শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৭
ফাবিহা নওশীন
জানালার পর্দা ভেদ করে ভোরের নরম আদরমাখা রোদ মেহেরের চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায়। ফায়াজ মেহেরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মেহের হাত দিয়ে ডান চোখ ডলে ভালো করে তাকাল। ফায়াজের আছে লেপ্টে আছে ও। হটাৎ করেই মেহেরের গতকালের কথা মনে পড়ল। গতকাল ফায়াজের সামনে যা করেছে যা বলেছে এর জন্য লজ্জা পাচ্ছে। ফায়াজ নিশ্চয়ই ওকে পাগল ভাবছে। ছিহ! ছিহ!
ফায়াজকে ছাড়িয়ে মেহের ধীরে ধীরে উঠে গেল। ঘড়ির কাটায় বেলা আটটা বেজে ২৪ মিনিট। এত বেলা হয়ে গেছে। মেহের দ্রুত বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে এল। ফায়াজ তখনও ঘুমাচ্ছে। মেহের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে আর ফাঁকে ফাঁকে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে।
মেহের টপাটপ রেডি হয়ে দরজার সামনে গিয়ে আবার ফিরে ফায়াজের দিকে তাকাল।
মেহের বিড়বিড় করে বলল,
“আপনি ঘুমিয়ে থাকুন। প্লিজ আপনি আজ সারাদিন ঘুমিয়ে থাকেন। উঠার একদম প্রয়োজন নেই। প্লিজ প্লিজ।”
মেহের নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। সকালের নাস্তা করার সময় হয়ে গেছে কিন্তু ফায়াজ তখনও উঠে নি। তাতে মেহেরের কিছু আসে যায় না। মেহের চায় আজ ফায়াজ সারাদিন ঘুমিয়ে থাকুক। নয়তো গতকালের ঘটনার জন্য ফায়াজ ওকে ইচ্ছাকৃত ভাবে লজ্জা দিতেই থাকবে। মেহের এতদিনে ফায়াজকে এতটুকু তো চিনেছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
মেহের নাস্তা করার জন্য বসেছে। ওকে ওষুধ খেতে হবে তাই কেউ ফায়াজের জন্য অপেক্ষা করতে বলে নি। মেহের নাস্তা করছে আর সে সময় ডোরবেল বেজে ওঠে।
মেহেরের মায়ের কন্ঠ শুনে মেহের খাবার রেখে সে দিকে তাকায়। ফায়াজের বাবা এসেছে। মেহের খাবার রেখে টিস্যু দিয়ে হাত মুছে দ্রুত উঠে গিয়ে সালাম জানাল।
ফায়াজের বাবা সালামের উত্তর নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কেমন আছো মা? এতকিছু হয়ে গেল আর আমি কিছুই জানি না। ফাইজা আমাকে রাতে ফোন দিয়ে জানাল।”
মেহের আলতো হেসে বলল,
“আমি ভালো আছি। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। বলেছে ঠিকমত ওষুধ খেলে সুস্থ হয়ে যাব। আপনি আসুন বসুন। মা চা-নাস্তা নিয়ে এসো।”
মেহেরের মা বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি বসুন। বসে কথা বলুন। আমি আপনার জন্য চা-নাস্তা নিয়ে আসছি।”
ফায়াজের বাবা বলল,
“আপা আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি নাস্তা করেই বের হয়েছি। আমি মেহেরকে দেখতে এসেছি। ওর সাথে একটু কথা বলেই চলে যাব।”
সাফায়েত নওয়াজ খান মেহেরের সাথে গিয়ে বসল।
তিনি আমতা আমতা করছেন। তারপর বলল,
“ফায়াজ তো এখানেই। ওকে দেখছি না কেন?”
মেহের একবার সিড়ির দিকে তাকিয়ে উনার দিকে স্নিগ্ধ চোখে চেয়ে বলল,
“অনেক টেনশনে ছিল। ঘুমাতে পারে নি। তাই ঘুমাচ্ছে। এতক্ষণে হয়তো উঠে গেছে। ডাকব? কথা বলবেন?”
ফায়াজের বাবা শুকনো হাসল। তারপর বলল,
“নাহ! ওর সাথে কি কথা বলব? নিজের ছেলে, নিজের বাড়িতে থাকে তখনই কথা বলি না। এখানে এসে আর কি বলব? আসলে আমি ওর সাথে ইচ্ছে করেই কথা বলি না। ওর সামনে দাঁড়াতে পারি না। ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমি অপরাধবোধে ভুগি। ওর মুখ দেখলে মনে হয় আমার জন্য ছেলেটা পরিবারহীন। ওর খারাপ সময়েও ওর সামনে এসে দাঁড়াতে পারি না। ইনফ্যাক্ট ওর সাথে তোমার সম্পর্ক ভেঙে গেছে জানার পরেও ওর কাছে আসি নি। ওকে শাসনও করতে পারি নি। কি করে করব? যেখানে আমি নিজেই নিজের ঘর ভেঙে বসে আছি সেখানে ছেলেকে কোন মুখে শাসন করব? তবে তোমাকে পেয়ে একটা আশা জেগে উঠেছিল। ছেলেটা ঠিক হয়ে যাবে। তাই আমি শুধু এটুকু খোঁজ নিয়েছি তোমাদের ডিভোর্স হয়েছে কি না। পরে জানতে পারি ডিভোর্স হয় নি। আমার মনে আবারো নতুন করে আশার প্রদীপ জ্বেলে উঠল। আসলে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না। আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সে তো খোদার দান। এত সহজে মন থেকে মুছা যায় না। যেমনটা আমি পারি নি।”
মেহের অবাক হয়ে উনার কথা শুনছে। উনার এই গুরুগম্ভীর কথার মাঝে কোথাও একটা লুকোনো ব্যথা আছে। মেহের উনার চোখ মুখ পরখ করছে। বিষয়টা ফায়াজের বাবা খেয়াল করে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“এই দেখো কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম? তুমি নিশ্চয়ই বিরক্তবোধ করছো? ওসব বাদ দেও। তুমি নিজের খেয়াল রেখ বুঝলে। শীঘ্রই তোমাকে সুস্থ হতে হবে। তারপর এই বুড়ো শ্বশুর আর আমার পাগল ছেলেটার দায়িত্ব নিতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও তো।” ( তারপর হেসে ফেললেন)
মেহের বুঝতে পারল উনি কৌশলে সব এড়িয়ে গেলেন। মেহেরও প্রশ্ন করে উনাকে বিব্রতবোধ করাতে চাইল না। তবে এটুকু বুঝতে পারল উনি সুখে নেই। কোথাও না কোথাও মনে মনে একটা ভরা সংসার চাইছে। যেখানে সবটা থাকবে।
মেহের আলতো হেসে বলল,
“আমি আপনার জন্য চা করে নিয়ে আসছি।”
মেহের চা আনতে উঠে গেল। মেহেরের মা ওদের শ্বশুর আর বউমার কথার মাঝে যেতে চায় নি। তাই দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। মেহের মায়ের কাছেই ওর মা নাস্তা নিয়ে যেতে চাইল। আর তখনই ফায়াজ সিড়ি দিয়ে নামল। ফায়াজকে নামতে দেখে মেহেরের মা ওকে বলল,
“তুই জামাইয়ের সাথে থাক। দেখ ওর কি লাগবে। আমি তোর শ্বশুরকে নাস্তা দিচ্ছি।”
মেহের পড়ল বিপদে৷ ফায়াজ আর ও একা এক জায়গায় থাকা মানে ফায়াজের….
না না মেহের আর ভাবতে পারছে না। কি করবে এখন?
মেহের তাই দ্রুত বলল,
“মা, নাহহহ!”
মেহেরের হুট করে এত জোরে কথায় চমকে উঠল ওর মা। বড় বড় চোখ করে মেহেরের দিকে তাকাল।
মেহের মায়ের ভাব দেখে প্রশ্ন ছুড়ে মারার আগেই বলল,
“মা, আমার শ্বশুর এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছেন। গতবার তো আপুর বিয়েতে এসেছিল। সেটা অন্য ব্যাপার। আমি বাবাকে বললাম যে আমি চা নিয়ে আসছি। এখন যদি তুমি যাও তাহলে কেমন দেখায়? ফায়াজের নাহয় একদিন অসুবিধা হবে তাতে কি? আমার শ্বশুর বাবা তো আর রোজ রোজ আসবে না। আমিই বরং নাস্তাটা নিয়ে যাই। তুমি ফায়াজকে দেখো।”
মেহের মায়ের হাত থেকে এক প্রকার ছিনিয়েই ট্রে নিয়ে নিল। মেহেরের মা হটাৎ মেয়ের এহেন আচরণে অবাক না হয়ে পারল না।
।
ফায়াজ নাস্তার টেবিলের আশেপাশে মেহেরকে না দেখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। মেহেরের মা প্লেটে খাবার দিতে দিতে বলল,
“তোমার বাবা এসেছেন মেহেরকে দেখতে।”
ফায়াজ বুঝতে পারল মেহের সেখানেই আছে। তাই চুপচাপ খেয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
।
ফায়াজের বাবা যাওয়ার পর সামিরা এসেছে সাথে তুষারও। মেহের ভ্রু কুঁচকে সামিরার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিরা মেহেরের দৃষ্টি দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“জানু, তোকে দেখতে এসেছি। আর তুই এমন রাক্ষুসির মত চেয়ে আছিস কেন? খেয়ে ফেলবি না কি আমায়? তোকে কেউ খেতে দেয় না?”
মেহের সামিরার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল এক পাশে। তারপর বলল,
” কি চলছে তোদের?”
সামিরা নিজের গালে আলতো ছুঁয়ে বলল,
“নাউজুবিল্লাহ! কি বলিস এসব?”
মেহের চোখ পাকিয়ে বলল,
“সত্যি করে বল?”
সামিরা আমতা আমতা করছে। তারপর মেহেরের দিকে তাকিয়ে আবারও দাঁত কেলিয়ে বলল,
“তোর এই দেবরটা এত কিউট কি করব?”
মেহের চোখ উল্টিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল,” হায় রে!”
।
সামিরা আর তুষার সারাদিন ছিল ওদের বাড়িতে। তাই ফায়াজ একটুও সুযোগ পায় নি মেহেরের মুখোমুখি হতে। যাও পেয়েছে মেহের এড়িয়ে গেছে।
মেহের মাগরিবের নামাজ পড়ে গার্ডেনে হাঁটাহাঁটি করছে। ফায়াজ উপর থেকে মেহেরকে দেখে মনে মনে বলছে,
“পেয়েছি সুযোগ৷ দাঁড়াও।”
মেহের হাঁটাহাঁটির মাঝে ফায়াজকে বাইরে আসতে দেখে দ্রুতপায়ে অন্যদিকে হেঁটে চলে গেল।
মেহের পেছনে ঘুরে দেখছে, ফায়াজ আসছে কি না। তখনই সামনের দিকে চোখ গেল। মাহি আর তূর্জ একে অপরকে আলিঙ্গন করে বসে আছে। একে অপরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। তূর্জ মাহির মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু বলছে। মেহের ওদের এভাবে দেখে বিষম খেয়ে উল্টো ভোঁ দৌড় দিল। একদম দৌড়ে ফায়াজের সামনে গিয়ে থামল৷
ফায়াজ মেহেরকে এভাবে দৌড়াতে দেখে এক ধমক লাগাল। মেহের আমতা আমতা করছে। ওর মুখটা থমথমে।
“এভাবে দৌড়াচ্ছ কেন?”
মেহের থমথমে মুখে বলল,
“না মানে ও দিকে…!”
ফায়াজ ভ্রু কুচকে বলল,
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৬
” ও দিকে কি? ভূত দেখেছো না কি?”
“না কিছু না। কিছু না।” (জোরপূর্বক হেসে)
ফায়াজের সন্দেহ লাগছে। মেহের কি যেন লুকাচ্ছে। ওখানে কি আছে? কি দেখে মেহের দৌড়ে পালাল?
“দাঁড়াও আমি দেখে আসছি।”
মেহের চোখ বড়বড় করে ফায়াজের হাত ধরে আটকিয়ে বলল,
“না যাবেন না।”
মেহেরের এমন বাঁধা দেওয়া দেখে আরো সন্দেহ বেড়ে গেল। ফায়াজ নাছোড়বান্দা তাই মেহের বলল,
“ওদিকে মাহি আপু আর তূর্জ ভাইয়া আছে। যাবেন না।”
ফায়াজ ভ্রু কুচকে বলল,”তো? ওরা আছে তো কি হয়েছে?”
মেহের চুপ করে আছে। ফায়াজ কয়েক সেকেন্ডের মাথায় ব্যাপারটা বুঝতে পারল। তারপর বাকা হেসে বলল,
“নিশ্চয়ই রোমান্টিক মুডে আছে। দেখেছো তুমি আর আমি ছাড়া সবাই রোমান্টিক মুডে আছে। এখন যেহেতু তোমার আর আমার মধ্যে সব ঠিকঠাক আছে তাই দিনরাত রোমান্টিক মুডে থাকার কথা।”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,”কি ঠিক আছে? ”
ফায়াজ চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“তোমার কি ভোলার রোগ আছে? যাক গে সে তুমি ভুলে যাও। তাতে আমার কি? আমার তো মনে আছে। আর আমি এখন রোমান্টিক মুডে আছি।”
ফায়াজ মেহেরের কোমড় জড়িয়ে ধরে আঙুল দিয়ে চুল নাড়ছে আর বলছে,
“গতকাল আমি আমার জীবনের সেরা কিছু শব্দ শুনেছি। বলতে পারো জীবনের সব চেয়ে সেরা সময় পাড় করেছি। সব পেয়ে গেছি আমি। সব সময় চেয়েছি আমার এমন একজন মানুষ থাকুক, যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে।”
ফায়াজ আলতো করে মেহেরের চোখের পাপড়িতে চুমু খেল। তারপর আকুতি নিয়ে বলল,
“তুমি হারিয়ে গেলে আমার বুকের জমিনটা শূন্য হয়ে যাবে। আর আমি শূন্যতা নিয়ে দম আঁটকে মরে যাব৷ তাই হারিয়ে যেও না।”