শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৫
ফাবিহা নওশীন
“আপনি নরমাল টি-শার্ট, টাউজার আর ঘরে পড়ার জুতা পড়ে শ্বশুর বাড়িতে যাবেন?”
নার্স ওষুধ দিতে আসায় সবাই যখন বাইরে যাচ্ছিল তখন মেহের পেছনে থেকে ফায়াজকে উদ্দেশ্য করে বলল। ফায়াজ পেছনে ঘুরে মেহেরের দিকে তাকাল। মেহের খিলখিল করে হাসছে। এই শরীরে কিভাবে খিলখিল করে হাসছে? কি অদ্ভুত মেয়ে। অদ্ভুত ই তো।
ফায়াজ নিজের দিকে তাকিয়ে মেহেরের দিকে দু পা এগিয়ে গেল। নার্স ওষুধ দেখছে।
ফায়াজ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,
“আসলেই তো এভাবে যাব শ্বশুর বাড়ি? আজ দাঁত ব্রাশও করি নি।”
মেহের নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“ইয়াক! আপনি দাঁত ব্রাশ করেন নি?”
ফায়াজ মৃদুস্বরে হেসে বলল,
“ফোন পেয়ে যে অবস্থায় ছিলাম সে ভাবেই চলে এসেছি। যে পোশাকে ছিলাম, যেভাবে ছিলাম চলে এসেছি।”
“আপনি বাড়িতে যান। ফ্রেশ হয়ে হসপিটালে আসুন। আমার রিলিজ আর ডাক্তারের সাথে কথা বলা নিয়ে অনেক সময় লাগবে।”
নার্স মেহেরের কাছে ওষুধ নিয়ে যেতেই ফায়াজ বেরিয়ে গেল। কিন্তু ওর বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে যাওয়ার পর যদি মেহেরকে নিয়ে ওরা চলে যায়? তাই ফায়াজ বাড়িতে ফোন দিল। ওর লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে আসতে বলল। ও বাড়িতে যাবে না। হসপিটাল থেকেই মেহেরের সাথে যাবে।
মেহের গাড়ি থেকে নামছে। মাহি আগ বাড়িয়ে মেহেরকে ধরতে গেলে মেহের বাঁধা দিয়ে বলল,
“আমার হাত-পা ভাঙে নি। আমি হাঁটতে পারি। এত ভালোবাসা দেখানোর দরকার নেই।”
ফায়াজ মেহেরের সামনে এসে দাঁড়াতেই মেহের ফায়াজের সাথে ভেতরে যাচ্ছে। মাহি থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্জ মাহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
” কি গো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
মাহি থমথমে মুখে বলল,
“না এমনি চলো। মিশানকে খাওয়াতে হবে।”
মাহি আর তূর্জও ভেতরে গেল।
মেহেরের মা মেহেরকে ওর রুমে রেস্ট করতে দিয়ে আসার পর ফায়াজ ওর ঘরে গেল। মেহের ফ্রেশ হয়ে বের হলো। ফায়াজ আচমকা গিয়ে মেহেরকে জড়িয়ে ধরল। মেহের ফায়াজের অশান্ত শ্বাস আর বুকের ধুকধুকানি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। ফায়াজ শান্ত হয়ে আছে। মেহেরকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে আছে। মেহেরও চুপ করে আছে।
ফায়াজ কিছুক্ষণ পরে বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
“আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল মেহের। আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আমার পুরো পৃথিবী থেমে গেছে। খবরটা শুনে আমার হৃদ স্পন্দন থেমে গিয়েছিল। কিছু সময়ের জন্য আমার বোধ হারিয়ে ফেলেছিলাম। মাথা কাজ করছিল না। তুমি আর এমন করো না মেহের। তুমি কেন আমাকে তোমার অসুস্থতার কথা বলো নি। আমি রোজ তোমার জন্য খাবার নিয়ে যেতাম। তারপর আমি ভেবেছিলাম তুমি ভালো আছো। কিন্তু এর পরেও তুমি অসুস্থ বোধ করেছো কিন্তু কেন বলো নি কেন?”
“আমি বুঝতে পারি নি। ভেবেছি এমনি…
ফায়াজ মেহেরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
” হু এমনি…। তুমি আর কখনো আমার কাছে কিছু লুকাবে না।”
মেহের ফায়াজকে ছাড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা। এখন আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আপনার শরীরে গন্ধ প্রচুর। ওয়াক!”
মেহের আবারও খিলখিল করে হাসছে।
ফায়াজ নাক মুখ কুচকে চোখ ছোট ছোট করে মেহেরের দিকে তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
মেহের নিজের ঘরে শুয়ে আছে। ফায়াজ ওকে জোর করে শুইয়ে দিয়ে গেছে। বলেছে যেন একদমই বের না হয়। তাই মেহের বাধ্য হয়ে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে আছে কিন্তু ঘুম নেই। শুয়ে শুয়ে বোর হচ্ছে আর মনে মনে ফায়াজকে বকছে। “আমাকে শুইয়ে দিয়ে নিজে ঘুরতে চলে গেছে।”
তখনই দরজায় খট শব্দ শুনে মেহের দ্রুত চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভাব করল।
মেহের কিছুক্ষণ পরে নিজের পায়ে কারো হাত আর মাথার অস্তিত্ব অনুভব করছে। এক চোখ খুলে চোখের কোনা দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কে আছে। মেহের মাহিকে দেখে শকড। মেহের দ্রুত উঠে বসে।
মেহের মাহিকে দেখে বলল,
“এ-সব কি হচ্ছে আপু?”
মাহি অনুনয়ের সুরে বলল,
“মেহু পাখি আমি তোর সাথে একটু কথা বলতে চাই।”
মেহের ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,” ওই নামে আমাকে ডাকবে না। মেহু পাখি মরে গেছে।”
মাহি আতংকিত কন্ঠে বলল,”মেহু!”
মেহের হাত জোর করে বলল,
“আমি হাত জোর করছি, প্লিজ। আমার জীবনে ইন্টারফেয়ার করার চেষ্টা করো না। তোমার লাইফে আমি যেমন ইন্টারফেয়ার করি নি, তেমনি তুমিও আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করো না।”
“আমি ইন্টারফেয়ার করছি? আমি তো শুধু তোর খোঁজ….।”
মেহের কড়া গলায় বলল,
“দরকার নেই। একদম দরকার নেই। আমার খোঁজ নেওয়ার মানুষ আছে৷ আমাকে নিয়ে ভাবার মানুষও আছে। তুমি সব সময়ের মতো তোমাকে নিয়ে ভাব।”
মাহি মেহেরের পা জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদছে। মেহের পা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।
মাহি কেঁদে কেঁদে বলল,
“মেহের ক্ষমা করে দে না আমায়। আমাকে ক্ষমা কর। আমার জন্য আজ তোর এই অবস্থা। আমার জন্য তোর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। তুই আমার জীবনটা সাজিয়ে দিয়ে নিজের জীবনটা এলোমেলো করে ফেলেছিস। শরীরে এত বড় একটা রোগ বাসা বাঁধছে। মেহের প্লিজ আমাকে মাফ কর। আমি প্রমিস করছি আমি সবাইকে সত্যটা বলে দেব। কিন্তু আমার কয়েকদিন সময় প্রয়োজন। নিজেকে তূর্জ আর বাবা-মার মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য সাহস প্রয়োজন। কারণ আমি যা করেছি সেটা মেনে নেওয়া ওদের জন্য সহজ হবে না। তাই আমার সময় প্রয়োজন।”
মেহের তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“তাতে কি হবে? আমার সাথে যা যা হয়েছে তার প্রতিকার আমি পাব? আমি যে কষ্টগুলো সহ্য করেছি তা মেটানো যাবে? তা মুছে যাবে? যাবে না আপু। তুমি আমার সাথে ফায়াজের সাথে যা করেছো তা ক্ষমার অযোগ্য।”
মাহি কাঁদছে। মেহেরের পা তখন ধরে আছে মাহি।
“আমি জানি আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু আমি তো চেয়েছিলাম নিজের পাপের সাজা নিজেই পেতে। তোকে তো বলি নি ফায়াজের কাছে যেতে৷ ওকে বিয়ে করতে। আমি তো চেয়েছিলাম ফায়াজের দেওয়া শাস্তি মাথা পেতে নিতে। বলেছিলাম তো, অনুনয় করেছিলাম ওর কাছে তোকে ছেড়ে দিতে। তোর জীবনটা নষ্ট না করতে।”
মেহের ভাবছে সেদিন ফায়াজের সাথে বিয়ে করেছিল বলেই আজ এমন একজন ভালোবাসার মানুষ পেয়েছে। যে ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু এই মুহুর্তে মাহির মুখে ফায়াজের নামটা ভালো লাগছে না। বড্ড বিরক্ত লাগছে।
মাহি দু’হাত জোর করে কাঁদছে।
“তুই আবার আমার সেই মেহু পাখি হয়ে যা মেহের। আমি সবার সামনে সবটা স্বীকার করব। আমি ফায়াজের কাছেও..।”
ফায়াজের নাম শুনে মেহের দ্রুত বলল,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম।”
।
মেহের মিশানকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে এলো। ফায়াজ রুমে বসে আছে। মেহের কোথায় গেছে সেটা ভাবছে। মেহেরকে দেখে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”
মেহের মিশানকে চুমু খেয়ে বলল,
“বাবা, আংকেলের কোলে যাবা?”
ফায়াজ মিশানকে দেখে হাসিমুখে কোলে নিল। এর আগে কখনো কোন বাচ্চাকে কোলে নেয় নি। এই প্রথম নিল। কোলে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মিশান ফায়াজের কাপড় নষ্ট করে দিল। ওর টিশার্ট আর প্যান্ট কিছু অংশ ভিজে গেছে। মেহের আবার খিলখিল শব্দ করে হেসে উঠল। ফায়াজ মেহেরকে বারবার বলছে কোলে নিতে। মেহের নিচ্ছে না। শুধু হেসেই যাচ্ছে। মাহি মিশানকে নেওয়ার জন্য আসতেই দেখে এই অবস্থা। দ্রুত ভেতরে ঢুকল। একবার ফায়াজের দিকে আরেকবার মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে।
তারপর মেহেরকে বলল,
“তোকে বলেছিলাম ওকে ডায়াপার পড়িয়ে নে। ডায়াপার পড়াস নি কেন? তাহলে তো এমন হতো না।”
মেহের হাসি থামিয়ে বলল,
“আমি পড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারি নি। তাই এভাবে নিয়ে এসেছি।”
মাহি ফায়াজের কাছ থেকে মিশানকে নিয়ে মেহেরকে বলল,
“ডায়াপার পড়াতে পারিস না? নিজের বাচ্চাকাচ্চা লালন পালন করবি কিভাবে?”
ফায়াজ মাহির কথা শুনে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আমার বাচ্চাকাচ্চা পালন করার লোকের অভাব হবে না। হাজার মানুষের লাইন বসিয়ে দেব। মেহেরকে কিছু করতে হবে না।”
মাহি মেহেরের দিকে একবার তাকিয়ে মিশানকে নিয়ে চলে গেল। মাহি যেতেই মেহের আবারও খিলখিল করে হাসছে। ফায়াজ মেহেরের দিকে চোখ পাকিয়ে চেয়ে চেঞ্জ করতে চলে গেল।
ফায়াজ আবারও মেহেরকে শুইয়ে দিয়েছে। বসে বসে মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তখনই ওদের দরজায় কড়া পড়ল। দরজা খোলা ছিল। মাহি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেহের মাহিকে দেখে উঠে বসল। ফায়াজের চেহারায় বিরক্তি স্পষ্ট।
মাহি অস্বস্তি নিয়ে বলল,
“খেতে ডাকছে।”
মাহি বলেই চলে গেল। মেহের ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ কপাল কুচকে আছে। ফায়াজের চোখ মেহেরের দিকে পড়তেই বলল,
“ওকে দেখলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।”
মেহের মুখ গম্ভীর করে বলল,” আপনি বাড়িয়ে চলে যান৷ আজই চলে যাবেন। আমি সুস্থ হলে আমাকে নিয়ে যাবেন।”
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৪
মেহের কথাটা বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল। মেহের হাঁটছে আর ভাবছে,
“ফায়াজের মনের কোথাও না কোথাও মাহি আছে। নয়তো ফায়াজ মাহিকে দেখে রিয়েক্ট করবে কেন? মাহির অস্তিত্বে ফায়াজের মধ্যে কোন অনুভূতি সৃষ্টি করবে না। না বিরক্তি, না রাগ, না খুশি কোনটাই ফায়াজের অনুভব হবে না। তবে কেন হয়? তার মানে মাহির উপস্থিতি ফায়াজকে প্রভাবিত করে। মেহের এটা মেনে নিতে পারছে না।