শেষ পাতায় তুমি পর্ব - Golpo bazar

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৮ || ভয়ানক সেই রাতের কথা

শেষ পাতায় তুমি

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৮
ফাবিহা নওশীন

“সুখ সে যেন ক্ষনিকের বস্তু। যাকে বেশীক্ষণ আঁটকে রাখা যায় না। ফায়াজ সে তো সব ভুলে মেহেরকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল। সুন্দর কিছু স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু সে সব কি মরীচিকা? একটু সুখের ছোঁয়া পেলেই কেন দুঃখ সাগড়ের স্রোত এসে সুখগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়? কেন সুখগুলো ওর কাছে থাকতে চায় না? তবে কি সুখ ওর কপালে নেই? মেহের কি হারিয়ে যাবে? দূরে কোথাও?”
ফায়াজ আর ভাবতে পারছে না। যন্ত্রণায় নিজের মাথা চেপে ধরেছে। দম আটকে আসছে ওর। ভেতরটা হু হু করছে। একটা চাপা আর্তনাদ আঁটকে আছে যেটা চিৎকার হয়ে বের হয়ে চাইছে। আর পারছে না ডাক্তারের সামনে বসে থাকতে। কাউকে কিছু না বলে ছুটে বের হয়ে গেল হাসপাতাল থেকে। গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। গন্তব্য অনির্দিষ্ট।

ফায়াজ গাড়ি থামাল। ওর চোখ গেল মসজিদের দিকে। ফায়াজ কাচ ভেদ করে মসজিদের দিকে চেয়ে আছে। তারপর কি মনে করে গাড়ি থেকে বের হয়ে মসজিদের সামনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। অনেকের কাছে শুনেছে নামাজ মনকে শান্ত করতে পারে৷ মনে শান্তি ফিরিয়ে আনে। মেহেরের কাছেও অনেক বার শুনেছে। ফায়াজ গুটিগুটি পায়ে মসজিদে প্রবেশ করল। অদ্ভুত এক ফিলিংস হচ্ছে। শেষ কবে মসজিদে এসেছে, আল্লাহর দরবারে হাত তুলেছে মনে পড়ছে না। ফায়াজের সারা শরীর মৃদু কাঁপছে। কেমন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।
ফায়াজ ওজু করার জায়গায় গেল। সেখানে একজন সাদা পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধ লোক ওজু করছে। ফায়াজ কল ছেড়ে ওজু করে মাথায় রুমাল বেঁধে নিল।
মসজিদের ভেতরে গিয়ে সবার সাথে নামাজ পড়ল। সবাই চলে যাওয়ার পরেও ফায়াজ বসে আছে। কেমন একটা অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করছে। ফায়াজ দু’হাত তুলে মোনাজাত ধরল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

“হে আল্লাহ! আমি কবে ঠিক তোমার দরবারে হাত তুলেছি মনে নেই। তোমার প্রতি কখনো কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে হাত তুলি নি। আজও তা করছি না। আজ আমি কিছু চাইতে তোমার দরবারে হাত তুলেছি। আমার মেহেরকে চাই। ওকে ছাড়া আমি নিঃস্ব। আমি জীবনে প্রাচুর্য ছাড়া আর কিছু পাই নি। মা-বাবা, পরিবার কারো ভালোবাসা পাই নি। নিজের জন্য শুধু একজন চেয়েছি। আর তাকে যদি হারিয়ে ফেলি তবে আমার আর কিছু থাকবে না। মেহেরকে তুমি সুস্থ রেখো। ও খুব নিষ্পাপ মনের মেয়ে। সবার কথা ভাবে। কখনো নিজের সুখটা খুঁজে নি। ওর প্রতি তুমি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারো না। তুমি এতটা নির্দয় হতে পারো না। এটা আমার বিশ্বাস।” ( ফায়াজের চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে)

পুরো বাড়িটা যেন ভারী হয়ে আছে। মেহেরের নিশ্বাসটাও যেন ভারী লাগছে। অন্ধকার পুরো বাড়িটা ঘিরে ধরেছে। ফায়াজ তখনও বাড়ি ফিরে নি। মেহের হসপিটালে লাস্ট চেকাপ করতে গিয়েছিল আজ। আর তাতে জানতে পারে মেহেরের অপারেশন করাটা বাধ্যতামূলক। আর তাতে রিক্স আছে৷ আর এটা শোনার পর থেকেই সবাই যেন হুট করে বদলে গেল। তবে মেহেরের মন খারাপ লাগছে না। কারণ এ বাড়িতে মন খারাপ করার লোকের অভাব নেই।
তাই ওর আর মন খারাপ হচ্ছে না। কাউকে না কাউকে তো মন ভালো রাখতে হবে৷ সে দায়িত্বটা নাহয় ও নিজেই নিবে।
মেহের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফায়াজের জন্য অপেক্ষা করছে। লাইটের ঝকঝকে আলোয় সাদা একটা গাড়িকে গেট দিয়ে প্রবেশ করতে দেখল। ফায়াজ গাড়ি থেকে কিছুটা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে নামছে। মেহের ফায়াজের প্রবেশ পানে চেয়ে আছে। ফায়াজকে বিধ্বস্ত লাগছে।
মেহেরের বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
ফায়াজ ঘরে ঢুকতেই মেহের ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজ চোখ তুলে একবার মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর আবার চোখ নামিয়ে আলমারির দিকে আগাচ্ছে।।

মেহের পেছনে থেকে বলল,
“আপনি সারাদিন কোথায় ছিলেন? হসপিটাল থেকে হুট করে কোথায় চলে গেলেন? আপনার জন্য আমি টেনশন করছি।”
ফায়াজ থমকে গেল। শুকনো মুখে পেছনে ঘুরে মেহেরের মুখ পানে তাকাল। যে মেয়ের এই অবস্থা সে নিজের জন্য টেনশন না করে ওর জন্য টেনশন করছে। মেহেরের কপাল এখনো কুচকে আছে।
ফায়াজ আচমকা গিয়ে মেহেরকে জড়িয়ে ধরল। ওর ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। মেহের নিজের কাঁধে পানি অনুভব করল। ফায়াজ কাঁদছে। ঢুকরে কাঁদছে।
মেহের নিজেকে আর শক্ত করতে পারছে না। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে।
মেহের ধরা গলায় বলল,
“আপনি এমন করছেন কেন? আপনার বিহেভিয়ার দেখে মনে হচ্ছে আমি মরে যাব।”
ফায়াজ মুখ তুলে মেহেরর দিকে তাকাল। তারপর মেহেরের গালে আলতো ছুয়ে বলল,
” একদম আজেবাজে কথা বলবে না। তোমার কিছু হবে না। তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে। আমি তোমার কিছু হতে দেব না।”
ফায়াজ মেহেরকে আবারও বুকে চেপে ধরল।

মেহের ফায়াজের বুকে থেকেই বলল,” আমি তো সেটাই বলছি। দেখুন বাড়ির সবাই কান্নাকাটি করছে। সবাই মুখ ভার করে আছে। আপনিও যদি এমন করেন তাহলে কেমন হবে বলুন? আমার কি মন খারাপ হয় না?”
ফায়াজ নিজের চোখ মুছে বলল,
“আর কেউ কাঁদবে না। কেউ না। আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। কিছু দিবে খেতে?”
মেহের মুচকি হেসে বলল,” ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

মেহের আর ফায়াজ পাশাপাশি শুয়ে আছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। দুজনেই জেগে আছে তবে দুজনের মধ্যে এক গভীর আচ্ছন্ন নীরবতা। মেহের অন্ধকারে হাতড়ে ফায়াজের বুকের উপর হাত রাখল। ফায়াজ মেহেরের হাতটা চেপে ধরে মোলায়েম গলায় বলল,
“ফজরের সময় আমাকে ডেকো।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে বুঝতে পারল না ওকে কেন ডাকবে। এত সকালে কি করবে? কই যাবে? তাই জিজ্ঞেস করল,
“এত সকালে উঠে কি করবেন?”
ফায়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিচুস্তরে বলল,
“নামাজ আদায় করব।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে চমকে গেল। তারপর ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। আর মনে মনে বলল,”আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।”

ফায়াজ মেহেরকে অনবরত এভয়েড করে। মেহেরের কথাগুলো এড়িয়ে যায়। যতক্ষণ মেহেরের সামনে থাকে অস্থির হয়ে থাকে। কখন ছুটে পালাবে। মেহেরের সাথে সব সময় গম্ভীরমুখে কথা বলে। তবে মেহেরের খেয়াল রাখায় কোন কমতি রাখে না।
দেখতে দেখতে মেহেরের অপারেশনের দিন ঘনিয়ে আসে। সবাই মেহেরের জন্য অপেক্ষা করছে নিচে। কিন্তু মেহের তৈরি হচ্ছে না। কেমন ঢিলামি করছে। এটা ধরছে তো ওটা রাখছে। তৈরি হতে বেশ সময় পাড় করে দিল।
ফায়াজ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“মেহের, কি করছো? আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
মেহের ফায়াজের দিকে একবার তাকাল তারপর আবার নিজের কাজ করছে। ওর কেন জানি যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে হসপিটালে যত তাড়াতাড়ি যাবে তত তাড়াতাড়ি ওর জীবনীশক্তি হারিয়ে যাবে। এই সুন্দর পৃথিবী আর ভালোবাসার মানুষটা হারিয়ে যাবে। তাই বাড়ি থেকে বের হতে চাইছে না। দেরি করার নানান বাহানা করছে।
ফায়াজ গিয়ে মেহেরের হাত চেপে ধরল। মেহেরের হাত ধরতেই মেহের স্থির হয়ে দাঁড়াল।
ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল। মেহের ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে না। মেহেরের থুতনি ধরে উচু করে বলল,
“লুক এট মি মেহের।”

মেহের ফায়াজের চোখের দিকে তাকাল। দু’জন দুজনার চোখে চোখ রেখেছে। ফায়াজ ভালোবাসা মাখা কন্ঠে বলল,
“মেহের, জান আমার। তুমি অপারেশন থিয়েটারে যাবে তোমাকে জাস্ট একটা ইঞ্জেকশন দিবে। এটুকুই তোমাকে সহ্য করতে হবে। তারপর যখন চোখ মেলবে আমাকে দেখতে পাবে। বুঝেছো? একদম ভয় পেও না।”
মেহের উত্তরে ছোট্ট করে বলল,”আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন?”
ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল। মেহেরের এমন আকুতি জড়িত কথা অগ্রাহ্য করতে পারছে না কিন্তু অগ্রাহ্য করবে। নয়তো মেহের আহ্লাদী হয়ে পড়বে। মেহেরকে এই মুহুর্তে ইমোশনাল করে নিজের ইমোশন প্রকাশ করতে চায় না। তাই শক্ত কন্ঠে বলল,
“দেরি হয়ে যাচ্ছে, মেহের।”
মেহের গাল ফুলিয়ে তাকাল। ফায়াজ এতটা নিষ্ঠুর কি করে হয়ে যাচ্ছে? একটু জড়িয়ে ধরলে কি হবে?
ফায়াজ চলে যেতে নিলে মেহের পেছনে থেকে বলল,
“ওই কথাটা তো শুনুন তাহলে।”
ফায়াজ ঘুরে মেহেরের দিকে তাকাল। কিন্তু এই মুহুর্তে জানতে চায় না। কিছু জানতে চায় না।

“মেহের, আমি সব কথা শুনব। তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করব তবে সেটা যখন সুস্থ হয়ে বের হবে তখন।”
ফায়াজের মনে হচ্ছে মেহের এখন সব কথা বলে ফেললে আর ফিরে আসবে না। মেহের তার অব্যক্ত কথার জন্য হলেও ফিরে আসবে এটুকুই আশা।
ফায়াজ বের হয়ে গেল। মেহের ফায়াজের সাথে কথা বলবে না। নাক ফুলিয়ে রেডি হয়ে বের হলো।
মেহের সারা রাস্তা চুপ করে ছিল। কারো সাথে কথা বলে নি। ওর বাবা-মা, বোন, তূর্জ, সামিরা, অনু, ওলিদ, আলিফ, ফায়াজের বাবা, বন্ধুরা সবাই হসপিটালে গিয়ে হাজির। মেহের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে যাচ্ছে। ফায়াজ পেছন থেকে মেহেরকে ডাকল। ফায়াজ আর নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করতে পারছে না।
মেহের দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে ঘুরে ফায়াজের দিকে স্নিগ্ধ চোখে তাকাল। ফায়াজ মেহেরের সামনে এগিয়ে গেল। মেহের তখনও প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে আছে।
ফায়াজ মেহেরকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল।

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৭

“মেহের, তোমাকে ফিরতে হবে। তুমি ফিরবে। আমার জন্য নয়, আমাদের জন্য, আমাদের ভালোবাসার জন্য। এখনও অনেক কথা বাকি আমাদের। অনেকটা পথচলা বাকি। এখনও আমাদের সংসারটা গড়ে ওঠে নি। আমাদের হাতে হাত রেখে পথ চলা হয় নি। একসাথে বৃষ্টিবিলাস হয় নি, দুজনে একসাথে বসে জ্যোৎস্না দেখা হয় নি। এখনও প্রেমটা জমে ওঠে নি। তোমার অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করা হয় নি। এই সব কিছু আমার চাই। আর এই চাওয়া পূরণের জন্য হলেও তোমাকে ফিরতে হবে।” ( এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ফায়াজ দম নিল)
মেহের ফায়াজের পিঠে হাত রাখল। তারপর বলল,
” ইনশাআল্লাহ!”
ফায়াজ মেহেরকে ছেড়ে দিয়ে বলল,”ইনশাআল্লাহ!”

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৯

পরবর্তী পর্ব লেখক লিখলেই পোস্ট করা হবে 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.