শেষ পাতায় তুমি পর্ব - Golpo bazar

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২৩ || tui shudu amar

শেষ পাতায় তুমি

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২৩
ফাবিহা নওশীন

মেহেরের শরীর থরথর করে কাঁপছে। বিছানায় বসে আগে জোরে জোরে শ্বাস নিল। মনে হচ্ছে এতক্ষন শ্বাস আটকে ছিল। জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে দ্রুত ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে শেষ করে ফেলল। তারপর আবারো বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।
মেহের লাইব্রেরী থেকে এক দৌড়ে ভার্সিটির গেটের বাইরে আসে তারপর একটা অটো ধরে সোজা হোস্টেলে। হোস্টেলের রুমের দরজাও বন্ধ করে নিয়েছে ভয়ে। ওর রুমমেট সামিরা ভার্সিটিতে। একা জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় বসে আছে। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ছে।
দীর্ঘ ৫মাস পর ফায়াজকে দেখল আজ। মেহেরের চোখের সামনে বারবার লাইব্রেরীর দৃশ্যটা ভেসে উঠছে। আর কানে বাজছে সেই সুর “মেহেরজান!”
মেহের আনমনে ভাবছে,

“কেন এসেছেন উনি? এতদিন পরে কেন এসেছেন? আমি সত্যি উনাকে দেখেছি তো? না আমার ভ্রম ছিল? উনি আমাকে মেহেরজান বলে ডাকল তো? ভুল কি করে হতে পারে? আমি ঠিক শুনেছি। উনি আমাকে মেহেরজান বলে কেন ডাকবে?”
মেহেরের মাথা কাজ করছে না। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। ফায়াজ ওর কাছে আবার কি চায়?
🍂🍂
দুপুর ২টা। দরজায় অনবরত কড়া নেড়ে যাচ্ছে সামিরা। মেহেরের খোলার নাম নেই। সে তো ভাবনার জগতে হারিয়ে গেছে। অন্য দিকে তার খেয়াল নেই।
“মেহের, তুই ঠিক আছিস তো? আমার কিন্তু খুব ভয় লাগছে।” হটাৎ সামিরার কথা কানে ভেসে এল। মেহের দ্রুত উঠে দরজা খুলে দেয়। সামিরা কটাক্ষ করে কিছু বলতে যাবে তখনই মেহের ওকে জড়িয়ে ধরে। সামিরা তাজ্জব হয়ে যায়। তাছাড়া মেহেরের শরীর হালকা কাঁপছে।
সামিরা মেহেরকে সামনে এনে আতংকিত সুরে বলল,
“কি হয়েছে এমন করছিস কেন?”
মেহের কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“ফায়ায়া,,,,জ!”
“ফায়াজ? ফায়াজ কি?”
মেহের কাঁদতে কাঁদতে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

“আমি আজ উনাকে লাইব্রেরীতে দেখিছি। আমাকে ডেকেছিল।”
সামিরা কনফিউশন মিশ্রিত হালকা হেসে বলল,
“দূররর…. উনি আসবে কোথায় থেকে? আর কেন আসবে? তুই ভুল দেখেছিস। আর নয়তো তোর কল্পনা ছিল। উনি এলে ভার্সিটি এত ঠান্ডা থাকত। কখনোই না। আর আমি কিছুই জানতে পারতাম না। আমি তো আজ ক্যাম্পাসেই ছিলাম। কই ফায়াজ শব্দটাও কেউ বলে নি।”
মেহের সামিরার কথা শুনে বলল,
“আমি নিজে দেখেছি উনাকে। আমাকে নাম ধরে ডেকেছে। আমার খুব ভয় লাগছে। উনি ৫মাস পরে আমার কাছে কি চায়? আবার কোনো নতুন খেলা খেলতে আসে নি তো। আমার জীবনটা আবারো এলোমেলো করে দেবে না তো?”
সামিরা মেহেরকে শান্তনা দিয়ে বলল,
“কিছুই হবে না। কারণ ফায়াজ আসে নি। ওগুলো তোর মনের ভুল ছিল।”
সামিরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মেহেরকে বুঝাতে।
মেহের সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি। দুপুরে সামিরার জোরাজুরিতে খেলেও রাতের খাবার খায় নি। মেহের ভুল দেখেছে সেটা মানতে পারছে না।

সামিরা আর মেহের হোস্টেলের ক্যান্টিন থেকে সকালের খাবার খেয়ে এসেছে। মেহের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব বাঁধছে। সামিরা ব্যাগ গুছানোতে ব্যস্ত। মেহের হটাৎ পেট ধরে বসে পড়ল।
“ও মাগো পেট ব্যথা করছে। আমি আর এই হোস্টেলেই থাকব না। কি পেট ব্যথা করছে।”
সামিরা ওর কাছে এসে বলল,
“পেট ব্যথা করছে কেন?”
“কেন আবার? আল্লাহ জানে এরা কি রান্না করেছে। খেতে না খেতেই অ্যাটাক। কি পেট ব্যথা করছে।”
সামিরা ভ্রু কুচকে বলল,
“আমিও তো খেয়েছি। তোরই কেন পেট ব্যথা হয়?”
মেহের মুখ ভার করে বলল,
“জানি না। আমি বাইরের খাবার তেমন খেতাম না আগে। পাঁচ মাস ধরে খেতে হচ্ছে। কিন্তু অভ্যাস করতে পারছি না হয়তো। নয়তো পেট ব্যথা কেন হবে?”
“তাহলে আজ আর যেতে হবে না। তুই রেস্ট কর। ওষুধ খেয়ে নে।”
মেহের পেটের ব্যথায় ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। সহ্য করতে পারছে না।
“আমি আজ যেতেও পারব না সামিরা। তুই যা।”
সামিরা মেহেরকে নিজের খেয়াল রাখতে বলে চলে গেল।
সামিরা যেতেই মেহের পেটে বালিশ চেপে ধরে। আর মনে মনে অথোরিটিকে গালাগাল করছে।

ফায়াজ ক্যাম্পাসে বসে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। পুরো ভার্সিটিতে মেহেরের খোঁজ করে জানতে পারে মেহের আজ আসে নি। তাই প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সিগারেট টেনে রাগ কমানোর চেষ্টা করছে। মেহের ওকে ইচ্ছে করে এভয়েড করছে। রাগে ফুসফুস করছে ফায়াজ।

সামিরা হোস্টেলে ফিরে মেহেরকে শুয়ে থাকতে দেখে। মেহেরের কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা মাপল। না জ্বর নেই। মেহের চোখ খুলল। সামিরাকে দেখে উঠে বসল।
“চলে এসেছিস?”
সামিরা বিচলিত হয়ে বলল,
“শুয়ে আছিস কেন? শরীর ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে। আসলে ভালো লাগছে না তাই শুয়ে আছি।”
সামিরা কিছু একটা বলতে চেয়েও থেমে গেল।

মাগরিবের নামাজ পড়ে মেহের জায়নামাজ ভাজ করছে। মেহেরের চোখ গেল খোলা জানালার দিকে। সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হয়ে আসছে আর জানালা খোলা। মেহের সামিরার দিকে তাকাল। সামিরা ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। মেহের জায়নামাজ রেখে জানালা বন্ধ করার জন্য জানালার বাইরে হাত বাড়াল। আর তখন চোখ পড়ল রাস্তার ওপারে। মেহের চোখ ডলে আবারও তাকাল। তারপর দ্রুত জানালার পাশ থেকে সরে এল।
আতংকিত হয়ে সামিরার কাছে গিয়ে বলল,
“আমি দিবাস্বপ্ন দেখি হাহ? এই রাতেও আমি দিবাস্বপ্ন দেখি?”
সামিরা কিছু না বুঝতে পেরে মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
“কি বলছিস? কিছুই বুঝতে পারছি না। ঝেড়ে কাশ যক্ষা রোগীর মতো খকখক না করে।”
মেহের সামিরার হাত ধরে টেনে জানালার পাশে নিয়ে গেল। তারপর আঙুল দিয়ে রাস্তার ওপারে দেখাল।
ফায়াজ রাস্তাজুড়ে পাইচারি করছে আর বারবার হোস্টেলের গেটের দিকে তাকাচ্ছে। দুতলা থেকে নিয়নবাতির আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ফায়াজকে।
মেহের দ্রুত জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিল।
মেহের সামিরার দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সামিরা কাচুমাচু করতে করতে বলল,
“মেহের আমি আজ ভার্সিটিতে গিয়েই জেনেছি ফায়াজ এসেছে। উনি অনুর কাছে তোর খোঁজও করেছিল। আমি তোকে কিছু বলি নি তুই টেনশন করবি তাই।”

মেহের ওড়না খামচে ধরে রেখেছে। মাথা কাজ করছে না।
“আমার খোঁজ কেন করছে সামিরা? কি চায় আমার কাছে? ৮মাস সংসার সংসার খেলে উনার মন ভরে নি? এতদিন প্রায় ৫মাস পরে উনার কি মনে হলো? কি মনে করে আমার খোঁজ করছেন? আর কি চাওয়ার আছে? উনার জন্য আমার পুরো লাইফ হেল হয়ে গেছে। সব হারিয়ে ফেলেছি। আমি নিজের মতো আছি। হয়তো খুব ভালো নেই কিন্তু আছি তো। জানি না মন আমার কেন এত কু ডাকছে। কিন্তু মনে হচ্ছে আমার জন্য আরও ঝড়-ঝঞ্ঝা অপেক্ষা করছে।”
সামিরা ওকে শান্তনা দিয়ে বলল,
“শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিস। কিছুই হবে না।”
মেহের সামিরার হাত ধরে বলল,
“এই যদি উনি হোস্টেলের ভেতরে চলে আসে? তাহলে কি হবে?”
“আরে উনি ভেতরে কি করে আসবে? এটা গার্লস হোস্টেল। যে কেউ এলাও না।”
“তুই তো উনার ক্ষমতা সম্পর্কে জানিস। উনি চাইলে সব পারেন।”
“হ্যাঁ, তা পারে কিন্তু উনি যেহেতু এতক্ষণ আসে নি তাই মনে হচ্ছে না আর আসবে। বি কুল।”
মেহের বিরবির করে বলল,”আর কুল।”
ফায়াজ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল৷ ভেতরে ঢুকে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চায় না৷ এতদিন যখন অপেক্ষা করতে পেরেছে আরো পারবে।

মেহের ভার্সিটিতে যাবে না যাবে না করেও সামিরার জোরাজুরিতে যেতে বাধ্য হলো। কিন্তু সামিরাকে বলেছে ওকে ছেড়ে যেন কোথাও না যায়। মেহের ভয়ে ভয়ে ভার্সিটির ভেতরে ঢুকল।
সামিরার হাত চেপে ধরতেই সামিরা বলল,
“ফেস করতে শিখ। এভাবে আর কত লুকিয়ে থাকতে পারবি?”
সামিরা হাত ছাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। মেহের কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢুকে। ভেতরে ঢুকে প্রথমে যতদূর চোখ যায় ক্যাম্পাস দেখছে। তারপর কোনোদিক না দেখে সোজা ক্লাসরুমের দিকে হাঁটছে। ক্লাসরুমের সামনে এসেই শ্বাস ফেলল জোরে। ক্লাস রুমের ভেতরে গিয়ে পেছনের ছিটে বসে পড়ল।
ক্লাস চলছে। লেকচার চলছে। কিন্তু সেদিকে মেহেরের খেয়াল নেই। ফলশ্রুতিতে মেহেরকে ক্লাস থেকে বের করে দিল।
মেহের রাগে হেঁটেই চলেছে। কোনো দিক তাকাচ্ছে না। এই প্রথম ক্লাস থেকে বিতাড়িত হতে হলো। লজ্জায় মেহেরের মাথা কাটা যাচ্ছে।
হটাৎ মেহের থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সামনে ফায়াজ দুহাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। মেহের ফায়াজকে দেখে চোখ নামিয়ে নিল।

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২২

ফায়াজ ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ফায়াজ যতই এগিয়ে আসছে ওর হৃদপিন্ডের গতি ততই বেড়ে যাচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। মেহের ফায়াজের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
ফায়াজ ওর সামনে এসে আচমকা ওকে জড়িয়ে ধরল। মেহেরের পুরো দুনিয়া যেন থমকে গেল। একদম যেন ফ্রিজড হয়ে গেছে। ফায়াজ মেহেরকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলছে। যেন কতকালের যন্ত্রণা মিটিয়ে নিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। মেহের ফায়াজকে সরাতে পারছে না। ফায়াজকে আজ যেন অচেনা মনে হচ্ছে। আর ওর শরীরের ঘ্রাণ যেন ওকে মাতাল করে দিচ্ছে।
ফায়াজ কিছুক্ষণ পরে মেহেরকে ছেড়ে মেহেরের মুখের দিকে তাকাল। আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছে। মেহেরের চোখের পাতা ভেজা৷ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ মেহেরের থুতনি ধরে উঁচু করে মুখের দিকে কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে আছে। ও মেহেরের গালে ঠোঁট ছুয়াতেই মেহের নড়ে-চড়ে দাঁড়াল। মেহের ফায়াজের দিকে একবার অবাক হয়ে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নিল। ভেতরে ভেতরে উত্তাল ঢেউ বইছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,

“মেহের বাড়ি ফিরে চলো। আমি তোমাকে ফিরে পেতে চাই।”
মেহের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দু-কদম পিছিয়ে গেল। ওর দৃষ্টি শান্ত নয়। ফায়াজ বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে।

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.