শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২৪
ফাবিহা নওশীন
“বাড়ি! কিসের বাড়ি? কার বাড়ি? আর আমি আপনার সাথে কেন যাব? কে আপনি?”
মেহের মাটির দিকে তাকিয়ে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ফায়াজের দিকে তাকাল।
ফায়াজের দিকে তাকাতেই মেহেরের কলিজা কেঁপে উঠল। ফায়াজ অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে।
মেহের সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল। আর মনে মনে বলছে,
“আমি কি বেশী সাহস দেখিয়ে ফেললাম? আমাকে আবার পাব্লিক প্লেসে মারবে না তো?”
মেহের মনে মনে ভয়টা লুকাতে চাইলেও না চাইতেই ফেসে ঠিকি ফুটে উঠছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত চেপে ধরে বলল,
“আমি কে? ইউ ডোন্ট নো হু আই এম? আ’ম ইউর হাসব্যান্ড। স্টিল আ’ম ইউর হাসব্যান্ড। আমাদের ডিভোর্স হয় নি।”
মেহের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে ফায়াজ আরো জোরে চেপে ধরল।
“বিয়ে হয়েছে? বিয়ে হলে না ডিভোর্স। আমাদের মধ্যে যা হয়েছে সেটা বিয়ে না। সেটা ছিল চুক্তি। আর সেই চুক্তির মেয়াদ ছিল ৮মাস। ৫মাস আগেই যার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ভুলে গেছেন? মুক্তি দিয়ে গিয়েছেন। আর হাসব্যান্ড? কিসের হাসব্যান্ড? আবারও হাসব্যান্ডের দোহাই দিয়ে কি চাইছেন? কেন? কেন ফেরত চাইছেন?”
ফায়াজ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে হাত ঝেড়ে বলল,
“কারণ আমি…”
মেহের ফায়াজের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েই আবারও চোখ নামিয়ে নিল কোনো প্রশ্ন না করে।
ফায়াজ অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ শ্বাস ফেলে বলল,
“জানি না। আমি শুধু জানি তুমি যাবে। তুমি আমার কাছে থাকবে।”
মেহের শান্ত কন্ঠে বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
“আমাকে কি আপনার পুতুল মনে হয়? আমি আপনার হাতের পুতুল? যেভাবে নাচাবেন আমি নেচে যাব? যখন ইচ্ছে হলো বিয়ে করে নিলেন। মানসিক শারীরিক টর্চার করলেন। তারপর যখন সেই ইচ্ছে মিটে গেল আমাকে মুক্তি দিয়ে দিলেন। তারপর আমি যখন আমার মতো লাইফ লিড করছি আপনি আবার নতুন করে আমার লাইফে উদয় হলেন। আবার নতুন কোনো খেলা খেলতে।”
ফায়াজ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বলল,
“আমি নতুন করে কোনো খেলা খেলছি না। আমি শুধু চাইছি তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। আমার কাছে রাখতে। আর সেটা আমার ওয়াইফ হিসেবে। আমি তোমাকে তোমার যোগ্য সম্মান দিতে চাইছি।”
মেহের তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“হটাৎ যোগ্য সম্মান দেওয়ার কথা ভাবছেন? বাহ! কিন্তু কেন? আমি চেয়েছি কোনো সম্মান? আমি শুধু মুক্তি চেয়েছি।”
ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কিন্তু আমি তোমাকে মুক্তি দেব না।”
“কিন্তু কেন? কেন দেবেন না?”
ফায়াজ অবাক হয়ে বলল,
“তুমি এখনো বুঝতে পারছ না?”
মেহের নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,”না। আমি বুঝতে পারছি না। কারণ আপনাকে বুঝা বড় দায়। কেন ফেরত চাইছেন?”
ফায়াজ কপালে আঙুল ঘষে আবার রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। তারপর চেঁচিয়ে বলল,
“বিকজ আই লাভ ইউ। আই ওয়ান্ট ইউ।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। মনের ভেতর ঝড় বইছে। কি শুনল এটা? ফায়াজ কি বলল? ভালোবাসে? সত্যি না আবারও কোনো নাটক? কেন এই নাটক করছে?
ফায়াজ মেহেরের দিকে উত্তরের আশায় চেয়ে আছে।
মেহের মুচকি হাসল। কিন্তু ওর ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। গলা ধরে আসছে। কান্নাগুলো বাঁধ মানতে চাইছে না।
ফায়াজ মেহেরের মুখের ওই মুচকি হাসিটা ভালো চোখে দেখছে না। কেমন অদ্ভুত সেই হাসি।
“ভালোবাসা? আপনি আমাকে ভালোবাসেন? আর মাহি আপু? তাকেও তো ভালোবাসেন।”
“ও আমার অতীত। আর আমি ওকে নয় সেই মুগ্ধ করা কন্ঠস্বরকে ভালোবেসে ছিলাম। যা তোমার ছিল মেহের। তুমি নিজেও জানো আমি ওকে ভালোবাসি না।”
“ভালোবাসা? আমাকে ভালোবাসার কথা বলার আগে হিসেব করে দেখুন আপনি আমার সাথে কি কি করেছেন। আপনার জন্য আমি কি কি হারিয়েছি। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আপনি জানতেন আমার বাবা আমাকে কতটা অপছন্দ করত আপনাকে বিয়ে করায়। সবটা জেনেও আমাকে সেই বাড়িতেই রেখে এলেন। একবার ভাবলেন না আমার কি হতে পারে। পাঁচ মাসে একটা বার আমার খোঁজ নিয়েছেন? প্রয়োজন মনে করেন নি। আল্লাহ জানে কোন প্রয়োজনে এসেছেন।”
ফায়াজ আবারও কিছু বলতে গেলে মেহের বলল,
“আপনার অনেক ক্ষমতা। আপনি চাইলেই আমাকে তুলে নিয়ে যেতে পারেন কিন্তু আমি আপনাকে ক্ষমা করি নি আর করবও না।”
ফায়াজ অসহায় ভাবে বলল,
“দোষ কি শুধু আমারই ছিল? হ্যাঁ আমি তোমার সাথে বড় অন্যায়টা করেছি। সব তো স্বীকার করেছি তোমার কাছে যাওয়ার আগে।”
“আপনার একার কথা বলে মাহি আপুকে ইন্ডিকেট করছেন? মাহি আপুকে বোন হিসেবে দূরে ঠেলতে পারি নি। ওর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারি নি। কিন্তু মানুষ হিসেবে ক্ষমা করি নি। এই যে আপনি আমার সাথে যা করেছেন সেটা জানার পর ফাইজা আপনাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে? দেয় নি তো? রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করা এত সহজ না। তাই পারে নি। কিন্তু মানুষ হিসেবে ক্ষমা করেছে কি না জানি না। আমি আপনার কাছে ফিরতে চাই না। প্লিজ আমার উপর আর জুলুম করবেন না।” (হাত জোর করে কেঁদে দিয়ে)
ফায়াজ মেহেরের কান্না দেখে বিচলিত হয়ে পড়ল। মেহেরে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“মেহের প্লিজ কেঁদো না। তুমি যাবে না তো ঠিক আছে। যাওয়ার দরকার নেই। একদম দরকার নেই।” (পাগলের মতো করে)
মেহের ফায়াজের সামনে থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
“মেহের তুমি যাবে। অবশ্যই যাবে। তোমার ইচ্ছেতেই যাবে। আমাকে ভালোবেসে যাবে। সেদিন আমি তোমাকে নিয়ে যাব। এভাবে নয় বউ সাজিয়ে নিয়ে যাব। এটা আমার ভালোবাসার বিশ্বাস। করব না জোর। তবে তোমার পিছ ছাড়ব না। কারণ তুমি আমার অক্সিজেন।”
ফায়াজের আবেগ মাখা কথা শুনে মেহেরের কান্না পাচ্ছে। মন গলে যাচ্ছে।
কিন্তু মেহের স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে।
ফায়াজ মেহেরকে আবারো ভালো করে দেখে নিয়ে বলল,
“যাও। তবে মনে রেখো আমি তোমার পিছ ছাড়ছি না। তোমাকে আমার করেই ছাড়ব। আর হ্যাঁ সাবধান। তোমার উপর আমার নজর থাকবে।”
মেহের ওখান থেকে দৌড়ে লেডিস ওয়াশরুমে চলে গেল। তারপর বেসিন ধরে কাঁদতে লাগল। ফায়াজের বলা ভালোবাসার কথা বারবার কানে ভেসে আসছে। এতদিনের খাঁচায় শক্ত করে আটকে রাখা মনটা নরম হয়ে যাচ্ছে।
ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে।
মেহের হোস্টেলে ফিরে সামিরাকে সবটা বলল। সামিরা কনফিউজড হয়ে বসে আছে। মাথায় কিছু ঢুকছে না। ফায়াজ কি সত্যিই ভালোবাসে মেহেরকে? না কি অন্যকিছু।
সামিরা মাথা চুলকে বলল,
“এই মেহের যদি সত্যি সত্যিই ফায়াজ থুক্কু ফায়াজ নয় ফায়াজ দুলাভাই তোকে ভালোবাসে তবে কি হবে?”
মেহের সামিরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“চিনিস না তুই উনাকে। উনি ভালো টালো বাসতে জানে না।”
সামিরা মেহেরের সাথে ঘেষে বসে কুশন কুলে নিয়ে বলল,
“বাট সত্যিই যদি বাসে? এমনও তো হতে পারে তোকে সত্যিই ভালোবাসে। আর তোর জন্যই ফিরে এসেছে। তাহলে? তুই তো উনাকে ভালোবাসিস। মুখে তুই যাই বলিস না কেন আমি জানি মনে মনে ভালোবাসিস। শুধু অভিমান জমে আছে। এই বল না?”
মেহের সামিরার কথার উত্তর না দিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল। সামিরা ওর কাছ থেকে উত্তর পাওয়ার আশা ছেড়ে দিল। ও নিজেও শুয়ে পড়ল।
মেহের চোখ বন্ধ করে বলল,
“তাহলে উনাকে প্রথমে উনার ভালোবাসাটা প্রমাণ করতে হবে।”
সামিরা লাফ দিয়ে উঠে বসল। মেহেরের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মেহের চোখ বন্ধ করে ফায়াজের মুখটা স্মরণ করল। ফায়াজের ছোঁয়া, ফায়াজের জড়িয়ে ধরা, ফায়াজের চুমু খাওয়া, ফায়াজের বলা প্রতিটি কথা। সব স্মরণ হচ্ছে। এগুলো মেহেরকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। শুধু এপাশ ওপাশ করছে। মেহের সামিরার দিকে তাকাল। সামিরা ঘুমাচ্ছে। মেহের উঠে বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
গভীর রাত। ফায়াজ ছাদে দাঁড়িয়ে ওয়াইনের বোতল চুমুক দিচ্ছে।
“তোমার অভিমানটা অযৌক্তিক না। এইবার আমি তোমার উপর জোর-জবরদস্তি করব না। কোনো প্রকার ব্ল্যাকমেইল করব না। আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবেসে আমার জীবনে ফিরে এসো। আমাকে আমার মতোই ভালোবাসো। তবে তোমার সবটা জুড়ে শুধু আমার বসবাস থাকবে। আর কারো নয়।”
মেহের আর সামিরা এক সাথে কথা বলতে বলতে ভার্সিটিতে ঢুকল। সামিরা ফায়াজকে দেখে মেহেরকে ফিসফিস করে বলল ফায়াজ সামনে। মেহের সামনের দিকে তাকাল। ফায়াজকে দেখে আবারও চোখ নামিয়ে নিল। ফায়াজ ওদের সামনে এসে বলল,
“সামিরা!!”
সামিরা ফায়াজের মুখে নিজের নাম শুনে মেহেরের দিকে একবার তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বলল,
“জি ভাইয়া।”
ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বলল,
“তোমার বান্ধবীকে বলো এত সুন্দর করে ওই কাজল কালো চোখে কাজল যেন না লাগায়।”
সামিরা মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেহের এত সুন্দর করে আর কাজল লাগাবি না।”
মেহের সামিরার দিকে বোকার মতো চেয়ে আছে। মেহের ফিসফিস করে বলল,
“কেন লাগাব না?”
সামিরা ফায়াজকে প্রশ্ন করল,
“ভাইয়া, মেহের জিজ্ঞেস করছে কেন লাগাবে না? ও কাজল লাগাবেই।”
মেহের চোখ বড়বড় করে সামিরার দিকে তাকাল। সামিরা ফায়াজকে কেন বলল এ-সব আর বাড়িয়েই বা কেন বলল?”
ফায়াজ মেহেরের একদম কাছে এসে বলল,
“ওই চোখে কাজল লাগালে মাতাল হয়ে যাই। তারপর কিছু করে বসলে দোষারোপ করতে পারবে না।”
মেহের চোখ বড়বড় করে তাকাল। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। সামিরার দম ফাটানো হাসি পাচ্ছে কিন্তু হাসিটা দমিয়ে রাখছে।
মেহের হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। ফায়াজ মুচকি হাসছে। সামিরা মেহেরের পেছনে দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। সামিরা মেহেরের সামনে গিয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাসি যেন থামিয়ে রাখতেই পারছে না। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে সামিরার হাসি দেখে। মেহের সামিরার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর হনহন করে ক্লাস রুমে গেল।
মেহের ফায়াজকে মনে মনে গালি দিচ্ছে।
“এই ব্যাটা তো দেখছি আস্ত লুইচ্চা। ছিহ! উনাকে তো কখনো এমন মনে হয় নি। নিজেকে কি মনে করে? দেখতে একটু সুন্দর হয়েছে তো কি হয়েছে? আমার মাথা কিনে নিয়েছে? আর আজেবাজে কথা বললে না উনার কোরিয়ান হিরোদের মতো সিল্কি চুলগুলো কেটে দেব।”
মেহের আবার আঙুল কামড়ে ভাবছে “এ আমার দ্বারা সম্ভব না। উনি আমাকে আস্ত চিবিয়ে খাবে।”
মেহের ক্লাস শেষে ভার্সিটির গেটের দিকে যাচ্ছে। সামিরার সাথে রাগ করেছে। আজ একাই যাবে।
“এই হিজাব কুইন।”
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২৩
ফায়াজের কন্ঠস্বর শুনে মেহের দাঁড়িয়ে গেল। ফায়াজ আবার কেন ডাকছে? মেহের ভয়ে ভয়ে পেছনে ঘুরে তাকাল। তারপর আবার দ্রুত হাঁটতে লাগল। ফায়াজ দৌড়ে ওর কাছে এসে বলল,
“তোমাকে ডাকছি না। দাঁড়াচ্ছো না কেন? ফাজিল মেয়ে।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে থ। ফাজিল মেয়ে বলল। মেহের নাক ফুলিয়ে রেখেছে।
সেদিকে ফায়াজের চোখ পড়তেই বলল,
“আবার নাক ফুলায়। ইয়া আল্লাহ এই মেয়ে আমাকে পাগল করে ছাড়বে।”
ফায়াজ পকেট থেকে রুমাল বের করে মেহেরের সামনে গিয়ে ওর লেটকে যাওয়া কাজল মুছে দিচ্ছে। মেহের হা হয়ে ওর কান্ড দেখছে। তারপর আবার চারপাশে তাকাল। কত মানুষ চারদিকে। মেহের সরতে নিলে ফায়াজ ধমকে বলল,
“চুপ করে দাঁড়াও। নাচানাচি করছো কেন?”
কাজল মুছা শেষ হতেই ফায়াজ হালকা হেসে বলল,
“নাও গো সুইটহার্ট। সাবধানে যেও। লাভ ইউ।”
ফায়াজ চলে গেছে। মেহের তখনও দাঁড়িয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। সব মাথার উপর দিয়ে গেল। ফায়াজ কি করছে?