রখরতা বাড়িয়ে তুলছে তবুও মেহেরের নড়ার নাম নেই।
কারো হাতের স্পর্শে মেহের ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর হালকা হেসে বলল,
“কি রে সামিরা আজ এত সকাল সকাল উঠেছিস? ডেট-ফেট আছে নাকি?”
সামিরা চোখ ডলতে ডলতে বলল,

“তুই নামাজ পড়ার পর আর ঘুমাস নি তাই না?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে আজকে ঘুম আসছিল না। তাই আর শুতে যাই নি। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম।”
সামিরা মেহেরের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
“ঘুমের আর কি দোষ? এই কাঁদিস নি তো?”
মেহের হালকা হেসে বলল,
“এই আমি কাঁদব কেন? পাগল হয়েছিস?”
সামিরা নাক সরু করে চোখ ছোট ছোট করে মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর হাত উঁচিয়ে বলল,
“ঠাটিয়ে মারব এক চড়। আমার সাথে অন্তত ঢং করিস না। আজ তোদের বিবাহ বার্ষিকী আমি জানি। তাই তো এমন পেত্নীর মতো মুখ করে বসে আছিস। কার জন্য মন খারাপ করিস? যে তোকে ফেলে বিদেশে গিয়ে সুখের জীবন কাটাচ্ছে৷ দেখ এ-সব বাদ দে। চিল মুডে থাক। চল আজ আমরা ঘুরতে যাব।”
মেহের কিছু বলতে যাবে তখনই সামিরা বলল,
“নেকামো বাদ দে। রেডি হয়ে নিস। নয়তো তুলে নিয়ে যাব।”
সামিরা দুম করে আবারো শুয়ে পড়ল।
মেহের আবারো বাইরে তাকাল। তারপর ভাবছে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

“আসলেই তো কার জন্য মন খারাপ করছি আমি? যে আমাকে মুক্তি দিয়েছে? প্রয়োজন শেষে ফেলে চলে গেছে? যে আমার ছোট্ট অবুঝ মনের
নিষ্পাপ ভালোবাসার বিন্দুমাত্র দাম দেয় নি? আমি আর উনাকে ভেবে মন খারাপ করব না। চিল মেহের চিল।”
কেটে গেছে আরো চার মাস। এই চার মাসে মেহের মানুষের অপমান, অবহেলা সব মুখ বুঝে সহ্য করেছে। পরিবারেও ঠায় পায় নি। মেহেরের বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছে মেহেরের ও-বাড়িতে জায়গা হবে না। নিজের পছন্দে এক জনকে বিয়ে করেছে। সে এখন ওকে ছেড়ে দিয়েছে। আবার এই বাড়িতে এসে উঠেছে। সমাজে মুখ দেখাবে কি করে। তাই অবশেষে হোস্টেলে উঠেছে। মাহি বলেছিল ওর বাড়িতে গিয়ে থাকতে কিন্তু মেহের সেই প্রপোজাল রিজেক্ট করেছে। হোস্টেলেই থাকে চার মাস৷

ফাইজা এসে ফায়াজের আশেপাশে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরঘুর করছে। কিন্তু ফায়াজের সেদিকে খেয়াল নেই। ফাইজা কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ বালিশে মাথা দিয়ে সিলিংয়ের দিকে উদাসীন ভাবে তাকিয়ে আছে।
ফাইজা ফায়াজের পাশে গিয়ে বসতেই ফায়াজের ধ্যান ভাঙল।
ফায়াজ উঠে বসে বলল,
“আরে তুই? কখন এলি?”
“অনেকক্ষণ। ১৫মিনিট তো হবেই। তুমি এতক্ষণ কোথায় হারিয়েছিলে? আমাকে দেখলেই না।”
ফায়াজ আমতা আমতা করছে।
“আসলে সরি রাগ করিস না৷ খেয়াল করি নি।”
“আর দরজা? ফ্ল্যাটের দরজা খোলা কেন? কেউ এসে কিছু নিয়ে চলে গেলেও তো টের পাবে না।”
ফায়াজ মাথা চুলকে বলল,
“বন্ধ করতে মনে নেই।”
ফায়াজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“মনের আর দোষ কি?”
ফায়াজ চুপ করে গেল ফাইজার কথা শুনে।
“তুই কি আমার উপর এখনো রাগ করে আছিস?”
ফাইজা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

“আমি তোমার বোন। তাই বোন হিসেবে তোমার উপর রাগ করে থাকতে পারি না। কিন্তু একটা মেয়ে হিসেবে তোমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারব কি না আই ডোন্ট নো৷ আই রিয়েলি ডোন্ট নো।”
ফায়াজ আর কোনো কথা বলল না।
ফাইজা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি যাচ্ছি। মম আমার জন্য টেনশন করবে। তাছাড়া আমার পড়াশোনা আছে। নিজের খেয়াল রেখো। আর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে রাখবে মনে করে।”
ফায়াজ আবারও একা হয়ে গেল। নিজেকে বড্ড শূন্য মনে হয়। কিছুই ভালো লাগে না আজকাল।

মেহের সামিরার সাথে সারাদিন ঘুরেছে। সামিরার সাথে ঘুরাঘুরি করে মনটা হালকা লাগছে। হোস্টেলে ফিরে মেহের বিছানার উপর অনেক গুলো শপিং ব্যাগ দেখল। একজন এসে বলে গেল মেহেরের জন্য এসেছে এগুলো। মেহের শপিং ব্যাগের ভেতর একটা চিরকুট পেল।
রাগে মেহেরের শরীর জ্বলে যাচ্ছে। শপিংগুলো হাতে নিয়ে মেহের গটগট করে হেঁটে বের হয়ে গেল। সামিরা পেছনে থেকে অনেক বার ডাকল কিন্তু মেহের পাত্তা না দিয়ে বের হয়ে গেল।
মেহের সোফার উপর ব্যাগগুলো রেখে বলল,
“এ-সব কি আপু? এগুলো কেন পাঠিয়েছো?”
মাহি শুয়ে ছিল। মেহেরকে দেখে ধীরে ধীরে উঠে বসল ভারী দেহ নিয়ে। মাহি বিছানা থেকে পেটে হাত দিয়ে নেমে বলল,
“কি হয়েছে? এগুলো ছুড়ে মারলি কেন?”
মেহের কটাক্ষ করে বলল,

“তুমি এগুলো কেন পাঠিয়েছো? আমি চেয়েছি তোমার কাছে?”
মাহি মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ মেহের আজকাল কত বদলে গেছে। কিভাবে কথা বলছে।
“কেন রে খুব অন্যায় করে ফেলেছি? বোন হিসেবে তোকে কিছু দিতে পারি না?”
মেহের তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“অনেক কিছুই তো দিয়েছো আর কত দিবে? আমার কিছুই নেই। পরিবার-পরিজন নেই, বাড়ি নেই কিছুই নেই। কেন নেই আপু? আমার বাবা-মা, আমার বাড়ি থাকতেও আমি হোস্টেলে থাকছি একা। কেন? কি অন্যায় করেছিলাম?”
মাহির গলা ধরে আসছে। কথা বলতে পারছে না। মাহি ঠোঁট কামড়ে বলল,
“নাহ তুই কোনো অন্যায় করিস নি। সব অন্যায়, সব পাপ আমার।”
মেহের চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল,

“তাহলে শাস্তি কেন আমি পাচ্ছি? তোমার সুখ-শান্তি, ঘর-সংসার, বাবা-মা, বাড়িঘর সব আছে৷ আমার কেন নেই? আমি একা কতদিন বাঁচব?”
মাহি ওর হাত ধরে বলল,
“আমি কি করব মেহের? কি করব? সব অপরাধ আমার। আমি স্বীকার করছি। কিন্তু আমি তোকে প্রথমেই বলেছিলাম আগুনে ঝাপ দিয়েছিস তুই। আমি নিষেধ করেছিলাম। আমি তোকে একবারও বলেছিলাম আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত তোকে করতে? আমি নিজেই সেই প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলাম। আমি এখনো তোর জীবন ছাড়খার হওয়ার জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করি। তিলতিল করে মরছি রোজ। কিন্তু আমি কি করব? কি করে সব ঠিক করব? আমি চাইলেই কি সব আগের মতো করতে পারব? পারব না। আর তাছাড়া আমার বেবি? আমি ওর কথা ভেবে কিছুই করতে পারছি না। কিন্তু তুই যদি চাস এতে তুই হ্যাপি থাকবি তবে সব করতে রাজি আছি।”

“তুমি আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার না করলেই আমি হ্যাপি থাকব।”
মেহের কথাটা বলে চলে গেল মাহির রুম থেকে।
মাহি বিছানায় বসে পড়ে মুখ চেপে কাঁদছে।
“আমি কি করলে তুই ভালো থাকবি মেহু? কি করে তোকে হ্যাপি রাখব? আমি তোর জীবনটা গুছিয়ে দিতে চাই। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি এই মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে পারছি না।”

ফায়াজ জ্বরের ঘোরে বারবার মেহেরের নাম করছে। ফাইজা পট্টি দিচ্ছে ফায়াজের কপালে। আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।
“ভালোবাসার জ্বরে পুড়ে মরছে তবুও মুখে স্বীকার করবে না।”

ফায়াজ একটু সুস্থ হতেই ফাইজা ওর পাশে বসে বলল,
“ধরো তুমি শুনলে মেহের ভাবীর থুক্কু মেহেরের বিয়ে হচ্ছে তাহলে কেমন হবে?”
ফায়াজ ফাইজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি যা তা বলছিস বিয়ে কেন হবে?”
ফাইজা গালে হাত দিয়ে বলল,
“কেন হবে না ভাইয়া? ও কি কাউকে ভালোবাসতে পারে না? কাউকে বিয়ে করতে চাইতে পারে না?”
ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“না পারে না। কারণ ও এখনো আমার ওয়াইফ।”

“বিদেশে বসে বসে স্বামীগিরি দেখাচ্ছে। তুমি এখানে বসে স্বামীগিরি দেখাও মনে মনে আর ও ওখানে বিয়ে-শাদি করে সংসার করুক অন্য কারো সাথে। তারপর বাচ্চা-কাচ্চা পয়দা করুক। তুমি দেশে ফিরলেই মামা মামা বলে ছুটে আসুক।”
ফায়াজ ধমকে উঠল।
“এই চুপ করবি তুই? ও কাউকে বিয়ে করতে পারে না।”
“কেন পারে না?”
“কারণ আমি ওকে ভা,,,।”
ফায়াজ চুপ করে গেল।
ফাইজা ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ভায়ায়ায়া কি? বল বল।”
ফায়াজের বলেই দিল। আর পারছে না নিজের অনুভূতি থেকে ভাগতে।
“আমি ওকে ভালোবাসি।”
ফাইজা ওর গাল টেনে বলল,
“ওলে ওলে আমার ভাইটা লাইনে এসেছে৷ তো এখানে বসে না থেকে টিকেট কেটে বাড়ির পথে হাঁটা দেও থুক্কু উড়াল দেও। নয়তো তোমার পাখি উড়াল দিবে।”

ফায়াজ কাউকে কিছু না জানিয়েই দেশে ফিরেছে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ভার্সিটিতে চলে যায়। ফায়াজের মনে টানটান উত্তেজনা। মেহেরকে দেখার পর কি হবে? ভার্সিটিতে যেতেই তুষারের সাথে দেখা। তুষার ফায়াজকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল,
“আরে মামা, তুই কবে আসলি? কিছু জানালি না?”
ফায়াজ কথার উত্তরে বলল,
“এ-সব পরে হবে। এখন মেহের কোথায় সে খোঁজ কর।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। আমি খোঁজ লাগাচ্ছি।”

ফায়াজ মেহেরের ক্লাস রুমে গেল। কিন্তু ক্লাস রুমে দু’চার জন বসে আড্ডা দিচ্ছে। ক্লাস অফ। ফায়াজ একজনকে জিজ্ঞেস করল মেহের কোথায়। সে জানাল মেহের নাচের ক্লাসে থাকতে পারে।
ফায়াজ যেন ঝড়ের গতিতে নাচের ক্লাসে গেল। শরীর যেন কাঁপছে অজানা কারণে। ফায়াজ নাচের ক্লাসের দরজার সামনে গিয়ে দেখল সেখানে অনেক মেয়ে কোনো ছেলে নেই। একজনকে ডেকে বলল,
“এক্সকিউজ মি একটু দেখবেন মেহের নামে কেউ আছে কি না।”
“জি দেখছি।”
মেয়েটা পুরো রুমে জিজ্ঞেস করল মেহের বলে কেউ আছে কি না৷ কিন্তু কেউ নেই৷ মেয়েটা এসে জানাল মেহের নেই এখানে। তারপর বন্ধুরা মিলে পুরো ক্যাম্পাস খুঁজে নিল কিন্তু মেহের নেই। ফায়াজ হতাশ হয়ে পড়ল। তারপর ফায়াজ মেয়েদের কমন রুমে গিয়েও খোঁজ নিল সেখানেও নেই। ফায়াজ কমন রুমের সামনে দাঁড়িয়ে তুষারকে ফোন করে বলল,

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২১

“তোরা একটা মেয়েকে খোঁজে বের করতে পারছিস না? কি করছিস? আমার এই মুহুর্তে মেহেরকে চাই।”
“ভাই খুঁজছি। তুই রিলেক্স থাক।”
ফায়াজের বন্ধুরা মিলে পুরো ক্যাম্পাস, ক্যান্টিন, ক্লাস রুম সব তন্নতন্ন করে খুঁজছে।
ফায়াজ নিজের চুল মুঠ করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাগ লাগছে খুব৷ ইচ্ছে করছে সব গুড়িয়ে দিতে।
তখনই ফোন বেজে উঠল। ফায়াজের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল।
মেহের লাইব্রেরীর বইয়ের সেল্ফ থেকে খুঁজে খুঁজে দুটো বই নিল। তারপর টেবিলের দিকে যাবে তখনই আবেগে মাখা কন্ঠস্বর কানে এল।
“মেহের!”
মেহের থমকে গেছে কন্ঠস্বরটা শুনে। দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে হাত থেকে বই দুটো পড়ে গেল। শরীর কাঁপছে প্রচুর। নিশ্বাস আটকে আসছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে৷ জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। নিচের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
ফায়াজ মেহেরের দিকে এগিয়ে গেল। মেঝে থেকে বই দুটো তুলতেই মেহের দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। ফায়াজও দৌড়ে পেছনে পেছনে গেল। সবাই মেহেরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বলল,

“মেহেরজান যতই পালাও না কেন এইবার আর ছাড়া পাবে না। ফায়াজের ঘৃণা আর হিংস্রতা দেখেছো আর এখন পাগলামি আর ভালোবাসা দেখবে। সো গেট রেডি বেবি।”

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.