শেষ পাতায় তুমি পর্ব - Golpo bazar

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৬ || মেঘের উপর বাড়ি

শেষ পাতায় তুমি

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৬
ফাবিহা নওশীন

ফায়াজ বিরক্ত আর বিরস মুখে বিছানায় বসে আছে। ওর দৃষ্টি খোলা দরজার দিকে। রাত ১২টা পাড় হয়ে গেছে মেহেরের আসার খবর নেই। ফায়াজ ভাবছে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে নিশ্চয়ই মাহির সাথে গল্প করছে। ফায়াজ আর ধৈর্য্যধারণ করতে পারছে না। উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীর পায়ে রুমের বাইরে গেল।
মাহি সবেমাত্র মিশানকে ঘুম পাড়াতে পারল। পাশেই তূর্য ঘুমে বিভোর। মাহি আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নামল। যাতে কোন প্রকার শব্দ না হয়। মিশানকে অনেক কষ্ট করে ঘুম পাড়িয়েছে। ও নিশব্দে পানির জগ হাতে নিল। তারপর পানি আনতে নিচে চলে গেল।
মাহি পানিভর্তি জগ হাতে যখন সিড়ির কাছে যাবে তখনই চোখ পড়ল সোফার দিকে। মেহের সোফায় ঘুমিয়ে আছে। এক হাতে রিমোট এমন ভাবে ধরে রেখেছে যে যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারে। মাহি টিভির দিকে তাকাল। টিভি তো অফ। টিভি দেখতে দেখতে তো ঘুমায় নি। তাহলে এখানে এভাবে নিজের ঘর রেখে ঘুমিয়ে আছে কেন? ড্রয়িংরুমের লাইটও অফ ছিল মাত্রই ও পানি নেওয়ার জন্য জ্বালিয়েছে। মাহির ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। কিন্তু সারাদিন ওদের দেখে মনে হয়েছে ওদের মধ্যে মধুর একটা সম্পর্ক রয়েছে। তাহলে সেটা কি ভুল ছিল?

মাহি মেহেরের দিকে আগাতে চাইলে কারো আসার শব্দ পায়। মাহি সিড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ফায়াজ আসছে। মাহি আড়ালে লুকিয়ে গেল। ফায়াজ মাহি আর ওদের মায়ের রুমের সামনে ঘুরে এসেছে কিন্তু মেহের সেখানে নেই সে সম্পর্কে কোন ডাউট নেই। ফায়াজ নিচে এসে মেহেরকে সোফায় শুয়ে থাকতে দেখল।
ফায়াজ মেহেরের দিকে আগাতে আগাতে বিরবির করে বলছে,
“আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি। এ ঘর ও ঘর খুঁজে মরছি আর ও এখানে ঘুমাচ্ছে?”
ফায়াজ আস্তে আস্তে মেহেরকে কোলে তুলে নিল যাতে ওর ঘুম না ভাঙে। ফায়াজ মেহেরকে কোলে তুলে নিতেই মেহের নড়েচড়ে উঠে। ফায়াজ তাই দাঁড়িয়ে যায়। মেহের আবার ঘুমে বিভোর হয়ে ঘনঘন শ্বাস নিলে ফায়াজ ওকে নিয়ে আগায়। কিন্তু ফায়াজ দু-তিন পা আগাতেই মেহেরের ঘুম ভেঙে যায়। মেহের চোখ খোলে নিজের অবস্থান বুঝার জন্য এদিক সেদিক তাকালে ফায়াজকে দেখে চমকে যায়।
মেহের ফায়াজকে বলল,
“আমাকে এভাবে কোলে নিয়েছেন কেন? নামান নিচে। আমি নিচে নামব।”
ফায়াজ মেহেরকে নামাবে না তাই ওকে নিয়ে কোলে নিয়েই হাঁটা দিল। মেহের নামার জন্য ছটফট করছে এবং রীতিমতো হাত-পা ছড়াছড়িও করছে। ফায়াজ বাধ্য হয়েই মেহেরকে নিচে নামাল। নয়তো যেমন করছে যদি হাতে, পায়ে ব্যথা পায়?
ফায়াজ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আরে সমস্যা কি তোমার? এমন করছো কেন? ঘর রেখে এখানে ঘুমাচ্ছো কেন? অদ্ভুৎ কাজকর্ম!”
মেহের উত্তরে বলল,
“আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘরে যাচ্ছি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

মেহের ঘরে যাওয়ার জন্য কয়েক পা এগুতেই ফায়াজ ওর হাত ধরে ঘুরিয়ে নিজের কাছে এনে শীতল কণ্ঠে বলল,
“কি হয়েছে তোমার মেহেরজান?”
মেহের মাথা চুলকে বলল,
“নেশা-টেশা করেছেন না কি? কিছুক্ষণ আগেই তো ধমকে কথা বললেন। এখন এত নরম সুরে কথা বলছেন কেন?”
ফায়াজ মুচকি হেসে মেহেরকে ঘুরিয়ে মেহেরের পিঠ নিজের সাথে মিশিয়ে নিল।
মাহি অস্বস্তিতে হাতে পানির জগ নিয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেল। ছোট বোন আর তার বরকে এভাবে দেখে অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু এখান থেকে যাওয়ার উপায়ও নাই। যেতে হলে ওদের সামনে দিয়েই যেতে হবে।
ফায়াজ মেহেরের গলায় আলতো করে চুমু খেল। মেহের আবেশে চোখ বন্ধ করে নিল। সারা শরীরে আলোড়ন বয়ে যাচ্ছে। মেহেরকে কেঁপে উঠতে দেখে ফায়াজ মেহেরের গলায় আবারও চুমু খেল।
মেহের নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“মাথা গেছে আপনার? ড্রয়িংরুমে আবার আলো জ্বলছে। কেউ চলে এলে কি ভাববে হা?”

ফায়াজ বাকা হেসে বলল,
“আমি তো বেডরুমেই রোমান্স করতে চেয়েছিলাম তুমি তো যেতে চাইছো না। আমার কি দোষ?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে নাক-ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ সরু সরু করে তাকাচ্ছে। আর আনমনে ভাবছে,
“এই যে আমি রাগ করেছি সে দিকে খেয়াল আছে? না নেই। কেন থাকবে? আমাকে তো ভালোবাসে না। একটুও বাসে না।”
মেহের ঘুম ঘুম চোখ করে বলল,
“আমি যাচ্ছি ঘরে। ঘুম পাচ্ছে।”
তারপর হনহন করে চলে গেল। ফায়াজ তখনও দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর নিজেও উপরে চলে গেল। ওরা যেতেই মাহি যেন হাফ ছেড়ে বাচঁল। মাহিও গুটিগুটি পায়ে নিজের রুমে চলে গেল।
.
ফায়াজ ঘরে গিয়ে দেখে মেহের বিছানার এক সাইডে শুয়ে আছে। ফায়াজ গিয়ে ওর পাশে শুতেই মেহের অন্যদিকে ঘুরে চোখ বন্ধ করে নিল।
ফায়াজ মেহেরকে বলল,
“মেহের, ওপাশে ঘুরে গেলে কেন? এদিকে ঘুরো।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনেও না শোনার ভান করে আছে। ফায়াজের রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে টেনে এদিকে ঘুরিয়ে নিতে। কিন্তু ফায়াজ রিয়েকশন দিচ্ছে না কোন। নেহাত মেহের অসুস্থ নয়তো বুঝিয়ে দিতো ফায়াজকে ইগনোর করার মজা। অসুস্থ বলেই ছাড় দিচ্ছে। ফায়াজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। ডান হাত কপালে দিয়ে রেখেছে।
মেহের কিছুক্ষণ পরে ফায়াজের দিকে ঘুরে দেখে ফায়াজ চোখ বন্ধ করে আছে।
মেহের দীর্ঘ সময় মনের সাথে যুদ্ধ করে শীতল কণ্ঠে বললো,
“আমাকে একটু আপনার বুকে ঘুমাতে দেবেন?”
ফায়াজ মেহেরের কন্ঠস্বর শুনে চমকে গেল। হাত সরিয়ে চোখ মেলে মেহেরের দিকে তাকাল। মেহেরের চোখেমুখে অনেক আকুতি দেখতে পাচ্ছে। মেহের অনেক আশা নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে।
ফায়াজ মেহেরকে টেনে নিজের বুকে নিল।
মেহের দু’হাতে ফায়াজকে জড়িয়ে ধরল। ফায়াজও আগলে নিল দু’হাতে। ফায়াজ মনে মনে হাসছে আর বলছে,

“এই মেয়ে নিজেই দূরে যাব, দূরে যাব করে কিন্তু নিজেই আবার কাছে আসে। কিসের টানে? ভালোবাসার টানে ফায়াজ, ও তোকে ভালোবাসে।”
কিছুক্ষণ পরে ফায়াজ বুকে তরল পদার্থ অনুভব করল। উষ্ণ তরল পদার্থ। ফায়াজের বুঝতে বাকি নেই মেহের কাঁদছে। কিন্তু কেন কাঁদছে? অযথা কান্নাকাটি ফায়াজের ভালো লাগে না। আর এমনও না যে ফায়াজ ওকে জোর করেছে, মেহের নিজেই এসেছে। ফায়াজ মেহেরকে হুট করে সরিয়ে উঠে বসে চোখ গরম করে বলল,
“কি হয়েছে? হয়েছেটা কি? তুমি কাঁদছো কেন?”
মেহের চুপ করে আছে। কেঁদেই যাচ্ছে। ফায়াজের মাথায় যেন ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। রাগে গজগজ করছে। ফায়াজ চেচিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ! একদম চুপ! বিরক্ত লাগছে৷ জাস্ট বিরক্ত লাগছে। হোয়াটস ইউর প্রব্লেম?”
মেহের ফায়াজের ধমক শুনে চুপ করে গেল। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ফায়াজ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে মেহেরের গালে হাত রেখে মোলায়েম গলায় বলল,
“তুমি না বললে আমি কি করে বুঝব? কান্না থামাও তারপর বলো।”
মেহের কয়েক মিনিট সময় নিল। ফায়াজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মেহের কান্না থামিয়েছে কিন্তু এখনো ফুপানি কমে নি।
মেহের চোখ তুলে ফায়াজের দিকে তাকাল তারপর বলল,
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। আপনি আমাকে মিথ্যা বলেছেন।”
মেহের আবারো কেঁদে ফেলবে এমন অবস্থা। ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে অবাক হয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে।
মেহের আবারও বলল,

“আমি মরে যেতে রাজি আছি কিন্তু আপনি আমাকে ভালোবাসেন না কিন্তু আপুকে ভালোবাসেন সেটা আমি মানতে পারব না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে এ-সব মানতে।”(মেহের নিচের চোখ বন্ধ করে নিল)
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে হতবাক। মেহের কোন আক্কেলে কেন এসব বলছে বুঝতে পারছে না।
ফায়াজ কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি এ-সব কেন বলছো? আমি তোমার আপুকে ভালোবাসি সেটা কে বলল?”
মেহের কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি জানি আপনি আপুকে ভালোবাসেন। ভালো না বাসলে আপুকে দেখলে আপনি রেগে যেতেন না। আপুর উপস্থিতি আপনার উপর ইফেক্ট ফেলত না।”
মেহের হেচকি তুলে বলল,
“ফায়াজ, আমি দম নিতে পারছি না। আমার শ্বাস আটকে আসছে। আপনি বলেছিলেন না আপনি চান কেউ আপনাকে এমন ভাবে ভালো বাসুক যাতে আপনাকে ছাড়া তার শ্বাস আটকে আসে। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না এটা ভেবেই আমার শ্বাস আটকে আসছে। আপনি যদি আমার কাছে, আমার সাথে না থাকেন তাহলে আমার কি হবে? আমার বুকের ভেতর কাটাছেঁড়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে অদৃশ্য ধারালো ছুরি দিয়ে কেউ অনবরত আঘাত করে যাচ্ছে। আমি টিউমারের ব্যথা সহ্য করে নিয়েছি কিন্তু এই অদৃশ্য ব্যথা সহ্য করতে কেন পারছি না?”
ফায়াজ মেহেরের অবস্থা বুঝতে পেরে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল,
“মেহের, তুমি ভুল বুঝছ। অনুভব করো, আমার হৃদস্পন্দন শুনো। সেখানে শুধু তোমার নামের জপ হয়। সূচনাতে অন্য কেউ থাকলেও উপসংহারে তুমি আছো। শুধু তুমি। জীবন নামের উপন্যাসের প্রতি পাতায় হাজারো মানুষের আনাগোনা থাকলেও একদম #শেষ_পাতায়_তুমি আছো। সুন্দর একটা সমাপ্তিতে তুমি আছো। উপন্যাসের শেষ পাতা পাঠককে যেমন মোহনীয় ও আচ্ছন্ন করে রাখে তেমনি তুমি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছো। আমি তোমাকে বিভোর হয়ে আছি আর থাকব।”

ফায়াজের কথা গুলো শুনে মেহেরের মনের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে এক চিলতে রোদের দেখা পেল। মেহের কান্না কমিয়ে বলল,
“তাহলে আপুর ব্যাপারটা?”
“তুমি আজীবন বোকাই রয়ে গেলে। আমাকে কখনো দেখেছো মাহির জন্য কষ্ট পেতে? কখনো ছটফট করতে দেখেছো? তুমি না একদিন এ-সব প্রশ্ন নিয়ে আমার মুখোমুখি হয়েছিলে? তোমাকে সেদিন এড়িয়ে গিয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে ওকে ভালোবাসি না। তাহলে আজ সেই তুমি কেন এ-সব উল্টো পালটা কথা মাথায় আনছো? আমি ওকে ভালোবাসি নি। কখনো ভালোবাসিনি। আমি যদি কারো জন্য কষ্ট পেয়ে থাকি, ছটফট করে থাকি, পাগলামি করে থাকি, কারো জন্য চোখের পানি ফেলে থাকি সে তুমি। আর মাহির প্রতি আমার রাগের কারণ জানতে চাও? তাহলে শুনো। মাহিকে আমার সহ্য হয় না কারণ ওর জন্য তুমি সবার চোখে অপরাধী হয়ে আছো। ওর জন্য তোমার প্রতি তোমার বাবার, তোমার পরিবারের এমন মনোভাব। ওর জন্য তুমি কষ্ট পাচ্ছো। কিন্তু ও তো তোমার বাবার চোখে সুশীল কন্যা হিসেবে পরিচিত। ও সবাইকে ঠকাচ্ছে, সবাইকে। তাই ওকে আমার সহ্য হয় না।”
মেহের মাথা তুলে বলল,
“শুধু এই জন্যই?”

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৫

ফায়াজ মুচকি হাসল। তারপর আবার জড়িয়ে ধরল।
আনমনে ভাবছে,
“ভেবেছিলাম আমিই শুধু ওর জন্য পাগল। কিন্তু মনে মনে মেহেরজানও আমার জন্য পাগল। আমি ওকে ভালোবাসি না ভেবে এমন কান্নাকাটি করছে। এত কষ্ট পাচ্ছে। ক্রেজি লাভারের ক্রেজি লাভারনী। উফফফ!! নিজেকে এত সুখী মনে হচ্ছে কেন?”

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.