শেষ পাতায় তুমি পর্ব - Golpo bazar

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩০ || তোমাতেই মত্ত্ব

শেষ পাতায় তুমি

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩০
ফাবিহা নওশীন

ফায়াজ মেহেরকে এক পাশে দাঁড় করিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“তুমি এখানে দাঁড়াও।”
মেহের চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। ফায়াজ রবিনের দিকে আগাচ্ছে। ফায়াজের চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে সেই আগুনে সামনের সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে। রবিনও চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে মুখে ভয়ের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না।
ফায়াজ ওর কলার ধরে বলল,
“তুই নিজেও জানিস না তুই কি করেছিস। কত বড় ভুল করেছিস। জানলে তোর কলিজা কেঁপে উঠত এই কাজ করতে। তুই ফায়াজের কলিজায় হাত দিয়েছিস। বড় ভুল করে ফেলেছিস।”
ফায়াজ রবিনের কলার চেপে ধরেছে আর রবিনও কম যায় না। রবিনও ফায়াজের কলার চেপে ধরেছে।
“কি করবি তুই? হাহ!”
ফায়াজ ঘাড় কাত করে আবার সোজা করে ওর কলার ছেড়ে দিয়ে মৃদু হাসল। রবিন অবাক হয়ে ওর কান্ড দেখছে। ফায়াজ হটাৎ করে ওর নাক বরাবর ঘুষি মারল। রবিন আচমকা আক্রমণে তাল সামলাতে না পড়ে ছিটকে সরে যায়। ফায়াজ ওকে সুযোগ না দিয়ে তুলে ধরে দেয়ালে অনবরত ওর মাথা বাড়ি মারছে। মেহের ভয়ে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

ফায়াজ রবিনকে গালিগালাজ করছে আর মারছে। কিন্তু সে সুযোগ বেশী সময় পায় নি। পুলিশ চলে এসেছে। রবিনকে পুলিশ জোর করে ফায়াজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়।
রবিন পুলিশের সাথে যেতে যেতে বলল,
“পুলিশ আমাকে বেশী দিন আটকে রাখতে পারবে না। আমি বের হয়ে আসব।”
ফায়াজের বন্ধুরা ওকে চেপে ধরে আছে। ফায়াজ তবুও বলল,
“শালা তুই বের হ। তারপর তোকে আমি কেটে কুটিকুটি করব। তোর চোখ তুলে নিব। তুই মেহেরের দিকে নজর দিয়েছিস।”
রবিন আর রবিনের সাথের ছেলেদের পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ফায়াজ প্রথমে ভেবেছিল হিমি কিছু করেছে। তাই ও ওর বন্ধুদের নিয়ে হিমির কাছে যাচ্ছিল। আর তখনই কেউ একজন ওকে ফোন করে। রবিনের দলে ওর একজন ইনফর্মার আছে। যে কি না রবিনের গতিবিধি লক্ষ্য রাখে। সন্দেহজনক কিছু হলে ফায়াজকে জানায়। ও ফায়াজকে জানিয়েছে মেহেরের কথা আর মেহেরের লোকেশন জানায় যার ফলে খুব শীঘ্রই মেহেরকে খোঁজে পায়।
ফায়াজের বন্ধু তুষার ওকে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

“ভাই, এ-সব বাদ দে। ভাবীকে দেখ। কেমন ভয় পেয়ে আছে।”
ফায়াজ রবিনের ব্যাপারটা ছেড়ে মেহেরের দিকে নজর দিল। ফায়াজের রাগ লাগছে কারণ ও রবিনকে মন মতো ধোলাই করতে পারে নি। রবিনকে মেরে তৃপ্তি মিটে নি। ফায়াজ মেহেরের সামনে যায়। মেহের তখনও ফুপাচ্ছে।
ফায়াজ মেহেরের দুবাহু ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“দেব ঠাটিয়ে এক চড়? তোকে বলেছিলাম পাকনামি করতে? এত তেজ কেন তোর? তুই এত নির্বোধ কেন? ঘটে কি ছিটেফোঁটা বুদ্ধি নেই? গাধা একটা।”
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সামনে এভাবে অপমান করছে সেটা মেহেরের বড্ড লাগছে। মেহেরের কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে যাচ্ছে। ফায়াজের আরো রাগ লাগছে। তাই ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ! কাঁদলে একদম মেরে ফেলব।”
মেহের সাথে সাথে কান্না থামিয়ে দিল। ফায়াজের বন্ধুরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে এক এক করে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ফায়াজ আবারো মেহেরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মেহের শান্ত হয়ে গেল।
“তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো? তুমি জানো আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম?”
মেহের শান্ত হয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না।

ফায়াজ মেহেরকে পানির বোতলের খাপ খুলে এগিয়ে দিল। মেহের কাঁপা কাঁপা হাতে বোতল নিল। মেহেরের ভয়টা কাটে নি। তাই শরীরের কাঁপুনি কমছে না। মেহের পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিল। এক হাতে তখনও হিজাব ধরে রেখেছে।
ফায়াজ নিজের ফোনটা বের করে বলল,
“আমি ক্যামেরা অন করে তোমার সামনে ধরছি। হিজাবটা ঠিক করে পরে নেও।”
মেহের মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। ফায়াজ ওর সামনে ফোনের ক্যামেরা অন করে ধরল। মেহের একে একে হিজাবের পিনগুলো খুলে পাশের টেবিলের উপর রাখছে। তারপর পুরো হিজাবটা খুলে ফেলল। হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে চুল বেঁধেছিল চুলগুলো খুলে খুলে গেছে। মেহের চুলগুলো একেবারে খুলে ফেলল। মেহের সব সময় হিজাব পরে তাই এতদিন মেহেরের চুল দেখার সৌভাগ্য হয় নি। মেহেরের পিঠের নিচ অবধি চুলগুলো কোমড় ছাড়িয়ে গেছে। মেহেরকে এভাবে দেখে বেশ মোহনীয় লাগছে। ফায়াজ ছোট খাটো ঢোক গিলল।
মেহের চুলের খোঁপা করে হিজাব পরে নিল। ফায়াজের হাত ব্যথা হয়ে গেছে ফোন ধরে রাখতে রাখতে।

ফায়াজ ফোন পকেটে রাখতে রাখতে বলল,
“তুমি আমার সাথে বাড়িতে যাবে।”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“আমি হোস্টেলে যাব। হোস্টেলে না ফিরলে অথোরিটি মা কে ফোন করে বলবে আমি হোস্টেলে ফিরি নি। তখন মা চিন্তা করবে খুব। আর আমি যদি বলি আপনার বাড়িতে আছি তাহলে মা রাগ করতে পারে। বাবা উপর নারাজ আর মা-ও যদি নারাজ হয় তাহলে মানতে পারব না।”
“কিন্তু আমি তোমাকে একা ছাড়তে পারব না।”
“হোস্টেলে থাকব। একা কই?”
ফায়াজ আর কথা বাড়াল না। মেহেরকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল। মেহেরকে হোস্টেলে পৌছে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসল। ফায়াজের ভালো লাগছে না মেহেরের চলে যাওয়া।
মেহের ফ্রেশ হয়ে এলো। ওর ভয়টা এখনো কাটেনি। আজ ওর জীবনের সব চেয়ে ভয়ানক দিনটা কেটেছে।
এমন দিন জীবনে যাতে দু’বার না আসে তাই দোয়া করছে। এশার নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে অসংখ্য শুকরিয়া আদায় করল। নিজের সম্মানের হেফাজত কামনা করল। নামাজ পড়ে মনটা একটু শান্ত লাগছে। মেহের জায়নামাজ রেখে জানালা খোলে দিল। খোলা হাওয়া প্রয়োজন। ওর মনে নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। ফায়াজ কি করে জানল ও কোথায় আছে আর ওকে কি করে খোঁজে পেল?
মেহের জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই একটা গাড়ি দেখল আর গাড়ির উপর একজন বসে আছে। মেহের ভালো করে দেখল এটা ফায়াজ।
“ফায়াজ এখনও এখানে বসে আছে?”
সামিরা ওর পেছনে এসে দাঁড়াল।

“ফায়াজ ভাই সেই কখন থাকে এখানে বসে আছে। এখানে কতক্ষণ বসে থাকবে? ভাইয়াকে একটা ফোন কর।”
মেহের ফোন এনে ফায়াজকে ফোন করল। ফায়াজ ফোনে মেহেরের নাম দেখে উপরের দিকে তাকাল। জানালার পাশে কাউকে দেখতে পেল। নিশ্চয়ই মেহের। ফায়াজ কল রিসিভ করে বলল,
“কি হয়েছে মেহের? কোনো সমস্যা?”
মেহের শুকনো মুখে বলল,
“না ঠিক আছি। কোনো সমস্যা নেই। আপনি এখানে কি করছেন?”
“কিছুনা। এমনিতেই বসে আছি।”
মেহের বুঝতে পারছে ফায়াজ ওর জন্য টেনশন করছে।
“আমি হোস্টেলে আছি। আর ওদের তো পুলিশ নিয়ে গেছে। তাহলে টেনশন করছেন কেন?”
ফায়াজ কি বলবে, কি করে বলবে ওর মন অশান্ত হয়ে আছে।
“ভয়, টেনশন কোনোটাই পাচ্ছি না। আমি এমনিতেই বসে আছি।”
“বসে থাকতে হবে না। আপনি বাড়িতে চলে যান। সারাদিন খাওয়া দাওয়া নেই। বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে রেস্ট নিন।”
“কিছুক্ষণ পরে চলে যাব।”
“ফায়াজ, প্লিজ। চলে যান। রাতের বেলায়…
ফায়াজ ধমকে উঠল,
” চুপ করো। তোমার কোনো সমস্যা আমার বসে থাকায়? তুমি নিজেও যাবে না আমার সাথে আবার আমাকেও থাকতে দিবে না। আমি থাকব। যতক্ষণ ইচ্ছে থাকব।”

ফায়াজ খট করে ফোন কেটে দিল। মেহের অসহায় ফেস করে নাক ফুলিয়ে তাকাল। সামিরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেটে দিয়েছেন। সাথে ধমকি দিয়েছেন।”
মেহের নিচের দিকে একবার তাকিয়ে জানালা বন্ধ করে দিল।
রাত ১১টা। মেহের বিরক্তি নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ তখনও বসে আছে। যায় নি। সামিরাও দাঁড়িয়ে আছে ওর সাথে। সামিরা মাথা চুলকে বলল,
“ফায়াজ ভাইয়ের বন্ধুকে ফোন করি। উনি ফেসবুকে এক্টিভ আছেন। উনারা এসে ফায়াজ ভাইয়াকে নিয়ে যাক।”
সামিরা ফায়াজের বন্ধুকে সব জানাল। ওরা সাড়ে ১১টা নাগাদ সেখানে পৌছাল। তারপর ফায়াজকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেল। ফায়াজ গাড়িতে বসে আছে। মেহেরকে ফোন করল। মেহের ফোন রিসিভ করতেই বলল,
“তুমি ভয় পেও না। যদি কোনো সমস্যা হয় আনাকে ফোন করবে। আর একদম ভয় পাবে না। তুমি একদম সেইফ আছো। আমি সকালে তোমাকে নিতে আসব। ভয় পাবে না কিন্তু। ওকে?”
মেহের বুঝতে পারছে না ফায়াজ ওকে বলছে না কি নিজেকে শান্তনা দিচ্ছে।
“আচ্ছা আপনি বাড়িতে যান। সমস্যা হলে ফোন করব।”
“আচ্ছা। সাবধানে থেকো।”

ফায়াজ ফোন কেটে ওর বন্ধুকে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থামাতেই ফায়াজ গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজ চোখের পানি মুছছে। ও কেন বের হয়ে গেল সেটা দেখতে তুষার বের হলো।
তুষার ওর কাছে যেতেই দেখল ফায়াজ চোখের পানি মুছছে। এই প্রথম ফায়াজকে কাঁদতে দেখছে। তুষার ওর কাঁধে হাত রাখতে ফায়াজ ওকে জড়িয়ে শব্দ করে কাঁদছে।
“ফায়াজ কি করছিস? কাঁদছিস কেন? মেহের তো ঠিক আছে এখন।”
“যদি মেহেরের কিছু হয়ে যেত? আমি কি করে বাঁচতাম বলতে পারিস? আমার হাত-পা এখনো কাঁপছে। আমার মন এখনো অশান্ত হয়ে আছে। ঝড় বইছে ওই ঘটনা মনে পড়তেই বুক কেঁপে উঠছে৷”
ফায়াজ তুষারকে ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে চিতকার করে কাঁদছে। তুষার ওকে থামানোর চেষ্টা করছে না।
“কাদ ফায়াজ তুই। কেঁদে নিজের অতীত মুছে দে। ভালোবেসে ভালো ভাবে বাঁচ।”

ফায়াজ সেই ভোর থেকে মেহেরের হোস্টেলের সামনে গাড়ি নিয়ে বসে আছে। মেহের গেট দিয়ে বের হতেই ফায়াজ গাড়ি থেকে বের হয়ে শুকনো মুখে গাড়ির দরজা খুলে দিল। মেহের কোনো কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসে। ফায়াজের চুল এলোমেলো। চেহেরা ফ্যাকাসে। চোখগুলো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। সারারাত ঘুমায় নি বুঝাই যাচ্ছে।
মেহের ফায়াজকে বারবার কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারছে না। ভার্সিটির গেটে পৌছাতেই ফায়াজ টিফিন বক্স খুলে মেহেরকে দিল আর নিজেও নাস্তা করে নিল।
মেহের গাড়ি থেকে নেমে ফায়াজের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“আপনি আমার খোঁজ পেলেন কিভাবে?”
“লোক ছিল জানানোর।”
“কিন্তু ওরা আমাকে কেন?”
“আসলে আমি যাকে মেরেছিলাম তার বন্ধুর কোনো এক ভাই হয় রবিন। রবিন আমার উপর প্রতিশোধ নিতে তোমাকে…!”
মেহের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ২৯

“আচ্ছা। যা ভেবেছিলাম। আপনি পাপ করবেন আর আমাকে সেই পাপের ফল ভুগতে হবে? আপনি যা খুশি করে বেড়াবেন তার দায় আমি কেন নেব? আমার দোষটা কোথায়? ওরা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। যদি আমার কিছু হয়ে যেত? তার দায় কে নিত? বলুন? উত্তর দিন। আমি আপনার স্ত্রী তাই বলে আমাকে আপনার অন্যায়ের শাস্তি পেতে হবে? আপনি মারামারি করবেন, মেরে মাথা ফাটিয়ে ফেলবেন। তার তো কিছু প্রতিদান দিতেই হবে। আর তার প্রতিদান আমি দেব? আপনি কখনো বদলাবেন না তাই না?”
ফায়াজ মেহেরের কথার উত্তর দিল না। সারা-রাত ঘুমায় নি। শরীর ক্লান্ত লাগছে খুব। মাথাটাও ধরেছে খুব।

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.