শেষ পাতায় তুমি পর্ব - Golpo bazar

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২৬ || এসো আমার শহরে

শেষ পাতায় তুমি

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২৬
ফাবিহা নওশীন

মেহের ভার্সিটিতে সবার সাথে গানের অনুশীলন করছে। কিন্তু ওর মন পড়ে আছে অন্যদিকে। গতকাল মুখ ফসকে ফায়াজকে যা বলেছে তারপর থেকে মন ভালো নেই। ঠিকমতো ঘুম হয় নি। মনে বারবার কু ডাকছে। আর আজ ভার্সিটিতে এসে ফায়াজের দেখা পায় নি। প্রতিদিন যেখানে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ফায়াজের দেখা মিলে সেখানে আজ লাপাত্তা।
ফায়াজ আজ ইচ্ছে করে মেহেরের সামনে আসে নি। মেহেরের কথায় কষ্ট পেয়েছে খুব। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মেহেরকে দেখছে। মেহেরের কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে কেউ ওকে দেখছে। ওর দিকে নজর রাখছে। মেহের কি মনে করে উঠে দাঁড়ায়। অনু আর সামিরা গানের অনুশীলন করতে করতেই মেহেরের দিকে তাকাল। মেহের হাতের ইশারায় বুঝালো যে আসছে। মেহের গুটিগুটি পায়ে দরজার সামনে গেল। ডানে-বামে দু’পাশে তাকিয়ে হতাশ হলো। কেননা ফায়াজ কোথাও নেই। বারান্দার ডান পাশে একটা মেয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। আর বাম পাশে দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। মেহের ফিরে এলো।
ফায়াজ সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে হাত ঝাড়ছে। মেহেরকে আসতে দেখে দ্রুত সরতে গিয়ে দরজার সাথে হাত লেগে কাটা জায়গায় নতুন করে ব্যথা পেয়েছে। সাদা ব্যান্ডেজের কিছু অংশ লাল হয়ে গেছে।

~ফ্ল্যাশব্যাক ~
ফায়াজ মেহেরের যাওয়ার পর পর গাড়ি স্টার্ট দেয়। মেহেরের শেষের কথাটা খুব লেগেছে। ফায়াজ গাড়ি চালাচ্ছে আর ভাবছে,
“এত ঘৃণা করো আমায় মেহের? আমার মৃত্যু কামনা করতে তোমার একটুকুও বাধঁল না। একটুও কষ্ট হলো না? আমি মরে গেলে তুমি খুব খুশি হবে?”
ফায়াজ স্টিয়ারিংয়ে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঘুষি মারল। ফায়াজের হাত ফেটে রক্ত পড়ছে। প্রচন্ড ব্যথা করছে কিন্তু সেদিকে ফায়াজের একদম খেয়াল নেই। কেননা মনের ব্যথাটা যখন প্রকট সেখানে শরীরের ব্যথা তুচ্ছ। ফায়াজ একের পর এক ঘুষি মেরেই যাচ্ছে। আর হাত থেকে রক্ত ঝড়ছে।
ফায়াজ ভার্সিটির ক্যাম্প থেকে নতুন করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে নিল। পুরো দিন মেহেরের সামনাসামনি হয় নি। আর হবেও না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

মেহের আসরের নামাজ আদায় করে মাথার ওড়না সরিয়ে বিছানায় বসে। আর তখনই মেহেরের ফোন বাজছে। মেহের ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেও ভুলে গেছে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই দেখল নাম্বারটা বিডির নয়। মেহের কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে ফোন রিসিভ করে সালাম দিল।
ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এলো,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাবি। আমি ফাইজা বলছি।”
মেহেরের মনে হচ্ছে ফাইজা ফায়াজের কোনো খোঁজ দিবে। কিন্তু না। ফাইজা তো কুশল বিনিময়ের ধাপ পাড় করছে না।
“ভাবি, একটা কথা বলব?”
মেহের আগ্রহের সহীত বলল,
“হ্যাঁ, বলো।”

“ভাইয়াকে ক্ষমা করে দেও না ভাবি। সত্যিটা জানার পর ভাইয়ার উপর আমার অনেক রাগ হয়েছিল। আমি বিশ্বাস করতে পারি নি ভাইয়া তোমার সাথে এটা করেছে। ভাইয়া নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। আর এটাও বুঝেছে ভাইয়া তোমাকে কতটা ভালোবাসে। আমি রোজ ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যেতাম। সব সময় মন-মরা হয়ে থাকত। ভাইয়া না বললেও আমি বুঝতে পারতাম তোমাকে মিস করছে। আমি তাই রোজ ভাইয়ার সঙ্গ দেওয়ার জন্য ওর ফ্ল্যাটে যেতাম।”
মেহের কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করল,
“ওর ফ্ল্যাটে মানে? তোমরা এক সাথে থাকো নি?”
“কি যে বলো ভাবি? ভাইয়া আমাদের সাথে থাকবে, তোমার কি তাই মনে হয়? ভাইয়া মমের সাথে থাকবে? ভাইয়া যে এতদিন ইতালি ছিল সেটাও তো মম জানতো না। ভাইয়া প্রায়ই আমার সাথে দেখা করতে ইতালি আসত। তাই এখানে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছিল। সেই ফ্ল্যাটেই একা থাকত। আমি যেতাম রোজ কথা বলতে, দেখা করতে। মমকে বলতে নিষেধ করায় মমকে আর জানাই নি। একবার তো দেখেছিলেই ভাইয়া কি রিয়েক্ট করেছিল। তাই ভয়ে আর জানাই নি।”
“তার মানে একা ছিল?”

“হ্যাঁ। একদিন তো এসে দেখি কি ভিষণ জ্বর। জ্বরে আবল-তাবল বকছে। তারপর দ্রুত জলপট্টি দিয়েছি। বারবার তোমার নাম করছিল জ্বরের ঘোরে। কি সব বলছিল। তখনই বুঝতে পারলাম ভাইয়া তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তারপর সে ছুটে গেল তোমার কাছে।”
মেহের চুপ করে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না।
ফাইজা আবারও বলল,
“দুদিন ধরে ভাইয়ার সাথে কথা হয় না। লাস্ট যেদিন কথা হয়েছিল ভাইয়া বলল তুমি নাকি পাত্তা দিচ্ছো না। প্লিজ ভাবি তোমরা দুজন আবারও এক হয়ে যাও। আমার অধিকার নেই তোমাকে জোর করার। আর তাছাড়া ভাইয়া যা করেছে আমার সাথে এমন হলে আমিও মেনে নিতে পারতাম না। তবুও বলছি ভেবে দেখো।”
মেহেরের মুখে কথা ফুটল,
“আচ্ছা ভেবে দেখব। তুমি ভালো থেকো।”

সামিরা ব্যাগ গুছানোতে ব্যস্ত। ওর নাচের দলের সাথে পার্লারে সাজতে যাবে। আজ ভার্সিটির প্রোগ্রাম। তাই ব্যাগে শাড়ি, অর্নামেন্ট সব গুছিয়ে রাখছে। হটাৎ চোখ যায় বিছানার উপর রাখা লাল শাড়ির দিকে। সামিরা কৌতূহল নিয়ে শাড়িটা খুলে।
সামিরা বিস্ময় নিয়ে মেহেরকে জিজ্ঞেস করল,
“এত সুন্দর শাড়িটা কার?”
মেহের আলতো হেসে বলল,
“আমার। কেমন? ”
সামিরার চোখে মুখে বিস্ময় ভাব নিয়ে বলল,
“অসাম। কে দিয়েছে? আন্টি?”
মেহের কি বলবে বুঝতে পারছে না। ফায়াজের নাম নিয়ে সামিরা কানের সামনে রেডিও বাজাতে থাকবে। মেহের তাই বলল,
“এছাড়া আর কে দিবে? মা-ই তো সব কিছু দেয় আমাকে।”
সামিরা বলল,
“হ্যাঁ তা ঠিক। তুই পরবি? ”

“হ্যাঁ। আমি তো আর তোদের সাথে নাচ করছি না। বাদ পড়ে গেছি। তোরা সবাই শাড়ি পরবি আর আমি পরব না তা হয়? তাই আমিও ঠিক করেছি তোদের সাথে শাড়ি পরব। হোক অন্য রকম।”
মেহের ফায়াজের জন্য শাড়ি পরবে। ফায়াজ যে ওর উপর রাগ করেছে বেশ বুঝতে পারছে। তাই শাড়ি পরবে।
মেহের শাড়ির সাথে হিজাব পরিধান করেছে। ফায়াজ যেমন চেয়েছিল ঠিক তেমন করে সেজেছে। সামিরা তার দলের সাথে ব্যস্ত। মেহের শুধু গান গাইবে। আর সেটাও ফায়াজের জন্য। সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর গান গাইবে না। কিন্তু ফায়াজের জন্য সে সিদ্ধান্ত পাল্টে নিয়েছে। মেহের এদিক সেদিক ঘুরছে কিন্তু ফায়াজের দেখা নেই। বুঝতে পারছে না কোথায় আছে। আর এসেছে কি না। কাকে জিজ্ঞেস করবে তাও বুঝতে পারছে না। ফায়াজের বন্ধুদের কাছে জিজ্ঞেস করলেও জানা যায় কিন্তু মেহের সেটা করবে না। ফায়াজ জানতে পারলে কি ভাববে। প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে অনেকক্ষন। কিন্তু ফায়াজকে একবারো দেখে নি। মেহেরের নাম এনাউন্স করা হবে কিছুক্ষণের মধ্যে গানের জন্য। কিন্তু মেহেরের ইচ্ছে করছে না।
ফায়াজকে না দেখতে পেয়ে ভালো লাগছে না।
মেহের আর না পেরে ফায়াজের বন্ধু তুষারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু আমতা আমতা করছে। কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
তুষার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,
“ফায়াজের খোঁজ করছো?”
মেহের জোরপূর্বক হেসে বলল,
“না মানে..!”
তুষার মন খারাপ করে বলল,
“ফায়াজ আসে নি। ও অসুস্থ তাই।”

অসুস্থের কথা শুনে মেহেরের বুক ছ্যাত করে উঠল। সেদিন ফায়াজকে একটা অলুক্ষণে কথা বলেছিল। আর সেজন্য কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মেহেরের চোখ ছলছল করছে। মেহের কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেল। স্টেজের সামনে যেতেই শুনতে পেল ওর নাম এনাউন্স করেছে আর সামিরা ওকে খোঁজছে।
সামিরা মেহেরের সামনে এসে বলল,
“এই মেহের, কোথায় গায়েব হয়েছিস? তোর নাম এনাউন্স করা হয়েছে।”
মেহের প্রতিউত্তরে বলল,
“আমি গান গাইবো না। আমি ফায়াজের বাড়িতে যাচ্ছি। উনি অসুস্থ।”
মেহের যেতে নিলে সামিরা ওর হাত চেপে ধরে বলল,
“পাগল হয়েছিস? আগে গান শেষ কর তারপর যা। আর ফায়াজ ভাই অসুস্থ তাতে তোর কি?”
মেহের চুপ করে গেল। ওদের কি করে বলে ফায়াজের জন্য ওর চিন্তা হচ্ছে।
“শোন, মানবতা বলেও একটা কথা আছে। আমি সেজন্য যাচ্ছি। তোরা বলিস আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি তাই চলে যাচ্ছি।”
মেহের সামিরাকে কিছু বলতে না দিয়েই চলে গেল।

মেহের ফায়াজের বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকতে পারছে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। একজন সার্ভেন্ট মেহেরকে দেখে হাসি মুখে দৌড়ে এল।
“মেম, আপনি? আসুন আসুন ভেতরে আসুন।”
মেহের সৌজন্যতার হাসি হেসে বলল,
“না মানে.. আসলে আমি ভেতরে যাচ্ছি। কিন্তু ফায়াজ কোথায়?”
“স্যার পুলসাইটে।”
মেহের কথা না বাড়িয়ে পুলের কাছে চলে গেল।
ফায়াজ হাঁটু অবধি প্যান্ট তুলে পা ভিজিয়ে বসে আছে। আর আনমনে কি জানি ভাবছে। মেহের ওকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে বলল,
“আপনার কি হয়েছে?”
ফায়াজ আচমকা মেহেরের কন্ঠ শুনে চমকে যায়। দ্রুত ঘুরে তাকায়। মেহেরকে এখানে একদমই আশা করে নি।
“তুমি!!”
“হ্যাঁ, তুষার ভাইয়া বলল আপনি অসুস্থ।”
ফায়াজ ভ্রু কুচকে বলল,
“অসুস্থ! ”
ফায়াজ তারপর ভাবল তুষার হয়ত ইচ্ছে করে বলেছে। ফায়াজ মেহেরের চিন্তিত মুখ দেখে বলল,

“আমি অসুস্থ তাতে তোমার কি? তুমি ছুটে এসেছো কেন?”
মেহের দমে গেল। তারপর কাচুমাচু করে বলল,
“মানবতার খাতিরে।”
ফায়াজ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“দেখা শেষ। এইবার যেতে পারো।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে ভাবছে চলে যাবে না দাঁড়িয়ে থাকবে। চলে যাওয়া উচিত। না গেলে যদি ফায়াজ রাগ করে। কিন্তু মেহেরের তো যেতে ইচ্ছে করছে না। ওর তো ফায়াজের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। মেহেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে টান দিল। সাথে সাথে মেহের চিতকার করে উঠল।
“আমি পড়ে যাব। পড়ে গেলে ডুবে যাব। আমার ভয় করে। আমি সাঁতার জানি না।”
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে তবুও নিজের পাশে বসিয়ে দিল।
“আমি থাকতে তোমার ভয় কিসের? তুমি পড়বে না। আমি আছি না। আর পড়ে গেলে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকব?”
মেহের ফায়াজের পাশে ভয় নিয়ে চুপ করে বসে আছে। সাঁতার না জানায় ভয় লাগছে কিছুটা।
ফায়াজ পানি থেকে পা তুলে বলল,
“আজকে না তোমার গান আছে।”
“ছিল তবে গাই নি। চলে এসেছি।”
“কিভাবে চলে এলে?”

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২৫

“সামিরাকে বলতে বলেছি আমি অসুস্থ তাই অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে গেছি।”
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে হাসছে মুচকি মুচকি৷
“মানুষ কখন মিথ্যা বলে জানো?”
মেহের বোকার মতো প্রশ্ন করল,
“কখন?”
ফায়াজ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“প্রেমে পড়লে মেহেরজান, প্রেমে পড়লে।”
মেহের চোখ বড়বড় করে তাকাল ফায়াজের দিকে। ফায়াজ পানিতে আবারও পা ভিজিয়ে হাসছে।

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.