শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৯
ফাবিহা নওশীন
“সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময় নিজের মতো বহমান। কিন্তু খারাপ সময় যেন যেতে চায় না। একেকটা মিনিট যেন কয়েক ঘন্টা সময়। ফায়াজের কাছেও এখন একেকটা মিনিটকে ঘন্টা মনে হচ্ছে। সব কিছু দুর্বিষহ লাগছে।”
ফায়াজ দু মিনিট স্থির হয়ে বসতে পারছে না। এদিক সেদিক পায়চারী করছে। আর অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজের মনে হচ্ছে ওর বুকটা যেন কেউ চেপে ধরে রেখেছে। দম বন্ধ করা ভয়ংকর অনুভূতি হচ্ছে।
ফায়াজ আবারও বসেছে। দুহাতে মাথা চেপে ধরে আছে। একদিনেই নিজের চেহারাটা কি বানিয়ে ফেলেছে। ফায়াজের মনে হচ্ছে কয়েকঘন্টার জন্য যদি ভ্যানিশ হয়ে যেত পারত। আর পারছে না অপেক্ষা করতে।
“অপেক্ষা সে তো ভয়ংকর অনুভূতির নাম, অপেক্ষা সে তো বুকের ভেতর রক্তক্ষরনের নাম।”
ফায়াজকে অস্থির অস্থির করতে দেখে তুষার এগিয়ে এল। ফায়াজের কাঁধে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ভাই, কি করছিস? এমন করছিস কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ফায়াজ করুনসুরে বলল,”আমি আর পারছি না তুষার। আমার ভেতরটা এমন করছে কেন? মেহের ঠিক হয়ে যাবে তো? ওর কিছু হবে না তো?”
তুষার আশ্বস্ত করে বলল,
“তুই এমন করিস না। মেহের একদম ঠিক হয়ে যাবে। চুপ করে বস।”
ফায়াজ তুষারের কথা শুনে বলল,
“কি করে বলতে পারিস? আমি চুপ করে কি করে বসতে পারি? আমি জীবন মরণের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। তাই তো মৃত্যু পথযাত্রীর মতো ছটফট করছি। আমি পারব না স্থির থাকতে।”
মেহেরের পরিচিতি জনেরা কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। সবাই নিশ্চুপ হয়ে আছে। কারো কপালে, কারো মুখে হাত। সবার নীরব প্রার্থনায় মেহেরের সুস্থতা কামনা রয়েছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন
মেহেরের মায়ের কপালে চিকন ঘামের রেখা ফুটে ওঠেছে। উনার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। মাহি মিশানকে নিয়ে ওঠে গেল। ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে। এতক্ষণ মাহি বসে থাকলেও এখন আর পারছে না।
তুষার একমনে ফায়াজের দিকে চেয়ে আছে। তুষারের হুট করে একটু বেশীই ভয় লাগছে। অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠছে। তবে মেহেরের জন্য নয়। এই ভয়টা ফায়াজের জন্য। মেহেরের যদি কিছু হয় তবে ফায়াজ পাগল হয়ে যাবে। ওকে বাঁচানো যাবে না। যদি খারাপ কোন নিউজ আসে তো দেখা যাবে ফায়াজ হসপিটালের সাত তলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে। তুষার ঢোক গিলছে। এ-সব আর ভাবতে পারছে না। চোখের সামনে বন্ধুর জীবনটা শেষ হতে দেখতে পারবে না।
ফায়াজ হসপিটালের জানালা থেকে বাইরে চেয়ে আছে। নগরীর ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে কতশত মানুষ যাতায়াত করছে। এম্বুলেন্স করে কয়েকজন রোগী আসছে। মাত্রই হসপিটাল থেকে একটা লাশ নিয়ে গেল। সেখানে ছিল আত্মীয়স্বজনে আহাজারি, আর্তচিৎকার। এই অন্ধকারে তাদের আর্তচিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে আসছিল। ফায়াজ এই মুহুর্তে অনুভব করতে পারছে একটা মানুষ মরে যাওয়া মানে একজন মরে যাওয়া না সাথে তার ভালোবাসার অসংখ্য মানুষকে জীবন্ত লাশে পরিণত করা।
মেহের বলেছিল,
“দুটো মানুষের মধ্যে যদি একটা সম্পর্ক থাকে আর সে সম্পর্কটা যদি হয় ভালোবাসার তবে সেই মানুষগুলো হারিয়ে গেলেও ভালোবাসাটা থেকে যায়। যদি আমি হারিয়ে যাই তবুও ভালোবাসাটা হারাবে না। আপনার প্রতি প্রার্থনায় আমি থাকব।”
ফায়াজ চোখ বন্ধ করে নিল। তারপর বিড়বিড় করে বলল,
“এ-সব কথায় আমার পোষাবে না। আমার তোমাকে চাই।”
ফায়াজ চোখ খোলে আকাশের দিকে তাকাল। রাতের আকাশে তারারা জ্বলে আছে। পুরো আকাশ জুড়ে তারার মেলা। আকাশপানে চেয়ে অতি গোপনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাল।
🥀🥀
কিছুক্ষণ পরে অপারেশন থিয়েটারের লাইট অফ হয়ে গেল। ফায়াজের বুকটা কেন জানি ধক করে উঠল। সাথে সাথে সবাই এগিয়ে গেল। ডাক্তার সবাইকে বিচলিত অবস্থায় দেখে হাসি মুখে বলল,
“অপারেশন সাকসেসফুল। কেবিনে শিফট করা হবে। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে।”
সবার মুখে হাসি ফুটল। ফায়াজের গলার কাছে আঁটকে থাকা প্রাণটা যেন ফিরে এলো। ফায়াজের চোখ খুশিতে চিকচিক করছে। ফায়াজ খুশিতে তুষারকে জড়িয়ে ধরল। ফায়াজের খুশি দেখে তুষারের চোখেও পানি চলে এসেছে। এতক্ষণ ওর নিশ্বাসও আঁটকে ছিল। সবাই বেশ উৎফুল্ল। সবাই যেন আবার প্রাণ ফিরে পেল। মেহেরের মা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছেন আর চোখের পানি মুছছেন৷ মাহি খুশিতে মিশানকে আরো শক্ত জড়িয়ে ধরল।
🌸🌸
মেহের পিটপিট করে চোখ মেলে। চোখ মেলার পর নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগছে। শরীরটা নেতিয়ে গেছে। মেহের হাতটা নড়ানোর চেষ্টা করলে হাতে মৃদু ব্যথা অনুভব করে। মেহের হাতটা চোখের সামনে ধীরে ধীরে এনে দেখে তাতে ব্যান্ডেজ করা। মেহের চারদিকে চোখ বুলাল। একজন নার্সকে দেখতে পেল। মেহেরের তখন হুশ হলো। ও হসপিটালে এসেছে। আজ ওর অপারেশন। মেহের একটু নড়তেই বুঝতে পারল ওর অপারেশন হয়ে গেছে। আর ও বেঁচে আছে। মেহের খুশিতে কেঁদে দিল। আর মনে মনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছে।
“ফায়াজ, আমাকে আল্লাহ ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমার প্রতি আর আপনার প্রতি দয়া করেছেন৷ আমি বেঁচে আছি ফায়াজ।”
নার্স মেহেরকে চোখ মেলা দেখে বাইরে চলে গেলেন।
ফায়াজ এক প্রকার দৌড়ে ভেতরে ঢুকল। ঢুকে দেখল মেহের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। ফায়াজ পা টিপে টিপে মেহেরের দিকে আগাচ্ছে। কেন জানি ওর বুক ঢিপঢিপ করছে আর শরীরটাও কাঁপছে। কেন কাঁপছে? নিশ্চয়ই এ কাঁপন সুখের কাঁপন।
ফায়াজ মেহেরের পাশে গিয়ে বসল। মেহের ফায়াজের অস্তিত্ব টের পেয়ে ফায়াজের দিকে অশ্রুভেজা চোখে তাকাল।
তারপর মেহের আবারও কেঁদে ফেলল। ফায়াজের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। ফায়াজ মেহেরের হাতটা ধরে ছলছল চোখে হাতে চুমু খেল।
ধরা গলায় বলল,
“কথা রেখেছে আমার মেহেরজান।”
ফায়াজ নিজের মাথাটা মেহেরের বুকে রাখল। মেহের ফায়াজের ঘাড়ে হাত রাখল। ফায়াজের মাথায় চুমু খেল। ফায়াজ মেহেরের চোখের পানি মুছে দিয়ে ওর কপালে চুমু খেল। ওরা একে অপরের সাথে সময় কাটানো শেষে একে একে সবাই মেহেরের সাথে দেখা করে গেল।
কিছুদিন পরে মেহেরকে রিলিজ দেওয়া হলো হসপিটাল থেকে। সবাই বাড়িতে গিয়ে চমকে গেল। ফাইজা আর ওর মা এসেছে। মেহের ভেতরে ঢুকতেই ফাইজা দৌড়ে এল ওর কাছে। ফায়াজ এতবছর পর ওর মাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। ফায়াজের মা ছলছল চোখে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ বিস্ফোরিত চোখে ওর মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে মেঝের দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে আছে। তারপর এক বার মেহেরের দিকে তাকাল। ফাইজা মেহেরকে কি জানি জিজ্ঞেস করছে আর মেহের হাসিমুখে তার উত্তর দিচ্ছে। মেহেরের মা ফায়াজের মা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ফায়াজ চুপচাপ সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ফায়াজের মা ফায়াজের যাওয়ার দিকে সবার আড়ালে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালেন।
এই প্রথম ফাইজার সাথে মেহেরের দেখা হয়েছে। ফাইজা কথার ঝুলি নিয়ে বসেছে। ওর মায়ের সাথে মেহেরকে কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না।
ফায়াজের মা মেহেরের সাথে কথা বলার জন্য একা বসেছে।
মেহের আর ওর শ্বাশুড়ি এক সাথে একা বসে আছে। মেহেরের খুব নার্ভাস লাগছে। এই প্রথম উনার সাথে দেখা। কি বলবে, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
ফায়াজের মা নীরবতা ভেঙে বলল,
“তুমি দেখতে বেশ মিষ্টি।”
মেহের মুচকি হাসল তার কথা শুনে। কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল,
“আপনি কেমন আছেন?”
মেহেরের কথা শুনে তিনি মুচকি হাসেন। তারপর বলল,
“ছেলে, সংসার হীন যেমন থাকার কথা তেমনই আছি।”
মেহের ফায়াজের বাবার মতো ফায়াজের মায়ের চোখেও সেই লুকনো ব্যথা দেখতে পেল। তারপর দুজনে নানা বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলল। ফায়াজ দূর থেকে নজর রাখছে। ওর মায়ের এখানে আসাটা একদম মেনে নিতে পারছে না। মেহেরদের বাড়ি তাই রিয়েক্ট করতে পারছে না। যেটুকু রিয়েক্ট করত সেটাও করছে না মেহেরের অসুস্থতার জন্য। সবেমাত্র হসপিটাল থেকে ফিরেছে। তাই কোন তামাশা দাড় করাতে চায় না।
মেহেরে না উনাকে থাকার জন্য অনেকবার বলল কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। ফায়াজের সাথে অনেক বার কথা বলার চেষ্টা করেও পারেন নি। এখানে থেকে ফায়াজকে আর কষ্ট দিতে চান না। যাওয়ার আগে মেহেরকে উপহার স্বরুপ একটা নেকলেস পড়িয়ে দিয়েছেন। মেহের কিছুতেই নিতে চায় নি ফায়াজের ভয়ে। কিন্তু ওর মা বলল,
“শ্বাশুড়ি মা প্রথম বার ভালোবেসে কিছু দিয়েছে। ফিরিয়ে দিস না। দোয়া হিসেবে রেখে দে।”
ওরা চলে যেতেই মেহেরকে রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে বলল। হসপিটাল থেকে আসার পর মেহের রেস্ট করার সুযোগ পায় নি।
মেহের ওড়নার আড়ালে নেকলেসটা লুকিয়ে রুমে নিয়ে গেল। উদ্দেশ্য ফায়াজকে কিছুই জানাবে না। আলমারিতে লুকিয়ে রাখবে। মেহের রুমে ঢুকে কোনদিক না চেয়ে সোজা আলমারির কাছে চলে গেল।
যখনই আলমারি খুলে নেকলেসটা রাখতে যাবে ফায়াজ হুড়মুড় করে এসে মেহেরের হাত থেকে বক্সটা নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে মারে। মেহের চমকে যায়। তারপর ভয়ে ভয়ে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজের চোখে যেন আগুন জ্বলছে। রাগে গজগজ করছে। ফায়াজ চোখ গরম করে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে। মেহের ঢোক গিলে। আর চোখ বন্ধ করে বলল,
“যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত্রী হয়।”
মেহের চোখ খুলে ফায়াজের দিকে তাকাতেই ফায়াজ বলল,
“তুমি ওই মহিলার কাছ থেকে এটা কেন নিয়েছো?”
মেহের ওর কথা শুনে বলল,
“কি বললেন আপনি? উনি আপনার মা।”
ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”মা! কিসের মা? আমার কোন মা নেই। তুমি আর একবার যদি উনাকে আমার মা বলে সম্বোধন করেছো তবে ভালো হবে না? ওই মহিলা কেন এসেছে এখানে? কেন এসেছে? আর তোমার এত কথা কিসের উনার সাথে?”
মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“আমাদের বাড়িতে আমাকে দেখতে এসেছে আর আমি কথা বলব না? আমি এতটা অমানবিক হতে পারি না।”
ফায়াজ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“আচ্ছা, তাই? এইজন্য এই নেকলেস নিয়েছো?”
ফায়াজ নেকলেসটা তুলে বাইরে ছুড়ে মারতে নিলে মেহের ধরে ফেলল।
“কি করছেন?”
ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার কত গয়না চাই? আমাকে বলো আমি এনে দেব৷ কিন্তু এই মহিলার একটা সুতোও তুমি ছুবে না। বলো কি চাই তোমার?”
মেহের ফায়াজের হাত থেকে বক্সটা নিয়ে বলল,
“আমার কিছুই চাই না। আপনার সাথে উনার সমস্যা থাকলেও আমার নেই। আমাকে ভালোবেসে কিছু দিয়েছেন আমি তার অসম্মান করতে পারব না। আপনি না চাইলে আমি এটা পড়ব না কিন্তু নিজের কাছে যত্ন করে রেখে দেব।”
“প্রয়োজন নেই যত্ন নেওয়ার। সবাই যত্নের যোগ্য না। তুমি রাখবে না। আমি ফেরত পাঠিয়ে দেব।”
শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৮
ফায়াজ মেহেরের হাত থেকে বক্সটা আবার নিয়ে নিল। মেহের কিছু বলতে গেলে বলল,
“অনেক করেছো দৌড়-ঝাঁপ, আনন্দ ফূর্তি। এইবার রেস্ট নেও।”
ফায়াজ মেহেরকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল।
মেহের কিছুই বলতে পারল না।