শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩১
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩
ফাবিহা নওশীন
মেহের ক্লাসে বসে কলমের খাপ কামড়াচ্ছে। স্যার লেকচার দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসে মন বসাতে পারছে না। এই মূহুর্তে ওর অবাধ্য মনটা ফায়াজের কাছে পড়ে আছে। বারবার শুধু এটাই ভাবছে,
“ইশশ! একটু বেশীই বলে ফেলেছি। ফায়াজ নিঃশব্দে চলে গেল কোনো কথা না বলে। কিছুই বলল না। রিয়েক্ট করল না কেন? নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। উফফ… মেহের! তুই অসহ্য। এমনিতে কথা বলিস না আর যখন বলিস আর থামিস না।”
ক্লাস শেষ হতেই মেহের ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে গেল। ফায়াজকে ফোন করতে চেয়েও করল না। সামনাসামনিই কথা বলতে চায়।
ফায়াজ ওর বন্ধুদের সাথে যেখানে সব সময় থাকে সেখানে ওকে পাওয়া গেল না। সেখানে ওর বন্ধুরা আছে কিন্তু ও নেই। মেহের দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফায়াজকে এত মানুষের ভীড়ে খোঁজে যাচ্ছে। তুষার মেহেরকে এভাবে এদিক সেদিক চেয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে এগিয়ে এল।
“কাউকে খুঁজছ?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“ইয়ে মানে ফায়াজকে। উনি কোথায়?”
তুষার এক সেকেন্ড থমকে বলল,
“ওহ! ও কোথায় যেন গেছে। আমি ভেবেছি তোমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বেড়িয়েছে? কিন্তু কোথায়? আমি তো কিছুই জানি না।”
“আমিও জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। ভেবেছি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছে।”
ওর কথা শুনে মেহের হতাশ হলো। তারপর বলল,
“মুড কি অফ ছিল?”
তুষার আলতো হেসে বলল,
“তা তো থাকবেই। গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।”
মেহের অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে নিল। তারপর বলল,
“আসলে আমিও অনেক কথা শুনিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। যে কথায় কথায় ধমক দেয় সে আমার কথার প্রতিউত্তরে একটা কথাও বলে নি। তাই মনটা কেমন করছে।”
তুষার মেহেরের কথা শুনে চিন্তিত হলো। ভাবছে ফায়াজ কি তাহলে মেহেরের উপর রাগ করে কোথাও চলে গেল?
“আমি কি জানতে পারি কি বলেছো?”
মেহের মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকাল। তারপর থমথমে মুখে সবটা খুলে বলল।
সবটা শুনে তুষার গম্ভীরমুখে বলল,
“কাজটা ঠিক করো নি মেহের। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছো। ও যখন খুব কষ্ট পায় তখন কোনো রিয়েক্ট করে না। চুপচাপ দূরে সরে যায় সবার থেকে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে মেহের। তুমি কি এটা বুঝতে পারছো না? ওর পাগলামি গুলো, ওর ভালোবাসা গুলো তোমার চোখে পড়ে না কিন্তু বাকি সব পড়ে। তুমি জানো গতকাল রাতে ও চিতকার করে কেঁদেছে। শুরু তোমার জন্য, পাগলের মতো করেছে। ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেখি নি এত বছরে। তোমাকে হারানোর ভয়ে ও আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তোমাকে না পেয়ে কি পরিমাণ ছটফট করেছে আমরা দেখেছি। এভাবে পায়ে ঠেলে দিও না। হারিয়ে গেলে কাঁদবে খুব।”
তুষার এইটুকু বলে চুপ করে গেল। মেহের মাথা নিচু করে নিল আবারও।
তুষার আবারো বলতে শুরু করল,
“আর ও ওই ছেলেকে কেন মেরেছে? কারণ ছেলেটা তোমাকে রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে নামতে দেখত। আর তোমাকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে খুবই বাজে একটা কথা বলেছে। আমি তোমাকে বলতে পারছি না। ফায়াজকে জিজ্ঞেস করে নিও। আর এটা ফায়াজ সহ্য করতে পারে নি। ছেলেটা জানে না তুমি ওর ওয়াইফ। কিন্তু তুমি ওর ওয়াইফ হও বা অন্য কিছুই হও তোমাকে বাজে কথা বলার অধিকার কারো নেই তাই না?”
মেহের চুপ করে আছে। সব ঘটনা যে ওকে ঘিরে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। ফায়াজও তো কিছু বলে নি।
তুষার আবারো বলল,
“তোমাদের সমস্যা কি জানো? যদি স্বামী স্ত্রীর অপমানের জবাব দেয় তবে সে গুন্ডা আর যদি চুপচাপ হজম করে নেয় তবে সে কাপুরুষ। তাই না? বেশী ভালোবাসলে বিরক্ত হয়ে যাও আর না ভালোবাসলে গলা শুকাও। তোমাদের বুঝার ক্ষমতা আমাদের পুরুষের নেই।”
তুষার হনহন করে চলে গেল। মেহের থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ কোথায় গেল?
মেহের গেট বরাবর দোতলার বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ কখন ঢুকবে।
দীর্ঘ সময়ের পর মেহেরের অপেক্ষার অবসান ঘটল। মেহের এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে ফায়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেহের হাপানির রুগীর মতো হাপাচ্ছে। এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামায় দম নিতে পারছে না।
ফায়াজের হাতে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। পানি খেয়ে ছিপি বন্ধ করছিল আর তখনই মেহেরের দিকে চোখ যায়৷ মেহের কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
ফায়াজ পানির বোতল মেহেরের দিকে এগিয়ে দিল। মেহের ফায়াজের দিকে এক পলক তাকাল। মুখ গোমড়া করে পানির বোতল দিচ্ছে। মেহের পানির বোতল নিয়ে একটু মুখে দিয়ে ফায়াজকে ফেরত দিল। ফায়াজ বোতল নিয়ে মেহেরকে এড়িয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। মেহের ফায়াজের পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ দাঁড়িয়ে যায় সাথে সাথে মেহেরও দাঁড়িয়ে যায়।
মেহের কাচুমাচু করে বলল,
“আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? ”
ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু যোগল প্রসারিত করে বলল,
“একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভিষণ সুন্দরী। ভাবছি বিয়ে করে ফেলব। কতদিন আর একা থাকব?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে টাস্কি খেল। সরু সরু চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত বলল,
“আপনি বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না বুঝার ভঙ্গিতে বলল,
“কেন?”
মেহের নাক ফুলিয়ে বলল,
“কারণ আপনি বিবাহিত। বিবাহিত হয়ে বিয়ে করবেন কি করে?”
ফায়াজ না জানার ভান করে বলল,
“বিয়ে! আমি আবার বিয়ে কবে করলাম? কি বলো এ-সব?”
ফায়াজ পানির বোতল মাঠে ঘাসের উপর রেখে আবারো সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মেহের স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল,
“আমি আপনার নামে মামলা করব। আপনি বিয়েটাকে অস্বীকার করছেন।”
ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর পেছনে ঘুরে ধীরপায়ে মেহেরের সামনে গিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
“প্রমাণ আছে? বিয়ের কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?”
মেহের নখ কামড়ে ভাবছে,
“আসলেই তো আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। না কোনো কাগজ আর না বিয়ের কোনো পিক আর না সাক্ষী। এখন কি করব?”
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঠোঁট বাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মেহেরের গা জ্বলে যাচ্ছে। নাক সরু করে ফুসফুস করছে।
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে বলল,
“চলো।”
মেহের অবাক হয়ে বলল,
“কোথায়?”
“বাড়ে… মামলা করবে না? মামলা করতে থানায় যেতে হবে। নাকি অনলাইনে মামলা করবে?”
ফায়াজ আবারও মুচকি মুচকি হাসছে। মেহের আবারও ফুসফুস করছে। ফায়াজ পাত্তা না দিয়ে মেহেরের হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিল। তারপর ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দিল।
কিছুক্ষণ পরে মেহেরের খেয়াল হলো ফায়াজ ওর বাড়ির রাস্তায় যাচ্ছে। তার মানে মেহেরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফায়াজ কোনো কথা বলছে না। তবে মেহেরের চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে বলল,
“আমার পছন্দের মেয়েকে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
মেহের আবারও ফায়াজের দিকে তাকাল। চোখ টলমল করছে। ফায়াজ মেহেরের চোখের দিকে তাকাল। মনে মনে বলছে,
“বালিকার মনের আকাশে মেঘ জমেছে। যেকোনো সময় বর্ষণ হবে। আর সেই বর্ষণে আমি ভিজে একাকার হব। উফফ..!! এখন আমি ভিজতে চাই না। এখন তো আমি আমার ক্লান্তি দূর করতে চাই।”
ফায়াজ বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে বের হলো। তারপর মেহেরকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল। মেহের চুপচাপ ওর কাণ্ড দেখছে।
ফায়াজ মেহেরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মেহের কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ ওর হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। তারপর বলল,
“ঘুম পাচ্ছে খুব। অনেক টায়ার্ড আমি। তুমিও তো গতকাল রাতে ঘুমাও নি। ”
মেহের ভাবছে,”আসলেই তো আমিও ঘুমাতে পারি নি। আর সামিরাকেও ঘুমাতে দেই নি। বেচারি আমার জন্য ঘুমাতে পারে নি।”
ফায়াজ মেহেরের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেহেরের দিকে ঝুকে গেল। মেহের ফায়াজকে ঝুকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। ফায়াজ আচমকা মেহেরকে নিজের বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মেহেরের মুখ তুলে কপালে ঠোঁট ছুইয়ে মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
কিছু মুহুর্ত পরে বুকে উষ্ণ পানি অনুভব করল। মেহের কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ফায়াজ জানতে চায় না। অনেক হয়েছে আর না। নিজের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত কেন হবে? মেহেরের যদি ভালো না লাগে না লাগবে। ফায়াজ আর ভাবার সময়ও পেল না। দুচোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। ক্লান্তি ভর করেছে চোখের পাতায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ বুজে এল। মেহের নিজের
পিঠে ফায়াজের হাতের শক্ত বাঁধন অনুভব করলেও মাথায় হলকা অনুভব করতেই মাথা তুলে ফায়াজের মুখের দিকে তাকাল। ফায়াজ ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর লাগছে। মেহের আস্তে আস্তে হাত তুলে ফায়াজের চুলে হাত দিল। কত ইচ্ছে ছিল এই চুলগুলো ছোয়ার। মেহের ফায়াজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবারো ফায়াজের বুকে মুখ গুজে দিল।
মেহের সুখের কান্না কেঁদেছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। এটা ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।
কিছুক্ষণের মধ্যে মেহেরও ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকেল ৫টা। মেহের ঘড়ির সময় দেখে চমকে গেল। ১টার দিকে ঘুমিয়েছে। আর এখন ঘুম ভাঙল। আজ নামাজও পড়া হয় নি। ফায়াজও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেহের ফায়াজের ঘুম ভাঙতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে উঠে বিছানা ছাড়ে। ফায়াজ নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। মেহের ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নিল। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাল। নিজের ঘর, নিজের সংসারে কেমন ছন্নছাড়া ভাব। মেহের উপরে এসে কফির কাপ রাখল। ফায়াজ উঠছে না। ফায়াজ অনেক ক্লান্ত ছিল। তাই ঘুমটা প্রয়োজন। মেহের হোস্টেলে ফেরার জন্য রেডি হয়ে নিল। পা টিপে টিপে ফায়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজকে দেখে লোভ লাগছে কেমন। মেহের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই লিপস্টিক পেয়ে গেল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে ফায়াজের কাছে গিয়ে ধীরে ধীরে কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ফায়াজের দিকে আরেকবার তাকাল।
ফায়াজের ঘুম ভাঙতেই ফায়াজ মেহেরের খোঁজ করছে। না পেয়ে ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে ৬টা বেজে ৭ মিনিট।
“আরে বাস,,এত ঘুম দিয়েছি। মেহের কই?”
ফায়াজ ফোনের স্কিনে মেহেরের নাম দেখতে পাচ্ছে। মেহের মেসেজ পাঠিয়েছে।
“আমি চলে যাচ্ছি অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। রাগ করবেন না কিন্তু। আপনি এতটা প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। জাগাতে মন শায় দেয় নি। আমি একা যাই নি। আপনার গাড়ি নিয়ে গিয়েছি। ড্রাইভার আমাকে ভালো মতোই দিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। আমি হোস্টেলে পৌছে আপনাকে মেসেজ করে দেব। আর হ্যাঁ কফি বানিয়েছি। বেডসাইডে রাখা আছে। আর আরেকটা কথা আপনি আর কখনো বিয়ে করার কথা বলবেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব কান্না পায়। কেন পায় বলব না।”
পরের মেসেজ,”আমি পৌছে গেছি। আপনি কি এখনো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন?”
ফায়াজ হেসে ফেলল। তারপর উঠে বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে গেল। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাল। চোখ যেন কপালে। কপালে লিপস্টিক লেগে আছে। এর মানে মেহের ওর কপালে চুমু খেয়েছে। ফায়াজ মুচকি হাসল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখ গেল বেডসাইডের টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা মগের উপর। ফায়াজ পিরিচ সরিয়ে মগের কফির দিকে চেয়ে বলল,”উহু, এই কফি খাওয়া যাবে না। মুড খুব ভালো আছে। অফ করতে চাই না।”
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩০
তারপর আবার কি মনে করে চুমুক দিয়ে টাস্কি খেল।
“আরে বউ তো আমার দারুণ কফি বানায়।”
ফায়াজ পুরো কফি শেষ করে ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল মেহেরকে ফোন করতে।
ফোন বাজতেই মেহের ফোন রিসিভ করে নিল। ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেহের ফোন রিসিভ করে চুপ করে আছে। ফায়াজ ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনছে।
“তুমি আমাকে না বলেই চলে গেলে কেন?”
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল।” (নিচুস্বরে)
“আচ্ছা তাই? তুমি আমার কপালে কি করেছো?”
মেহের লজ্জা পেয়ে গেল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
“কই?”
“কই? দাঁড়াও জানেমন আগামীকাল তোমাকে পাই।”
“আমি ফোন রাখছি। আমার পড়া আছে।” মেহের দ্রুত ফোন কেটে দিল। ফায়াজ একা একাই হাসছে।