শেষ পাতায় তুমি পর্ব - Golpo bazar

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩২ || নাম না জানা এক পাখি

শেষ পাতায় তুমি

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩২
ফাবিহা নওশীন

“আমার সকল অভিযোগে তুমি
তোমার মিষ্টি হাসি টা কি আমি?
আমার না বলা কথার ভাঁজে
তোমার গানের কত সুর ভাসে।
তোমায় নিয়ে আমার লেখা গানে
অযথা কত স্বপ্ন বুনা আছে।
আমার হাতের আঙুলের ভাঁজে
তোমায় নিয়ে কত কাব্য রটে।
ভুলি নি তো আমি
তোমার মুখের হাসি
আমার গাওয়া গানে তোমাকে ভালোবাসি।”
ফায়াজ গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে মেহেরকে দেখছে আর ওর গান শুনছে। আর স্নিগ্ধ হাসছে। গানের মাধ্যমে মেহের তার সকল অভিযোগ, অনুরাগ, অভিমান, ভালোবাসা এক সাথেই গানের সুরে প্রকাশ করছে।
ফায়াজ গাড়ি থামাল ভার্সিটির গেটের সামনে।
তারপর মেহেরকে টেনে এনে থুতনিতে শক্ত করে চুমু খেল।
মেহের পেছনে থেকে হটপট বক্স নিতেই ফায়াজ কিছু একটা ভাবল। ওদিনের ঘটনা। সাগর নামের ছেলেটি মেহেরকে বাজে কথা বলেছে।
বলেছিল “মেহের রোজ ফায়াজের গাড়ি থেকে বের হয়। গাড়ি থামার প্রায় ১০-১৫মিনিট পরে গাড়ি থেকে নামে। ফায়াজের সাথে রাত রাটিয়ে সকালে ফায়াজের গাড়িতেই আসে। সারারাত থেকে মন ভরে না তাই ভার্সিটিতে এসেও সার্ভিস দেয়৷”এইসব আজেবাজে কথা বলছিল বন্ধুদের সাথে।
ফায়াজ নিজের নামে সমস্ত বাজে কথা মানতে পারলেও মেহেরের দিকে কেউ আঙ্গুল তুলবে সেটা মানতে নারাজ।
ফায়াজ বক্স গুছিয়ে বলল,
“চলো, আমরা ক্যান্টিনে বসে খাব।”
মেহের বুঝতে পারছে না আজ ফায়াজ কেন ক্যান্টিনে খেতে যাচ্ছে। কিন্তু ফায়াজকে কোন প্রশ্ন করল না। ফায়াজের পেছনে পেছনে চলে গেল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

ফায়াজ অডিটোরিয়াম থেকে মাইক্রোফোন এনে ক্যাম্পাসের মেইন চত্বরে হাজির বন্ধুদের নিয়ে। সব ব্যবস্থা শেষ এখন মেহেরকে ফোন করা বাকি। ফায়াজকে দেখে তুষার মুচকি মুচকি হাসছে।
ফায়াজ তুষারের হাসি দেখে বলল,
“তোর হাসি অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করছি।”
তুষার পালটা জবাব দিল,
“আমরাও অনেকক্ষণ ধরে তোর পাগলামি সহ্য করছি। ভাই তুই কি কাবির সিং এর নিউ ভার্সন হবি?”
ফায়াজ পকেটে হাত দিয়ে বলল,
“উহু, কাউকে ফলো করা আমার কাজ নয়। আমি ফায়াজ নওয়াজ খান আছি আর থাকব।”
ফায়াজ পকেট থেকে ফোন বের করে মেহেরকে ফোন করে ওর লোকেশন জানাল আর ৫ মিনিটের মধ্যে হাজির থাকার কথা বলল।
মেহের ৪ মিনিটের মাথায় হাজির। কিন্তু এখনো কি হচ্ছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। ফায়াজের দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
ফায়াজ মেহেরের দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে মাইক হাতে তুলে নিল।
“এটেনশন প্লিজ। আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।”
ওখানে অবস্থানরত সবার দৃষ্টি ওর দিকে। যারা দূরে ছিল তারাও কাছে এসে দাঁড়াল। ফায়াজ কি করছে মেহের বুঝতে পারছে না। যাই করুক মেহেরকে কেন ডেকেছে আর এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে কেন?
মুটামুটি অনেক মানুষ ভীড় জমিয়েছে। সবাই কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে। এতগুলো ছেলের সাথে ফায়াজের পাশে মেহেরকে দেখে ওদের কৌতূহল তরতর করে আরো বেড়ে গেল।

ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে নিজের সাথে দাঁড় করিয়ে বলল,
“সি ইজ মাই ওয়াইফ মেহের নওয়াজ খান। আমাদের বিয়ে হয়েছে ১বছর ৫ মাস+ কিন্তু সবাই সেটা জানে না। শুধুমাত্র কাছের কয়েকজন জানে। অনেকেই আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে না জেনে উল্টো পালটা কথা বলছে। দুজন মানুষের মধ্যে রত সম্পর্কের ধরণ না জেনে আজেবাজে কথা বলা অনুচিত। সাগড় নামের ছেলেটি মেহেরকে বাজে কমেন্ট করায় হসপিটালে আছে। আশা করি সবাই কেয়ারফুল থাকবেন। মেহেরকে টিচ করে কথা বলা কিংবা বাজে নজরে যে দেখবে আমি তার চোখ তুলে নিব। আমি আমার জিনিসের ভাগ কাউকে দেই না। যা আমার শুধুই আমার। জাস্ট এটুকুই বলার ছিল। এখন আপনারা যে যার কাজে মন দিন।”
ফায়াজ মেহেরকে ইশারা করে ক্লাসে যেতে বলল। মেহের চুপচাপ চলে গেল।
কয়েকদিন পরের কথা। সাগড় ছেলেটি হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে। ফায়াজ নিউজটা পেয়ে হাত দিয়ে চুল ব্রাশ করতে করতে বলল,
“ওকে আবারও হসপিটালে পাঠাব।”
ফায়াজের কথা শুনে ফায়াজের বন্ধুরা চমকে গেল। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। সবাই তুষারকে ইশারা করল। কারণ তুষার ফায়াজের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। রকমাত্র তুষারই ফায়াজকে তোয়াক্কা না করে নির্ভয়ে কথা বলতে পারে।

“ফায়াজ, তোর মাথায় আবার কি চলছে?”
ফায়াজ চুলে ব্রাশ করা থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ওকে মেরে হসপিটালে পাঠিয়েছি বলে রবিন মেহেরের দিকে হাত বাড়িয়েছে না, ওর জন্য শুধু ওর জন্য রবিন মেহেরকে টাচ করার সাহস পেয়েছে। তাই ওকে পার্মানেন্টলি হসপিটালে পাঠানোর ব্যবস্থা করব।”
“ফায়াজ তুই পাগল হয়েছিস? যা হয়েছে হয়ে গেছে। সব ভুলে যা। ও ওর কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছে। নতুন করে আর কিছু করিস না। এছাড়া মেহের যদি জানতে পারে তুই আবার মারামারি করেছিস তবে রাগ করবে।”
ফায়াজ চোখ গরম করে বলল,” সো? আমার এখন মেহেরকে ভয় করে চলতে হবে?”
তুষার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ফায়াজ তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস। এটাকে কি বলে জানিস? পাগলামি। তুই পাগলামি করছিস। ভালোবাসিস ঠিক আছে কিন্তু এত পাগলামি করবি?”
ফায়াজ আলতো হেসে বলল,
“তোদের মনে হচ্ছে আমি পাগলামি করছি? ওকে ফাইন। আমি পাগলামি করছি। পাগল হয়ে গেছি। দিওয়ানা হয়ে গেছি। যে ভালোবাসায় পাগলামি নেই সেটা ভালোবাসা হতে পারে না। যে প্রেমিক তার প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য, প্রেমিকার জন্য পাগলামি করে নি, আকুল হয় নি সে প্রেমিকই না। তার প্রেমিক হওয়ার যোগ্যতাই নেই। আর তোরাই তো একদিন আমাকে বলেছিলি পাগলামি না থাকলে সেটা নাকি ভালোবাসাই না। তাহলে আজ? আজ কেন পাগলামির বিরুদ্ধে যাচ্ছিস? আমি পাগলামি করব, যতদিন বেঁচে থাকব মেহেরের জন্য পাগলামি করব।”

“ওকে ভাই করিস। কিন্তু তুই তো চাস মেহেরও তোকে ভালোবাসুক। কিন্তু তুই একের পর এক ঘটনা ঘটালে ও তোর থেকে ক্রমাগত দূরে চলে যাবে।”
“কিন্তু আমি ওই ছেলেকে আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখতে পারব না।”
“ওকে ফাইন। সে ব্যবস্থা আমি করছি। ওকে ভার্সিটি থেকে বরখাস্ত করার ব্যবস্থা করছি। এছাড়া আমার মনে হয় না ও আর তোর সামনে আসার সাহস করবে। ভয় পেয়েছে খুব।”
“সামনে যেন না আসে। ওকে আমি সামনে পেলে শেষ করে ফেলব।”

আরো কয়েকদিন পরের কথা। মেহের হোস্টেল থেকে বের হয়ে তুষারকে দেখতে পেল। তুষারের চোখমুখ ফুলে আছে। কেমন এলোমেলো লাগছে।
মেহের আনমনে ভাবছে,
তুষার এখন এখানে কি করছে? আর ফায়াজ কোথায়? ফায়াজকে তো দেখতে পাচ্ছি না।
তুষার মেহেরের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“ফায়াজ একটা কাজে গেছে। ও আসতে পারবে না। তাই আমাকে বলেছে তোমাকে যেন ভার্সিটি নিয়ে যাই। তোমার খেয়াল রাখি।”
মেহেরের কাছে কথাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। ফায়াজের সাথে গতকাল রাতেও কথা হয়েছে। তখন তো কিছু বলে নি। এছাড়া সকালেও একটা ফোন করে নি। হুট করে বন্ধুকে পাঠিয়ে দিয়েছে? এছাড়া তুষারকেও কেমন লাগছে। আহত মনে হচ্ছে। মেহের ফোন বের করে ফায়াজের নাম্বারে ডায়েল করল। কিন্তু ফোন অফ।

মেহের তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হুট করে কোথায় গেছেন উনি? আর ফোন অফ কেন?”
“হটাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ পড়ে গেছে। তাই আমাকে সকালে বলেছে। ফোন অফ কেন সেটা আমি বলতে পারব না।”। তুষার বিষন্ন মনে বলল।
মেহের অভিমানী কন্ঠে বলল,
” আপনাকে বলতে পারল আর আমাকে একটা ফোন করে জানাতে পারল না? ঠিক আছে আজ আমি সামিরার সাথে চলে যাব। আপনি চলে যান।”
তুষার জোর করে বলছে,
“তোমার একা যেতে হবে না। ফায়াজ তোমার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে আমিই নিয়ে যাব। প্রয়োজন হলে সামিরাজে ডাকো। দুজনকে এক সাথে ভার্সিটিতে ছেড়ে আসব।”
মেহের সামিরাকে ফোন করল। তারপর দুজন এক সাথেই তুষারের গাড়িতে ভার্সিটিতে গেল। তুষার মুখ ভার করে রেখেছে যে কি না সব সময় হাসিখুশি থাকে। মেহেরের সন্দেহ হচ্ছে।
মেহের আর সামিরা গাড়ি থেকে নামতেই তুষার আবারো গাড়ি স্টার্স্ট দিল। মেহের গাড়ির গ্লাসে টুকা দিল। তুষার গ্লাস খুলে বলল,
“কি হয়েছে মেহের?”
মেহের কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“আপনি গাড়ি থামান। আমার কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। ভালো লাগছে না। ফায়াজ কোথায় আছে? উনাকে আসতে বলুন। নয়তো আমাকে উনার কাছে নিয়ে যান।”
“কি বলছো মেহের? আমি তোমাকে কোথায় নিয়ে যাব? ফায়াজ কোথায় আমি জানি না।”

“আপনি জানেন তুষার ভাইয়া। আপনি সব জানেন। আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন? নিশ্চয়ই ফায়াজের কাছে।” মেহেরের কান্না পাচ্ছে খুব। গলা ভারি হয়ে আসছে। তুষার কি করবে বুঝতে পারছে না। ফায়াজকে বারবার বুঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু মেহের বুঝতে নারাজ।
তুষার বাধ্য হয়ে মেহেরকে গাড়িতে ওঠতে বলল সাথে সামিরাকেও আসতে বলল।
ফায়াজ গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছে ফায়াজকে কি উত্তর দেবে?
গাড়ি হসপিটালের সামনে থামতেই মেহের বাইরে তাকাল। হসপিটালের সামনে গাড়ি থামাতে দেখে ওর পিলে চমকে উঠল।
কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“হসপিটালে কেন? ফায়াজ ঠিক আছে তো?”
তুষার ভনিতা না করেই বলল,
“ফায়াজ হসপিটালে ভর্তি। গতকাল রাতে আড্ডা শেষে যখন বাড়িতে ফিরছিল তখন গভীর রাত। রাস্তায় কয়েকজন ওর গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। ফায়াজ গাড়ি থামায় ব্যাপারটা বুঝার জন্য। আর ওরা এসে ফায়াজকে সুযোগ না দিয়েই আচমকা ওর গাড়ি ভাঙচুর করে। ফায়াজ ভেতরে থাকায় ভাঙা গ্লাসে ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ওরা শুধু ওর গাড়িতেই আঘাত করে। এর মানে কেউ ইনটেনশনালি এসব করেছে।”

মেহের সামিরাকে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। তারপর দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে বলল,
“ফায়াজের কাছে নিয়ে চলুন দ্রুত। আমি ওর কাছে যাব।”
তুষার ওদের নিয়ে যেতে যেতে ভাবছে ফায়াজ সকালে কি বলেছিল।
সারারাত ওর বন্ধুরা ফায়াজের সাথেই ছিল। ফায়াজ আহত অবস্থায় ওদের ফোন করলে ওরাই উদ্ধার করে ওকে। তারপর হসপিটালে নিয়ে আসে। সকালে ফায়াজের জ্ঞান ফিরতেই তুষারকে বলে,
“মেহের যেন বিন্দুমাত্র কিছু জানতে না পারে। মেহের মুখে যত যাই বলুক না কেন? মেহের ওকে কতটা ভালোবাসে, মেহেরের মনে কতটা জুড়ে আছে সেটা একমাত্র ওই জানে। জানতে পারলে কেঁদে কেটে ভাসাবে। আর ও যেন মেহেরকে সাবধানে ভার্সিটিতে নিয়ে যায় আর নিয়ে আসে।”
কিন্তু এখন বাধ্য হয়েই নিয়ে আসতে হয়।
মেহের অস্থির হয়ে আছে। কেঁদেই যাচ্ছে। ফায়াজের এমন কিছু হবে কল্পনাও করতে পারে নি। ফায়াজক কেমন আছে, ফায়াজকে না দেখা পর্যন্ত ওর শান্তি নেই।
ফায়াজের কেবিনের সামনে যেতেই কেবিন মানুষে ভরপুর দেখতে পায়। ফায়াজ বন্ধুদের সাথে টুকটাক কথা বলছে। মেহের ভেতরে যেতেই সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ফায়াজ মেহেরকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। ওকে এখানে একদমই আশা করে নি। তারপর তুষারের দিকে তাকায়।
তুষার বলল,
“ভাই আমার দোষ নেই। আগে বউ সামলা। সবটা পরে বলছি।”
তুষার একে একে সবাইকে নিয়ে বের হয়ে যায়।
মেহের গাল মুছতে মুছতে ফায়াজের দিকে যায়। ফায়াজ জোরপূর্বক আলতো হাসল। মেহের ফায়াজের শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ দেখে আবারও কাঁদতে শুরু করল।

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩১

ফায়াজ হাত বাড়িয়ে মেহেরের হাত ধরে বলল,
“আরে আমার কিছুই হয় নি। এই একটু কেটেছে। এই শালার বন্ধুদের জন্য বেডে শুয়ে আছি।”
মেহের ফায়াজের হাত চেপে ধরে কান্নামিশ্রিত সুরে নাক ফুলিয়ে বলল,
“দাঁড়ান, আপনাকে এখানে এক মাস রাখার ব্যবস্থা করছি৷ তবে যদি একটু শান্তি থাকেন।”

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.