শেষ পাতায় তুমি পর্ব - Golpo bazar

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৪০ || ফাবিহা নওশীন

শেষ পাতায় তুমি

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৪০
ফাবিহা নওশীন

ফায়াজ বক্স হাতে দরজার সামনে যেতেই মেহের বিছানায় বসা অবস্থায় কিছুটা কড়া সুরে বলল,
“আপনি একটু বেশীই রুড বিহেভ করছেন না?”
ফায়াজ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর পেছনে ঘুরে মেহেরের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল। মেহের ফায়াজের রক্তচক্ষু দেখে চোখ নামিয়ে নিল। ফায়াজ ধীরে ধীরে মেহেরের কাছে গিয়ে বসে। মেহের নড়ে-চড়ে একটু দূরে সরে বসে।

ফায়াজ মেহেরের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। মেহের তখনও দৃষ্টি নত করে রেখেছে।
তারপর ফিসফিস করে বলল,
“তুমি একটু বেশীই সাহস দেখাচ্ছো সেটা মনে হচ্ছে না?”
মেহের ফায়াজের দিকে চোখ তুলে একবার তাকাল। তারপর আবার নিচের দিকে তাকাল।
ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“যাকে আমি পছন্দ করি না। যার সাথে আমার সম্পর্ক নেই তার সাথে তুমি সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছো? তোমাকে যদি আমি এর পর ওই মহিলার আশেপাশে দেখেছি তো… ”
ফায়াজ থেমে গেল। কিন্তু মেহের পরের টুকু শোনার প্রতিক্ষায় আছে। কিন্তু ফায়াজ পুরো লাইন শেষ করে নি। তাই মেহের ফায়াজের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল।
ফায়াজ মেহেরের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারল। মেহের পুরোটা শুনতে চায়। তাই বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গুপ এ জয়েন হউন

“মেরে দেব।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে বিস্ময়ে আকাশ থেকে পড়ল। ফায়াজ ওকে মারার কথা বলছে। যে ফায়াজ ওর অসুস্থতার সময় এতটা ভেঙে পড়েছিল। সে আজ ওকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে।
ফায়াজ আবারও ধমকে বলল,
“তোমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আবারও বলেছি আমি ফায়াজ নওয়াজ খান। এগেইন রিপিট ফায়াজ নওয়াজ খান। আমি বদলে যেতে পারি কিন্তু নিজের চাওয়া আর নিজের জিনিসের দিকে কারো নজর পড়তে দেই না আর দেবও না।”
ফায়াজ কথা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে মেহেরকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর কড়া গলায় শাসিয়ে বলল,
“তোমার একটা অপারেশন হয়েছে ভুলে যেও না। তুমি এখনো পুরোপুরি ফিট না। ডাক্তার ফুল রেস্টে থাকতে বলেছে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে তোমাকে। আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে।”
ফায়াজ বক্সটা হাতে বেড়িয়ে পড়ল।

ফাইজা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। ফায়াজ দেখা করতে বলেছে। কিন্তু ফায়াজেরই খোঁজ নেই। ফায়াজ বলেছে, ১০মিনিটের মধ্যে দেখা কর। যেভাবে ছিল সেভাবেই দৌড়ে চলে এসেছে। কিন্তু ফায়াজ নেই। কিছুক্ষণ পরে ফায়াজের গাড়ি এলো। ফাইজা এগিয়ে গেল। ফায়াজ এডিটিউট নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ফাইজার হাতে বক্সটা ধরিয়ে দিল। ফাইজার চিনতে বাকি নেই বক্সটা। এই নেকলেসটা ওর মা ওকে সাথে নিয়ে কিনেছে। ফাইজা বক্সের দিকে চেয়ে আছে।
ফায়াজের কথায় ঘোর ভাঙল।
“তোর মা’কে বলবি সে যেন এ-সব দিয়ে মেহেরকে হাত করার চেষ্টা না করে। আমি আমার প্রিয় জিনিসের পাশে অপ্রিয় জিনিসের ছায়া সহ্য করব না। আমি থিংক আমার কথা বুঝতে পেরেছিস। উনাকে বলে দিবি।”
ফাইজার চোখ ছলছল করছে। ওর ভাইয়া যে আজ প্রথম মা’কে অপমান করছে তা নয়। এর আগেও করেছে কিন্তু এতটা খারাপ লাগে নি। আজ কেন জানি খুব খারাপ লাগছে। বুক ফেটে কান্না আসছে। ফায়াজের ফাইজার ছলছলে চোখ উপেক্ষা করে গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। ফাইজা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ যাওয়ার পর ওর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আজ ওর প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে।

ফায়াজ মেহেরের রুমে গিয়ে দেখে মেহের ঘুমিয়ে আছে। একটা কুশন জড়িয়ে ধরে ঘুমে আচ্ছন্ন। ফায়াজের আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
ফায়াজ বিড়বিড় করে বলল,
“মেহের, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও। বাড়িতে চলে গেলে তোমাকে কষ্ট দেওয়া মানুষগুলো তোমাকে আর ছুতে পারবে না। আমি ছুতে দেব না।”
ফায়াজ মেহেরের পাশে গিয়ে বসে। ওর চুলে বিলি কাটে। মেহের মৃদু নড়ে ওঠে। তাতে করে ওর চোখের পাতা আর ঠোঁট নড়ে ওঠে। ফায়াজ লোভ সামলাতে পারে না। মেহেরের দিকে ঝুঁকে আলতো করে ওর ঠোঁটে চুমু খেল। মেহেরের ঘুম হালকা ছিল ফায়াজের ছোঁয়া পেয়ে চমকে যায়। ঘুমঘুম চোখ মেলে ফায়াজকে দেখে। মেহের চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকায়। ফায়াজ হেসে ফেলে। সারাদিন পর ফায়াজের মুখে হাসি দেখল মেহের। স্নিগ্ধ হেসে ফায়াজ মেহেরের পাশে শুয়ে পড়ল। মেহেরের গলায় হাত দিয়ে মেহেরকে ঘেঁষে শুয়ে রইল। মেহের তখনও গাল ফুলিয়ে আছে।
ফায়াজ মেহেরকে চুপ দেখে মাথা উঁচু করে ওর মুখটা দেখল। মেহের মুখ ভার করে আছে। ফায়াজ আবারও আলতো করে মেহেরকে চুমু খেয়ে বলল,
“মুখ ভার কেন?”

মেহের জোরপূর্বক হেসে বলল,
“ঘুমিয়ে ছিলাম তাই।”
ফায়াজ আবারও মেহেরকে ঘেঁষে শুয়ে বলল,
“আমি তোমাকে মেরে ফেলব। তোমার তাই মনে হয়?”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে ঘাবড়ে গেল। ফায়াজ তাহলে বুঝতে পেরেছে। মেহের ঘনঘন পলক ফেলল।
ফায়াজ বলল,
“জানো তো আমি স্বার্থপর মানুষ। আর স্বার্থপর মানুষ নিজের চেয়ে কাউকে বেশী ভালোবাসতে পারে না। ইনফেক্ট আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষের নিজেকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসা উচিৎ। যে নিজেকে ভালোবাসতে পারে না সে অন্যকে কি করে ভালোবাসতে পারে? তাই আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষের নিজেকে ভালোবাসা উচিৎ। আমি নিজেকে কি করে মেরে ফেলতে পারি? তোমাকে মারা মানে তো নিজেকে মেরে ফেলা। আর সেটা আমি কল্পনাও করতে পারি না। তুমি ফায়াজের জীবন। ওটা তো রাগের মাথায় বলেছি। তুমি আমার অপছন্দের মানুষের সাথে নিজেকে জড়িও না প্লিজ।”
মেহের ফায়াজের দিকে ঘুরে বলল,

“ইউ আর সো রুড। আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম।”
ফায়াজ বাঁকা হেসে বলল,” সেজন্যই তো আদর করলাম এতক্ষণ।”
মেহের লাজুক হেসে আবার সোজা হয়ে গেল।
ফায়াজ মেহেরের লাজুক হাসি দেখে বলল,”এভাবে হেসো না লোভ লাগে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হও তো। তোমাকে নিয়ে আমার সম্রাজ্যে ফিরতে চাই। আমার সম্রাজ্ঞীকে নিয়ে।”
মেহের ফায়াজের দিকে ঘুরে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“আবারও এভাবে যাব?”
ফায়াজ না বুঝতে পেরে বলল,”কিভাবে?”
মেহের পলক ফেলে ঠোঁট কামড়ে ফায়াজের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“আমার কোন কালে বিয়ে, সংসার এ-সব নিয়ে স্বপ্ন ছিল না। আসলে নিজেকে অনেক ছোট ভাবতাম। এসব ভাবার উপযুক্ত হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি।”
মেহের শ্বাস নেওয়ার জন্য একটু থামল। ফায়াজ পরবর্তী কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
মেহের স্মিত হেসে বলল,”আসলে আমি দু-পরিবারের খুশি আর দোয়া নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চাই। বউ সেজে ধুমধামে বিয়ে করে বাপের বাড়ি ছাড়তে চাই। আর পাঁচটা মেয়ের মতো। এছাড়া আমাদের ওই বিয়েটা তো বিয়ে ছিল না।”
ফায়াজ মেহেরের কথা বুঝতে পারল। তারপর বলল,”ওকে। সে কি এমন কথা। সব হয়ে যাবে।”

মেহের ফায়াজের আরেকটু কাছে এসে বলল,”আপনি যতটা ইজি ভাবছেন ততটা ইজি না। আমার বাবাকে তো জানেন। সে আমাদের দু’জনকেই অপছন্দ করেন। আমি অসুস্থ তাই দয়া করছে। আর আমার জন্য আপনাকে এলাও করছে।”
ফায়াজ ভেবেছিল মেহেরের বাবা ক্ষমা করে দিয়েছে কিন্তু এ তো নতুন কথা শুনছে। এখন তো নতুন সমস্যা।

পরেরদিন সবাই বিকেলে এক সাথে বসেছে আড্ডা দিতে। ফায়াজের বিরক্ত লাগা স্বত্তেও বসে আছে। কারণ ফায়াজ কিছু কথা বলতে চায়। সবার কথার মাঝে ফায়াজ বলল,
“আমি কিছু বলতে চাই।”
সবাই ফায়াজের দিকে মনোযোগ দিল।
ফায়াজ সবার দৃষ্টি ওর দিকে দেখে বলল,
“বাবা আসবে আপনাদের সাথে কথা বলতে। মেহেরের অপারেশন হয়ে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে সুস্থও হয়ে যাবে। তাই মেহেরকে বাড়িতে নিয়ে যাব। বাবা আসবে আমাদের বিয়ের কথা বলতে। আসলে মেহের চায় আমাদের সামাজিক ভাবে বিয়ে হোক।”
তূর্জ তখনই বাড়িতে ঢুকেছে। ওর কথা শুনে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে হেসে হেসে বলল,
“শালিকা ডাবল বিয়ে করতে চাইছে। বাহ! বেশ। ডাবল বিয়ে ডাবল গিফট। সব ডাবল।”
মেহের মুখ ভেংচি কেটে বলল,

“ডাবল কোথায়? ওটা কি বিয়ে ছিল? ওটা তো একটা চুক্তি ছিল।”
মেহের কথাটা বলেই জিব কাটল। মুখ ফস্কে কি বলে ফেলল। সবাই চমকে মেহেরের দিকে তাকাল। ফায়াজ অবাক চোখে চেয়ে আছে মেহেরের দিকে। মাহি ঢোক গিলছে। মেহের আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে তার রিয়েকশন বুঝার চেষ্টা করছে।
মেহেরের বাবা গম্ভীরমুখে বলল, “মানে? চুক্তি! কিসের চুক্তি?”
মেহের এড়ানোর জন্য বলল,”না মানে চুক্তি না। ওটা তো কথার কথা। আসলে আমাদের মধ্যে একটা ঝামেলা হয়েছিল সেটাই বলছিলাম।”
মেহেরের বাবা সন্তুষ্ট হলেন না ওর কথা শুনে। তাই বললেন,
“সত্যিটা আমি তোমাদ দু’জনকে জিজ্ঞেস করছি।”
ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল। মেহের আমতা আমতা করছে। মাহি ওর বাবার দিকে একবার আর একবার মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি বলছি।”
মেহের মাহির দিকে চমকে তাকাল। তারপর উঠে দাঁড়াল।
মাহি মেহেরকে পাত্তা না দিয়ে বলল,”এতকিছু, এত ঘটনার মধ্যে একটা সত্য লুকিয়ে আছে। আর সে সত্যটা হচ্ছে সবকিছুর জন্য আমি দায়ী। আমি হচ্ছি মেইন কালপিট।”

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৩৯

কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। তূর্জ অবাক চোখে চেয়ে আছে মাহির দিকে।
“আমি হচ্ছি সেই যার জন্য এসব হয়েছে। আমার জন্য মেহেরের জীবনে ঝড় নেমে এসেছে। আমার খুশির জন্য মেহের সব কিছু মেনে নিয়েছে। মেহের আমার খুশি, তোমাদের খুশির জন্য অনেক বিসর্জন দিয়েছে। মুখ বুঝে সব অপবাদ মেনে নিয়েছে। আর আমি এতদিন যাবত সবার বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা নিয়ে খেলেছি। আমি তূর্জকেও ঠকিয়েছি। মেহেরকে ব্যবহার করেছি। আমি ওর জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছিলাম৷ আমার জন্য আজ সবাই ভুগছে আর আমি স্বার্থপরের মতো নিজের সংসারের কথা ভেবেছি।”
মাহির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।

শেষ পাতায় তুমি পর্ব ৪১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.